ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ ও কোরান পড়া শেষ করেই মোবাইল ফোনটা টেনে নিয়ে কানে ক্ষুদ্র দুটি সাউন্ড বক্স ঢুকিয়ে চলে যাই ইউটিউব-এ। বাছ বিচার ছাড়াই যে কোন শিল্পীর কন্ঠে নাস্তা করার আগ মুহূর্ত পযন্ত রবীন্দ্রসংগীত শুনে পবিত্রতায় অবগাহন করি। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ১ ঘন্টা বই নিয়ে কাটিয়ে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ব্লুটুত চালিয়ে গুরুর গান শুনে নিদ্রা দেবীর আরাধনা করি। ব্লুটুতের পাওয়ার থাকা পর্যন্ত বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায় গান, আমি ততক্ষণে স্বপ্নের জগতে। এ আমার দৈনন্দিন গুরু দক্ষিণা।
শান্তি নিকেতন কবির জন্মদিন, মহাপ্রয়াণ দিবস, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব মিলিয়ে ৭ বার গিয়েছি। তারপরও কলকাতা গেলেই মনটা উড়–উড়– করে হাওড়া যেয়ে শান্তি নিকেতন এক্সপ্রেস ধরার জন্য।
কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি, শাজাদপুর কছারি বাড়ি, পতিসর, দক্ষিণডিহি কবির শ্বশুরবাড়ি, দার্জিলিং, শিলং কবির ফেলে যাওয়া পাদুকার ছাপ অনুস্মরণ করে পরিব্রাজকের মতো ঘুরেছি। কবির জন্মভিটা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির বাইরের ফুটপাথের চা দোকানদারদের অনেকের বাংলাদেশি দাদাও বনে গেছি। একবার “স্মৃতিটুকু থাক” মনে করে ঠাকুর বাড়ির গেইটের বাইরে পিঁড়িতে বসে মুখের খৌরকর্ম (সেভ) করেছি। এ হলো আমার রবীন্দ্র নস্টালজিয়া।
কবিগুরু দুবার এসেছিলেন আমাদের কুমিল্লায়। প্রথমবার ১৯০৫ সালে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে। সেবার তিনি কুমিল্লা টাউন হলে বক্তব্য রাখেন এবং একরাত ধর্মসাগর পাড় রাণীর কুঠিরে অবস্থান করেন।
দ্বিতীয় বার এসেছিলেন ১৯২৬ সালে কুমিল্লা অভয় আশ্রমের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে। ছিলেন অভয় আশ্রমের সেবা সদনে (বর্তমান কেটিসিসিএ লি:)। সেবার তিনি মোট ৬৬ ঘন্টা কুমিল্লায় অবস্থান করেন এবং আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন যায়গায় যান। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঈশ্বর পাঠশালার, রামমালা হোস্টেলের ছাত্রদের এবং কুমিল্লা মহিলা সমিতির সদস্যদের সাথে অনেকটা সময় কাটানো। তারা তাঁকে মানপত্র দেন যাতে কিছু পঙ্ক্তি ছিল এ রকম......
“বাংলার রবী জগতের কবি
ত্রিপুরার দ্বারে এসেছো আজ
বরণ করিগো চরন ধরিয়া
বাংলা মায়ের যশের তাজ”
আমি যখন ’৯৪ সালে প্রথম শান্তি নিকেতন যাই সেবারই জানি কুমিল্লায় কবিগুরুর অবস্থানের স্থান গুলোর কথা। আগেই জানতাম কবি কুমিল্লায় এসেছিলেন।
কুমিল্লা এসে আমি যোগাযোগ করি “অলক্ত সাহিত্য পত্রিকা” সম্পাদক তিতাস চৌধুরীর সাথে। তিনি আমাকে “ঢাকা প্রকাশ” নামে তৎকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় কবিগুরু কুমিল্লায় কোথায়, কোথায় ছিলেন তার রিপোর্ট দেখান।
আমি তখন আমার সংগঠন “সংলাপ কুমিল্লা” পক্ষথকে শহরে কবির স্মৃতি বিজড়িত ৭ টি যায়গায় ঢাকা প্রকাশের ক্যাপসান দিয়ে টিনের ফলক দিয়ে চিহ্নিত করি। কেটিসিসিএ লি: এর স্থানে কবির জন্মদিন ও মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করা শুরু করি। অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক, সুধিজন অনেকেই গিয়েছেন, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রয়াত শান্তনু কায়সার, জাপান প্রবাসী রবীন্দ্র গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকারও একটি অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আর শহর কেন্দ্রীক মানুষিকতায় এতদূর যেতে অনেকে অনিহা প্রকাশ করতেন।
কবি যে সেবা সদনে অবস্থান করেছিলেন সেটিকে সংস্কার করার জন্য অধ্যাপক কাজী বাশার যখন কেটিসিসিএ লি: এর চেয়ারম্যান ছিলেন অনেক দেন দরবার করেছিলাম। এমনকি ভারতীয় হাই কমিশনার ঢাকা পর্যন্ত গিয়েছিলাম তারাও রাজি ছিল। এখনও আছে কিন্তু কাজী বাশার চলে আসার পর তা আর এগোই নি।
গত ২০১৯ এ আমি কুমিল্লায় “ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অনুষ্ঠান করাকালীন ভারতীয় সহকারী দূতাবাস চট্টগ্রাম এর সহকারী হাই কমিশনার অনিদ্য ব্যানার্জির সাথে আবার কথা বলি। তিনি এ ব্যাপারে খোঁজ নেবেন বলে জানিয়ে ছিলেন কিন্তু করোনা আসার কারণে বিষয়টি আর এগোয় নি।
এখনও সময় আছে কুমিল্লায় কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানের স্থানগুলো চিহ্নিত করে সম্ভব হলে সেবা সদন টিকে মেরামত করে কবির স্মৃতি ধরে রাখার।