‘বিশ্বে
প্রতিবছর যত মানুষ মারা যান, তার ৩০ শতাংশই হার্টের অসুখে। ভারতে প্রতিবছর
১ কোটি মানুষ মারা যান, এর মধ্যে হৃদরোগে মারা যান প্রায় ৩০ লাখ মানুষ; যা
প্রতি তিন জনে একজন। আর বাংলাদেশেও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ হৃদরোগে
আক্রান্ত। আর সবমিলিয়ে নানা রোগে ভুগে মারা যাওয়া মধ্যে অর্ধেকই
হার্ট-অ্যাটাকে।’ শুক্রবার (৩১ মে) ঢাকায় এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন
ভারতের খ্যাতিমান হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ ডা. বিমল ছাজেড়। তিনি
বলছেন, ভয়াবহ এই রোগ সার্জারি ছাড়াই নিরাময় সম্ভব। এ জন্য তিনি বিশেষ এক
চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচারণা চালাচ্ছেন। সায়েন্স অ্যান্ড আর্ট ফর লিভিং (সাওল)
নামে এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবক আমেরিকার প্রখ্যাত হৃদরোগ ও লাইফস্টাইল
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ডিন অর্নিশ।
এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে
ডা. বিমল ছাজেড়ের প্রতিষ্ঠিত সাওল হার্ট সেন্টার। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ও
ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩২টি শাখার মাধ্যমে ‘বিনা রিং ও বিনা
অপারেশনে’ হৃদরোগের স্থায়ী চিকিৎসা দিচ্ছে। তার দাবি, প্রাণঘাতী হৃদরোগ
চিকিৎসায় এনজিওপ্লাস্টি, বাইপাস বা কাটা-ছেঁড়া ছাড়া শুধু খাদ্যাভ্যাস ও
জীবনাচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে লাখ লাখ হার্টের রোগী সুস্থ হয়েছেন। এই
পদ্ধতিতে কীভাবে চিকিৎসা করা হয়, এর স্থায়িত্বকাল কত এবং কেন ও কীভাবে ব্লক
ও হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব; এসব বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: হার্টের রোগ বা হৃদরোগ কী, এই রোগ কেন হয়?
ডা.
বিমল ছাজেড়: হার্ট হচ্ছে মাল্টিফাংশনাল একটি সিস্টেম। এই হার্টে অনেকসময়
ব্লক তৈরি হয়। সেটা বাড়তে বাড়তে শতভাগ হয়ে গেলে ব্লকে পর্দা ছিড়ে যায় এবং
হার্ট অ্যাটাক হয়। হৃদরোগ হওয়ার চার-পাঁচটা বড় কারণ আছে। বিভিন্ন খাবারের
মাধ্যমে রক্তে অনেকসময় কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। আবার কারও শরীরে
জ্বিনগত কারণেও কোলেস্টেরল বেশি তৈরি হয়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি
থাকলে, সেটা ধীরে ধীরে হার্টের রক্তনালীতে জমে ব্লকেজ তৈরি করে। এছাড়া উচ্চ
রক্তচাপ (হাই ব্লাড পেশার), সুগার, ডায়বেটিস, ধূমপান, স্ট্রেস এবং
তেল-মাংসজাতীর খাবার ব্লকেজ বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: কেউ একজন হৃদরোগে আক্রান্ত কিনা, তা কীভাবে বোঝা যাবে?
ডা.
বিমল ছাজেড়: খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও শারীরিক অনুশীলনের অভাবে হার্টের
ব্লক বাড়তে থাকে। এটি ৭০ শতাংশের ওপরে গেলে বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে
ব্যথা অনুভব হবে। এছাড়া সিটি এনজিওগ্রামের মাধ্যমেও ব্লকের সঠিক মাত্রা
জানা যায়।
প্রশ্ন: হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে কেন?
ডা. বিমল ছাজেড়:
লাইফস্টাইলের অবনতি, খাবারে ফ্যাট বেড়ে যাওয়া এবং শারীরিক ব্যায়াম ও
পরিচর্যা কমে যাওয়া মূলত হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। এছাড়াও
অ্যালকোহল, ধূমপান, মানসিক চিন্তা ও অতিরিক্ত স্বাস্থ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে
দিন দিন হার্টের রোগী বাড়ছে। প্রচলিত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা ব্যবসায়িক
চিন্তা থেকে হার্টের রোগীদের অপারেশনের বিকল্প চিকিৎসা দিচ্ছেন না।
শরীর-বুক কাটা-ছেঁড়া করে রিং বাইপাস করানো স্থায়ী ও সুস্থ চিকিৎসা নয়।
প্রকৃতি থেকে সরে গেলে এবং আর্টিফিশিয়ালের ব্যবহার বাড়লে হৃদরোগের সংখ্যাও
বাড়তে থাকবে।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন, ‘বিনা রিং ও বিনা সার্জারিতে হৃদরোগের চিকিৎসা’, এটা কীভাবে সম্ভব?
ডা.
বিমল ছাজেড়: ভারতে সাওল হার্ট কেয়ার সেন্টারের ১৩৫টি ক্লিনিক আছে। সেখানে
আমরা চারটি ধাপে হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। প্রথমত, শিক্ষা-হৃদরোগের
সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান নিতে হবে। হৃদরোগ কী, কেন ও কীভাবে হয় এবং কী কী উপায়ে
প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায়। দ্বিতীয়ত অ্যালোপেথিক মেডিক্যাল কাভারÍ যার
শরীরে ক্লোরেস্টরল বেশি, জ্বিনগতভাবে হাইপেশার ও সুগার বেশি; তাদের
মেডিসিনের মাধ্যমে ব্লক পাতলা করা হয় এবং এনজাইনার বেশি থাকলে সেটাও
মেডিসিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর মাধ্যমে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে
আসতে থাকে। এটা আরও টেকসই করতে আরও দুটি চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। একটি
ন্যাচারাল বাইপাস, অপরটি ডিটক্স থেরাপি।
প্রশ্ন: সাওল চিকিৎসা পদ্ধতির খরচ কত, কীভাবে নেওয়া যাবে?
ডা.
বিমল ছাজেড়: যারা এরই মধ্যে খাবারে পরিবর্তন ও তেল বর্জন করেছেন এবং
নিয়মিত শারিরীক ব্যায়াম করে থাকেন। তাদের কোনও খরচ নেই। কিন্তু যাদের
হার্টের সমস্যা সিরিয়াস হয়ে গেছে। তারা সাওল সেন্টারে ৪০ দিনের কোর্সের
মাধ্যমে সর্বোচ ১ লাখ টাকা খরচে চিকিৎসা নিতে পারবেন। সাওল হার্ট সেন্টারে
বিনা অপারেশনে হার্টের বাইপাসের অত্যাধুনিক মেশিন, হার্ট ব্লকেজ ক্লিনিং
পদ্ধতি, রোগ নির্ণয়ের ডিজিটাল মেশিন সমন্বিত ল্যাবরেটরি, স্বাস্থ্যবান্ধব
অয়েল ফ্রি ক্যাফেটরিয়া, সুস্বাস্থ্যের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশনসহ আধুনিক
ফিটনেস সেন্টার, খাদ্যাভাস পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
প্রশ্ন: হৃদরোগ কীভাবে প্রতিরোধ হবে?
ডা.
বিমল ছাজেড়: তেলবিহীন খাবার ও নিয়মিত শারীরিক ব্যয়াম করতে হবে।
তেল-মশলাযুক্ত খাবার ক্ষণিকের জন্য মুখে দারুণ স্বাদ লাগলেও পরক্ষণে শরীরের
নানা সমস্যা সৃষ্টি করবে। শুধু তা-ই নয়, এসব তেল-মশলার খাবারে দীর্ঘমেয়াদি
প্রভাবও পড়ে মানুষের শরীরে। অস্বাস্থ্যকর তেল-মশলার খাবারের কারণে বেড়ে
যায় হার্টের পাশাপাশি ওজন বৃদ্ধি, কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হয়। সাওল পদ্ধতির
মাধ্যমে হার্টের চিকিৎসাসহ লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতি
ওজন, গ্যাস্ট্রিক, ক্যানসার, থাইরয়েড, হেপাটাইটিস, বাত, ডেঙ্গু ও টিবি
আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন: সাওল পদ্ধতিটিকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন আপনি। হার্টের এই নন-সার্জিকাল চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে আপনি কীভাবে যুক্ত হলেন?
ডা.
বিমল ছাজেড়: আমি এমবিবিএস শেষ করে ভারতের নয়াদিল্লির লখনৌ কিং জর্জ
মেডিক্যাল কলেজ থেকে হৃদরোগের চিকিৎসার ওপর এমডি ডিগ্রি অর্জন করি। এরপর
অপারেশন ছাড়া হৃদরোগীদের স্থায়ী চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা শুরু করি। পরে আমি
আমেরিকায় গিয়ে ড. ডিন অর্নিশের সঙ্গে কাজও করেছি। দেশে ফিরে এসে একটি
হাসপাতালে চাকরি করার সময় উপলব্ধি হলো- যেহেতু সার্জারি ছাড়াই হার্টের
স্থায়ী চিকিৎসা করা সম্ভব। অথচ হাসপাতালগুলো অর্থের লোভে রিং প্রতিস্থাপন,
বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টির দিকে ঝুঁকছে। অর্থের লোভে মানুষদের
প্রকৃতি থেকে আলাদা করছে এবং মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে পরবর্তী
সময়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সামাজিক আন্দোলনে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নেমে পড়ি। ‘সাওল
হার্ট কেয়ার সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু করেছি ‘বিনা
রিং, বিনা অপারেশনে হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার’। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশসহ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩২টি শাখা স্থাপন করা হয়েছে। সাওলের মাধ্যমে কয়েক
লাখ মানুষ এখন সুস্থ।
এরইমধ্যে এই প্রতিষ্ঠান থেকে লাখো হৃদরোগীর
চিকিৎসা করা হয়েছে এবং হার্ট অ্যাটাক, বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টি
থেকে মুক্ত থাকার জন্য রোগীদের সাহায্য করা হয়েছে। প্রতিকারমূলক
কার্ডিওলজিকে আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে এবং ইনভেসিভ কার্ডিওলজির ব্যাপক
ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমরা দুটি নন-ইনভেসিভ চিকিৎসা চালু করেছি। (বাংলা
ট্রিবিউনের সৌজন্যে)