৪৭ সিটের ১টি পরিবহনে যাতায়াত করে ১১০ জন শিক্ষার্থী : ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বাস ১৩টি : শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন- ৪৮ সিটের গাড়িতে ৮০ জন বা বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী আসে, আসতেই পারে!
কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ৪৭ আসন সংখ্যার একটি বাসে প্রতিদিন যাতায়াত করে
১০০ থেকে ১১০ জন শিক্ষার্থী। অতিরিক্ত শিক্ষার্থী পরিবহন ও তীব্র গরমের
কারনে হাঁসফাঁস অবস্থায়, কলেজে এসে অনেক শিক্ষার্থী হয়ে পড়েন অসুস্থ। এমন
অভিযোগ করেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ পরিবহনে যাতায়াতকারী
শিক্ষার্থীরা। সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী যাতায়াতের এ চিত্র নিত্যদিনের
বলে দাবি করেছে তারা। সকালে কলেজে আসার সময় এবং ক্লাস শেষে কলেজ থেকে বাসায়
যাওয়ার সময় প্রতিদিন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের।
গতকাল
সরেজমিনে কলেজে গিয়ে দেখা যায়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে
লাকসাম, বরুড়া, বি-পাড়া, বুড়িচং, চান্দিনা, গৌরিপুর, দেবিদ্বার সহ বিভিন্ন
রোডে যাতায়াত করা প্রায় সবকটি পরিবহনে ক্লাস শেষে ধারণ ক্ষমতার অধিক সংখ্যক
শিক্ষার্থী বহন করায়, কলেজ পরিবহনে বসার আসন না পেয়ে বাসের দরজা থেকে শেষ
পর্যন্ত বাসের মধ্যে থাকা রড ধরে, দাঁড়িয়ে ও চাপাচাপি করে বাড়ি ফিরছে
শিক্ষার্থীরা। ৪ থেকে ৫টি পরিবহনে মেয়ে শিক্ষার্থীদের বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে
কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার এমন চিত্র দেখা যায়। মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য দরজায়
দাঁড়িয়ে বাসায় পৌঁছানো ঝুকিঁপূর্ন হলেও, বাস সংকটে এভাবেই বাড়ি যেতে হচ্ছে
তাদের।
বরুড়া কলেজ বাসে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন,
আমাদের বরুড়া রোডে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১১০ জন শিক্ষার্থী কলেজ বাসে
আসা-যাওয়া করে। যার বেশি সংখ্যক মেয়ে শিক্ষার্থী। অনেক মেয়েরা বাসের মধ্যে
অসুস্থ হয়ে পড়ে। কলেজ বাসে জায়গা না পেয়ে অন্য পরিবহনে করে আরো ৪০ থেকে ৫০
জন শিক্ষার্থী কলেজে আসে। সমস্যাটা একদিনের না এটা প্রতিদিনের সমস্যা।
যেদিন পরীক্ষা থাকে না সেদিনও ৮০ থেকে ৯০ জন ছাত্র-ছাত্রী পরিবহনে আসে।
আমাদের দাবি একটাই আমরা বাস সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান চাই। আমরা কোনো
ভিআইপি পরিবহন চাই না। বর্তমানে যে লোকাল বাসটি দিয়ে আমরা কলেজে আসা-যাওয়া
করি, এই বাসটির খুব খারাপ অবস্থা। আমাদের এই বাসটি পরিবর্তন করে বড় একটি
বাস এবং আরও একটি নতুন বাস সংযোজন চাই।
চান্দিনা রোডে নিয়মিত কলেজ বাসে
যাতায়াতকারী ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ভর্তি
হওয়ার পর থেকে দেখছি কলেজ বাসের এমন বাজে অবস্থা। একটা বাসে সিট থাকে ৪৫টি
কিন্তু ৪৫ সিটের একটি বাসে আমরা ৯০ থেকে ৯৫ জন, কখনোও ১০৫ জন আসা-যাওয়া
করি। দাঁড়াইয়া কয়দিন যাওয়া-আসা করা যায়? কলেজ বাস না পেয়ে ভাড়ার কারনে অনেক
সময় কলেজ মিস দিতে হয়। বাসের ভিতরে শ্বাস ফেলার জায়গা নেই। বর্তমানে লোকাল
বাসগুলোও আরো উন্নত হইছে। ভর্তি ও ফরম পূরণের সময় আমাদের প্রত্যেক
শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরিবহনের জন্য ফি নেওয়া হয়। তারপরেও আমাদেরকে বাসে
দাঁড়াইয়া চাপাচাপি কইরা আসতে হয়। আমরা এই ভোগান্তি থেকে চিরস্থায়ী মুক্তি
চাই।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে কলেজ প্রশাসনের সাথে কথা
বলে জানা যায়, প্রতিবছর একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরিবহন ফি বাবত কাটা হয়
৬’শ টাকা করে। যার মধ্যে ভর্তির সময় কাটা হয় ৪’শ টাকা এবং ফরম পূরণের সময়
কাটা হয় ২’শ টাকা। কলেজের ওয়েব সাইট ও নিজস্ব অ্যাপসে দেওয়া তথ্য মতে,
অনার্স-মাস্টার্সের ২১টি বিষয় ও উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে বর্তমানে এ কলেজের মোট
শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৭ হাজার ৯৯৪ জন। যার মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক শাখার
শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার ৬২০ জন এবং অনার্স শাখার শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৫
হাজার ৩৭৪ জন। অনার্স ৪র্থ বর্ষ ও মাস্টার্সে অকৃতকার্য যেসব শিক্ষার্থী
পরবর্তীতে আবার ফরম পূরণ করে পরীক্ষায় অংশ নেয় তাদেরকে সহ বর্তমানে কলেজের
শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৯ হাজার।
সরকারি ছুটি বাদ দিয়ে এক বছরে কলেজ
পরিবহন চলাচল করে সর্বোচ্চ ১৮০ দিন এবং সর্বনি¤œ ১৬৫ দিন। কলেজের নিজস্ব
ওয়েবসাইটের দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী, দুই শাখার শিক্ষার্থীদের কাছ
থেকে পরিবহন ফি বাবত বার্ষিক কাটা হয় প্রায় ১ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা।
অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের হিসেব সহ বার্ষিক কাটা হয় ১ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা।
তবে পরিবহন ফি নিয়ে ভিন্ন তথ্যের কথাও জানান কলেজের সদ্য মাস্টার্স শেষ করা
অনেক শিক্ষার্থী। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, পরিবহন ফি বাবত প্রতি বছর কাটা হয়
৮’শ টাকা করে। যদিও এ তথ্য অস্বীকার করেছেন কলেজ পরিবহনের আহবায়ক রাজু
আহম্মদ।
পরিবহনের এ অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবহন ফি বাবত প্রত্যেক
শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি বছর ৬’শ টাকা করে কাটা হয়। পরিবহনের সংকট নিয়ে
তিনি বলেন, পরীক্ষা থাকাকালীন দিনগুলোতে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজ
পরিবহনে যাতায়াত করার ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে এমন চিত্র দেখা যায়
দু’একটি পরিবহনে। আগামী রবিবার থেকে লাকসাম রোডে আমাদের আরো একটি বাস
সংযুক্ত হচ্ছে। যেসব রোডের পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে আমরা লিখিত অভিযোগ পাওয়া
মাত্রই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করছি। তবে কলেজ প্রশাসনের সক্ষমতার কথাও
শিক্ষার্থীদের ভাবা উচিৎ। পরিবহন বাড়ালে খরচ বাড়বে। আর খরচ বাড়াতে হলে
শিক্ষার্থীদের ফি বাড়াতে হবে। কিন্তু ফি বাড়ালেতো আবার এটা নিয়ে প্রশ্ন
উঠবে। পরিবহন সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী চেষ্টা
করছি।
প্রাচীন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ১২৫ বছর যাবৎ এ
অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে স্ব-গৌরবে। কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলার
পাশাপাশি এ জেলার আশেপাশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও জ্ঞান আহরণ করতে
শিক্ষার্থীরা আসে গৌরবোজ্জল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। কলেজের
উচ্চমাধ্যমিক ও অনার্স শাখার বিভিন্ন বিভাগে নিয়মিত ক্লাস করা
শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্যনুযায়ী, কলেজে নিয়মিত ক্লাস করে প্রায় ৮ থেকে ১০
হাজার শিক্ষার্থী। যাদের বেশি সংখ্যক আসেন আশেপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা
থেকে। কলেজ পরিবহন সংকটের কারনে পরিবহন ফি দেওয়ার পরেও প্রতিদিন কলেজে আগত
শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী যাতায়াত করে সিএনজি, বাস সহ
ভিন্ন ভিন্ন পরিবহনে। যার মধ্যে কলেজ পরিবহনে যাতায়াত করতে পারে কেবল ১০
থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা কলেজের হল ও কলেজের আশেপাশের বিভিন্ন মেস
থেকে আসা-যাওয়া করে।
শিক্ষার্থীদের দেওয়া পরিবহন ফির টাকা দিয়েই চলে
কলেজের নিজস্ব ১টি বাস সহ মোট ১৩টি বাস। এছাড়া কলেজের নিজস্ব ৩টি মাইক্রো
বাসও (প্রিন্সিপাল, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষক পরিষদের সম্পাদকের ব্যবহৃত) চলে
শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে। কলেজের ১৩টি পরিবহনের মোট আসন সংখ্যা প্রায় ৬’শ।
শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য মতে, ৬’শ আসনে আসা-যাওয়া করে ১১’শ থেকে ১২’শ জন
শিক্ষার্থী। এছাড়া নানান সময়ে কলেজ বাসে আসন না পেয়ে লোকাল বাসে যাতায়াত
করার সময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় সহ হরেক রকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়
ছাত্র-ছাত্রীদের। এমতাবস্থায় বিভিন্ন রোডে প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন পরিবহন
সংযোজনের দাবি শিক্ষার্থীদের। পরিবহন সংকটের এ সমস্যা সমাধানে যথাযথ
কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন,
বেশি সংখ্যক মেয়ে শিক্ষার্থী কলেজে যাতায়াত করার ফলে বাসে ভিড় বেড়েছে। এ
সমস্যাটা সাময়িক সময়ের। বিশেষ করে যখন পরীক্ষা থাকে তখন এ সমস্যা দেখা যায়।
তবে আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থীরা শতষ্ফূর্তভাবে কলেজে আসছে এটি একটি ভালো
দিক। আমাদের পরবর্তী একাডেমিক কাউন্সিলে পরিবহন সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা গ্রহনের প্রস্তাব আনা হবে।
পরিবহন ব্যবস্থার সংকট নিয়ে
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দীর্ঘদিনের।
সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েক ধাপে নতুন বাস সংযোজন করা হলেও স্বস্তির দেখা
মিলেনি এখনও। তবে দাবি আদায় না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে এভাবেই যাতায়াত করে
কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব সংকটে পড়ালেখায় বিঘœ ঘটছে শিক্ষার্থীদের।
ক্রমশ মেধাবী শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে অনিয়মিত। তবে শিক্ষার্থীদের বাস সমস্যা
সমাধানে কলেজ প্রশাসন উদাসীন নয় বরং দ্রুত সময়ের মধ্যে সংকট সমাধানের
প্রক্রিয়া চালাবে এমনটাই মন্তব্য করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ।
পরিবহন সংকটের
বিষয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু জাফর খান বলেন,
৪৮ সিটের গাড়িতে ৮০ জন বা বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী আসে, আসতেই পারে। কোনোদিন
পরীক্ষা থাকে ভিড় বেশি হয়। আবার কোনোদিন সিট পরিপূর্ন হয় না। একেকদিন একেক
রকম হয়। তবে আমরাতো সবসময় শিক্ষার্থীদের কল্যানেই কাজ করি। তাদের সমস্যা
হলে তা সমাধানের ব্যবস্থাও গ্রহন করা হবে। আমরা কলেজের উন্নয়নে অনেক কাজ
করেছি যেগুলো দৃশ্যমান। আগে ৮টি পরিবহন ছিল এখন ১৩টি। রবিবারে আরও ১টি
বাড়বে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সুবিধার কথা চিন্তা করেইতো আমরা পরিবহন
বাড়িয়েছি। শিক্ষার্থী ও কলেজের উন্নয়নে যা যা করা লাগে আমরা করবো
ইনশাল্লাহ।