গাছ বাঁচলে
মানুষ বাঁচবে। দুইজন মানুষের বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস -অক্সিজেনের যোগান দেয়
একটি মাত্র গাছ। একগাছ দুইজন মানুষকে জীবিত রাখার দায়িত্ব পালন করছে। তাই
বলা হচ্ছে, গাছ কাটা মানুষ হত্যার চাইতেও ভয়াবহ। দিন দিনই ধ্বংস হচ্ছে গাছ।
গাছের অভাবে ধ্বংসের মুখে পৃথিবী। কাজে- অকাজে যখন- তখন গাছ কাটার ফলে
পরিবেশ দিন দিনই গরম হয়ে উঠছে। লম্বা সময় ধরে গাছ কাটা, বন উজাড়ে অসহ্য গরম
- দাবদাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফল ভোগ করতে শুরু করেছে দেশের মানুষ।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস এসবই বন উজাড়ের কুফল।
গত ১৪ মাসে সড়কসহ নানা
উন্নয়নে সাড়ে ১১ লাখ গাছ কেটেছে সরকারি নানা সংস্থা। পত্রিকার সংবাদের
ভিত্তিতে এটা বেসরকারি এক হিসাব। ধারনা প্রকৃত সংখ্যা তিনগুণ বেশি। গাছের
রক্ষক বনবিভাগই সবচেয়ে বেশি গাছ কেটেছে। সাথে আরও ২৪ টি সরকারি
প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে চট্টগ্রামে, এরপর
নীলফামারী, কক্সবাজার, রংপুরে। এই মিছিলে আরও আছে ঢাকার ধানমন্ডি ও
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
গাছ বাঁচাতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেয়
প্রতিবেশী ভারত। ২০১৯ এ চেন্নাইতে বেসরকারি চেষ্টায় চালু করা হয় গাছের
অ্যাম্বুলেন্স, পৃথিবীকে বাঁচানোর দৃষ্টিভঙ্গি- গাছ বাঁচিয়ে রাখা। এই
উদ্যোগের প্রস্তাবক চেন্নাইয়ের পরিবেশবিদ কে আব্দুল গণি। যিনি ভারতের 'সবুজ
মানুষ' নামে পরিচিত। যিনি নিজ দেশে চল্লিশ লাখ গাছ লাগিয়েছেন। জরুরিসহ সব
অবস্থায় সেবা পাবে গাছও।
দেশে নির্মাণ বা সড়ক উন্নয়নে গাছ কেটে ফেলা
হচ্ছে পাইকারি হারে। অ্যাম্বুলেন্স সেবা ওই গাছ তুলে নিয়ে নতুন করে মাটিতে
পোঁতার ব্যবস্থা করবে-স্থানান্তর, নতুন জায়গায় লাগাবে। অসুস্থ গাছের
পরিচর্যা, ঝড়- বাদলে মাটি থেকে উপড়ে যাওয়া গাছকে যথাস্থানে রোপণে এই
অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা দ্রুত কাজ করে। তাছাড়া গাছের চারা একস্থান থেকে
অন্যস্থানে পৌঁছে দেয়া, বৃক্ষরোপণের গতি বাড়াতে- সচেতনতা ও সাহায্য,
প্রয়োজনে বৃক্ষপ্রেমিদের দুয়ারে পৌঁছে যাওয়া। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে গাছের
পরিচর্যা, বিজ্ঞান সম্মত গাছ কাটার পদ্ধতি, বিভিন্ন অসুস্থতার চিকিৎসা
পদ্ধতি জানতে পারেন আগ্রহীরা। এই অ্যাম্বুলেন্স স্কুল- কলেজে পড়ুয়াদের গাছ
সম্পর্কে সচেতন করতেও কাজ করছে। অ্যাম্বুলেন্সে থাকে বিভিন্ন ওষুধ, স্প্রে,
গাছের বীজ, সার- যাতে আগ্রহীরা অ্যাম্বুলেন্স থেকেই এসব সংগ্রহ করতে
পারেন। পাওয়া যাবে বাগান করার সরঞ্জামও। বিভিন্ন এলাকায় গাছের শরীর ক্ষত
করে ব্যানার, ফেস্টুন থাকলে তা খুলে দিয়ে পরিচর্যা করা, কোন গাছ মারা গেলে,
তার অংশগুলো ঠিক জায়গায় পৌঁছেও দেয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সেই থাকবেন দক্ষ
মালি ও গাছকর্মীরা। তাদের সাথে থাকবে বাগান করার ঝুড়ি, খুপরি, দা, শাবল,মই
ইত্যাদি। আছে হেল্পলাইনে ফোন করে সেবা নেয়ার সুযোগও। শুধু প্রাকৃতিক
বিপর্যয়ে উপড়ে যাওয়াই নয়, গাছের কারণে সমস্যায় পড়ছেন পথচারী বা শহরবাসী,
গাছকে মরতে হবে না- কেটে ফেলা নয়, যতেœ সরিয়ে অন্যত্র জীবন রক্ষা করা হবে।
চেন্নাইয়ের
এমন বেসরকারি উদ্যোগ মডেল হিসেবে বাস্তবায়ন করছে ভারতের রাজ্য সরকারের
বনদফতর। গেল সাড়ে চার বছরে এই উদ্যোগ ছড়িয়েছে দিল্লি, কোলকাতায়ও। আমরাও
অনুকরণ- অনুসরণ করতে পারি। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এমন উদ্যোগ নিতে পারে।
তার লোকবল, অ্যাম্বুলেন্স বানাতে নতুন বা পুরনো ট্রাক সবই আছে। কুমিল্লা
শুরু করলে হয়তো দেশের অন্যান্য জায়গায়ও শুরু হবে। সিটি কর্পোরেশন নিজেও
গাছ কাটে। এতে সিটি এলাকায় গাছ কাটা বন্ধ হবে। সুরক্ষা পাবে গাছ। পরিবেশ-
প্রতিবেশ সুস্থ থাকবে। সবুজায়ন ঘটবে, দেখতেও সুন্দর লাগবে।
তীব্র
দাবদাহে এবার আমরা দেশে ভারতের স্কুলে চালু করা দুই ঘন্টা পর পর পানি
খাওয়ার 'পানিঘন্টা' অনুকরণ করে সুফল পেয়েছি। স্থানীয় প্রশাসনও এমন চর্চায়
বেশ মনোযোগী ছিল। সংকট সমাধানে বেশ কার্যকর ছিল এমন মডেল- ব্যবস্থা।
আমাদের
সরকারি বনবিভাগ নিজেই নেমেছে গাছ নিধনযজ্ঞে। উন্নয়ন আর জনস্বার্থের কথা
বলেই গাছ কাটা চলছে। উন্নয়নতো লাগবে, তবে তা কোন ভাবেই পরিবেশ ও প্রাণ-
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়। উপরন্তু দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক বনায়নে গাছ
রোপণের ২০ বছর পর কেটে বিক্রি করার নিয়ম- বিধান রয়েছে। যার লভ্যাংশ
বনবিভাগ, উপকারভোগী, ভূমি মালিক, ইউনিয়ন পরিষদ, ভবিষ্যতে আবার গাছ লাগানো
তহবিল সবাই পায়। সামাজিক বনায়নের অর্থনৈতিক সুফল ভোগ করে এর সাথে সম্পৃক্ত
মানুষ। কিন্তু গাছের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সুফল ভোগ করে সবাই। ২০ বছরের
পুরনো গাছ কেটে ফেলা হলেও, সে অবস্থায় আমাদের আবার ফিরে আসতে ২০ বছর
অপেক্ষা করতে হবে। যদিও বলা হচ্ছে কাটার চাইতে বেশি গাছ লাগানো হচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় এতে সহজে সুফল মিলছে না। তাই সামাজিক বনায়ন বিধিমালার
গাছ কাটার নিয়ম পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিচর্যা বা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা
উপকারভোগী যে লভ্যাংশ পেত তা রাষ্ট্র গাছ না কেটেও অন্যভাবে সুবিধা দিতে
পারে, বিকল্প ভাবতে হবে। ব্যক্তিমালিকানার একটি বড় গাছ কেটে ১০ হাজার টাকা
পাওয়া যাবে, এমন প্রয়োজন কিভাবে মেটানো যায় তাও ভেবে দেখা দরকার সরকারের। এ
বছর বর্ষা মৌসুমে সারাদেশে সরকারি ভাবে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ২৭ হাজার চারা রোপণ
করা হবে। প্রতিবছর গাছ কাটা, চারা লাগানো, বনায়ন, ধ্বংসযজ্ঞ এসবের
পরিসংখ্যান আছে কিন্তু নেই সঠিক- সুনির্দিষ্ট হিসাব।
বাংলাদেশ বন আইন
আছে। গাছ কাটা যাবে না, কাটলে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণের একটি আইন মন্ত্রী
পরিষদ অনুমোদন করে ২০১৬ সালে। সংসদে পাশের জন্যে গেলে আলাদা আইন প্রয়োজন
নেই বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপর আর উদ্যোগ নেয়া হয় নি। বিদ্যমান বন আইনের
অধীনে বিধিমালা করেও গাছ কাটা বন্ধ করা যায়। ২০২৩ সালে মন্ত্রী পরিষদ
নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত কেউ অনুমতি ছাড়া কোন গাছ কাটতে
পারবে না। একটি গাছ কাটা হলে তার বদলে একাধিক গাছ লাগানোরও উচ্চ আদালতের
নির্দেশনা রয়েছে। তবে এইসব সিদ্ধান্ত মানছে না কেউ। গাছ কাটা বন্ধ ও গাছ
সংরক্ষণে কোন সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই। আছে পরিবেশ বিরোধী কিছু
কাজ- প্রকল্পের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞাও আবার অধিকাংশই
সাময়িক সময়ের জন্য। আইন না থাকায় গাছ কাটা নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদালত
নিষেধাজ্ঞায়ই সীমাবদ্ধ। পরিবেশবাদীরা মনে করেন গাছ কাটাও অপরাধ, এর বিচার
হওয়া উচিত।
দেশে গাছ ও বন খাতে কার্বনের পরিমান নির্ণয়ে এবছর জাতীয় বন
জরিপ শুরু হয়েছে, এটা ভালো উদ্যোগ। উপকূলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হচ্ছে
২০০৯ থেকে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বৃক্ষাচ্ছাদীত মোট ভূমির ২২ দশমিক ৩৭
ভাগ থেকে ২৫ ভাগে এবং বনাচ্ছাদনের পরিমাণ ১৪ দশমিক এক ভাগ হতে ১৬ ভাগে
উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। অন্য মত হলো ২৫ ভাগ বন থাকার কথা
থাকলেও দেশে সাকুল্যে বনাঞ্চল আছে মাত্র ৮ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-
বৈশ্বিক উষ্ণতা থেকে রক্ষায় গাছ বাঁচানোর বিকল্প নেই।
পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।