বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো দুর্বল। তবে গত কয়েক বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য রয়েছে অনেক। আবার যাঁরা নন-এমপিও, তাঁরা প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন পান চাহিদার তুলনায় খুবই কম। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের দায়িত্ব বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে তাঁদের বেতন-ভাতা সুযোগ সুবিধা বাড়ানো দরকার ও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সকল শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শুধু মাত্র শিক্ষার অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়লেই কিন্তু গুণগত মানের শিক্ষার উন্নয়ন হবে না। শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন, মান-মর্যাদা ও বেতন- তিনটিই সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা যদি ভুটানের দিকে তাকাই, তারা চিকিৎসক ও শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়। কোরিয়া, হংকং, জাপানে শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামো। এর ফল কিন্তু তারা পাচ্ছে। আমাদেরও স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হলে শিক্ষকদের মর্যাদা আরো বাড়াতে হবে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রথমে মাসিক বেতন প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৩৫ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৭ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৩ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৬৩ হাজার টাকা। মাধ্যমিকে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রথমে বেতন ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৪০ হাজার টাকা, পাকিস্তানে ৩০ হাজার টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩২ হাজার টাকা, নেপালে ৩৫ হাজার টাকা, ভুটানে ৩৯ হাজার টাকা ও মালদ্বীপে ৯০ হাজার টাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেতন- ভাতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেশ পিছিয়ে। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে। গত ১৫ বছরে সরকার একাধিকবার শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন করে শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কয়েক হাজার নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। প্রথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড কয়েক ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। এর পরও অন্যান্য দেশের তুলনায় বেতন-ভাতা ও মর্যাদার দিক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষকরা পিছিয়ে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা পান। শুধু প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে জাতীয় বেতন স্কেলের শুধু মূল বেতন পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি। মূলত এগুলো এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে কর্মরত প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। সরকার সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেডের সমপরিমাণ মূল বেতন দেয়। সেখানে তাঁদের ১৬ হাজার টাকা স্কেলে বেতন শুরু হয়। এর বাইরে তাঁরা বাড়ি ভাড়া বাবদ মাসে এক হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা বাবদ মাসে ৫০০ টাকা পান। সেই হিসাবে শুরুতে একজন শিক্ষক সরকারি ভাতা ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পান। এর বাইরে যেসব স্কুলের আয় আছে, তারা ফান্ড থেকেও কিছু টাকা শিক্ষকদের দেয়। তবে সব স্কুল তা দিতে পারে না । এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। তবে স্কুলের কর্মচারীরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া তাঁরা সরকারি কর্মচারীদের মতো বৈশাখী ভাতা পান। তবে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যাঁরা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে যোগ দেন, তাঁরা শুরুতেই দশম গ্রেডে প্রায় ২৬ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তাঁরা সন্তানদের পড়ালেখার জন্য ভাতা পান। পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ নানা ধরনের সুবিধা পান। তবে সরকারি বা এমপিওভুক্ত উভয় ধরনের স্কুলেই শিক্ষকরা উচ্চতর গ্রেড বিএড সম্পন্ন হলে আলাদা ইনক্রিমেন্ট পান, তাঁদের বেতনও কিছুটা বাড়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে বেসরকারি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান (এমপিওভুক্ত) প্রায় ১৮৯৬৮ টি, সরকারি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান ৬৮৪ টি। বেসরকারি কলেজ (এমপিওভুক্ত) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩৩৪১ টি, সরকারি কলেজ ৬৩৭ টি। এই পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যায় সরকারি শিক্ষকদের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের পরিমাণ অনেক বেশি। সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বেসরকারি শিক্ষকদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে।
বর্তমানে আর্থিক সুযোগ সুবিধার সমস্যায় আমাদের শিক্ষকতা পেশা কিন্তু দিন দিন কারো কারো ক্ষেত্রে বিপদের চাকরী হয়ে পড়ছে। অনেকে অন্য কোনো চাকরি পেলে শিক্ষকতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এখনও এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি। অনেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েও শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর মূল কারণ বেশিরভাগ শিক্ষকদের মানবতার জীবন যাপন করা। এত স্বল্প টাকা বেতন পেয়ে কোনোভাবেই তাঁরা চলতে পারছেন না। আমরা এখন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। এই সময়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার উন্নয়ন সবার আগে জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে। সেখানে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের প্রস্তাব করা হলেও, তা বাস্তবায়নে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
’শিক্ষা উন্নয়নের আগে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি তাঁদের বেতন-ভাতাও সম্মানজনক হতে হবে। নয়তো মেধাবীরা আগামীতে শিক্ষকতায় আসবেন না।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ , কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।