বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪
৭ কার্তিক ১৪৩১
বন্যা মোকাবিলায় প্রকৃতি-নির্ভর সমাধান কেন জরুরি?
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
প্রকাশ: সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪, ১২:২৯ এএম |



বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে বন্যা মিশে আছে। প্লাবনের মধ্যেই এই দেশের মানুষের বসবাস। দেশের মোট ভূমির প্রায় ৮০ শতাংশকে প্লাবনভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ প্লাবিত হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি সাধিত হয়।
১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এবং মোট ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল। ২০২২ সালের বন্যায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল এবং ৭.৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তবে এদেশের কৃষকদের জীবনজীবিকা বন্যার সাথে গড়ে ওঠায় বন্যাকে তারা ভয় পায় না। কৃষিকাজের সুবিধার জন্য বাংলাদেশের কৃষকরা যে কৃষি সূচি মেনে চলতো তা এখানকার আবহাওয়া উপযোগী এবং বিভিন্ন ঋতুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তৈরি করা। তারা জানতো কখন কীভাবে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে এবং কৃষিকে চলমান রাখতে হবে।
কৃষি জমি বন্যায় প্লাবিত হলেও কৃষকরা শঙ্কিত হতো না। তারা জানত যে বন্যার সাথে যে পলি আসবে তা তাদের কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে যার ফলশ্রুতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই কারণে বন্যার সাথে জীবন যাপনে তারা অভ্যস্ত ছিল। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকা- এবং সমন্বয়হীন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ভূমিরূপের পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশের কৃষকরা এখন আর তাদের সেই কৃষি সূচি মেনে চলতে পারছে না। কারণ এখন ষড়ঋতুর দেখা মেলা দায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ায় বৃষ্টিপাতের ধরণ ও সময় বদলে গেছে। এখন আর প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথাসময়ে ঋতুর আবির্ভাব ঘটছে না এবং ঋতুর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া বিলম্বিত হচ্ছে শীত ও বর্ষার আগমন অথবা অসময়ে ভারী বর্ষণ কিংবা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে আমরা কয়েক ধরনের বন্যা লক্ষ্য করি যার কোনোটি পাহাড়ি ঢলের বন্যা, কোনোটি উজান থেকে আসা বা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে আসা বা হঠাৎ বন্যা বা ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড বলা হয়, অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা, উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাসের কারণে বন্যা, নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হওয়ার বন্যা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাগুলো প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্তÍপ্রথমত, মৌসুমি বন্যা (সড়হংড়ড়হ ভষড়ড়ফ)Íএই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে; খ) আকস্মিক বন্যা (ভষধংয ভষড়ড়ফ)Íআকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয়; এবং গ) জোয়ারসৃষ্ট বন্যা (ঃরফধষ ভষড়ড়ফ)Íসংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূ-ভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে।
বর্তমান সময়ের এই বন্যাগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, একবার প্লাবিত হলে প্রায় মাসব্যাপী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে। ফলে আগে যেমন প্রাকৃতিকভাবেই খুব দ্রুত বন্যার পানি নেমে যেত এবং তিন থেকে সাত দিনের মধ্যেই কৃষকদের পলি জমে একটি উর্বর জমি উপহার দিত এখন তা আর দেখা যায় না। বন্যার সঙ্গে আসা পলি আমাদের মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়।
বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিপ্রবাহ এবং পলি পড়ার ধরণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এখানে একেক নদীর পলির ধরণ আলাদা। যেমন সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোয় যে মাছ ও উদ্ভিদ জন্মায়, যা পদ্মা বা মেঘনায় দেখা যায় না। কারণ, একেকটি নদীর প্রবাহ একেকটি পাহাড় থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সেই জায়গার মাটির ধরণ এবং পানিতে থাকা খনিজ পদার্থের পরিমাণের ক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। ফলে বন্যার সঙ্গে এসব প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর পদার্থ পানি ও পলির সঙ্গে এখানে আসে।
তবে এখন উজান থেকে আসা পলির পরিমাণ কমে গিয়েছে। শুকনো মৌসুমে নদীগুলোর পানি পরিবহনক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে পলিগুলো তলদেশে জমা হয়ে ভরাট করে ফেলছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পাড়ের ভাঙন বাড়ছে। আবার নদী অববাহিকায় দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত মাটির নিচে যেতে পারছে না। পানি ভূখ- ধুয়ে আসা পলি নিয়ে দ্রুত নদীতে পড়ছে। এতে নদীতে পলি পড়ে তলদেশ উঁচু করে ফেলছে। ফলে নদীর বিভিন্ন স্থানে চর পড়ে চ্যানেল তৈরি হচ্ছে। নদীর স্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা পাচ্ছে। ফলে দ্রুত পানি বেড়ে বসতি এলাকায় প্রবেশ করছে।
বন্যা বলতেই এখন বন্যা পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। আর এই বন্যাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের যে রক্ষাকবচ বাঁধগুলো আছে তা ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি কমে গেলে বা উজান থেকে আসা পানি কমে গেলে এবং নদীর পানি কমে যাওয়ার পরও প্লাবিত যে ভূমি রয়েছে অর্থাৎ যে জায়গায় বন্যা হয়েছে সেইখানে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ ধারণ করে কিংবা দীর্ঘস্থায়ীভাবে অবস্থান করে।
দীর্ঘস্থায়ী জলোচ্ছ্বাস আমাদের বেশি ভোগান্তি দিচ্ছে। এখন এই জলোচ্ছ্বাস বা দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা না হয়ে প্রাকৃতিকভাবেই যদি আমাদের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকত তাহলে এই পানি হঠাৎ করে যেভাবে এসেছে সেইভাবেই আস্তে আস্তে নেমে যেত। কিন্তু বাঁধ ভেঙে এই পানি প্লাবিত হওয়ার কারণে এগুলো সহজে নিচে নেমে যায় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বাঁধ আমাদের কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না।
বাংলাদেশে কাপ্তাই বাঁধ, তিস্তা বাঁধ, বুড়ি তিস্তা বাঁধ, টাঙ্গন বাঁধ, মনু বাঁধ, বাকল্যান্ড বাঁধ, পদ্মা বাঁধ ইত্যাদি বড় বড় বাঁধ ছাড়াও নদীগুলোয় ছোট-বড় আরও অনেক বাঁধ রয়েছে। এইসব বাঁধের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো বাঁধ হলো বুড়ি তিস্তা বাঁধ যার নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১-৬২ সালের দিকে এবং শেষ হয় ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে।
তবে এখন এই বাঁধগুলো নিয়ে আমাদের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রণয়ন বা এদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলেও নানা রকমের দুর্নীতির কারণে এই বাঁধগুলো সত্যিকার অর্থে আমাদের রক্ষাকবচ না হয়ে আমাদের দুঃস্বপ্নের একটি কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেশব্যাপী।
বাঁধ নির্মাণে টেকসই পদ্ধতি ও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার না করা, প্রকৃতিকে প্রাধান্য না দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা, বাঁধের নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতি এবং দুর্যোগের সময় এই বাঁধ আমাদের রক্ষা করতে না পারা আজকে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্যোগ ঝুঁকি তৈরি করছে। বাঁধের সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়। বাঁধের উজানে স্বাভাবিকভাবেই একটি স্থলজ বাস্তুসংস্থান ছিল। তা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে একটি কৃত্রিম জলজ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয়। এতে করে অনেক প্রজাতির প্রাণী ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। বাঁধের কারণে বহু প্রজাতির মাছের অভিবাসন সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বন্যা ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প খরচের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বাঁধকে কখনোই বন্যা ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান হিসেবে ধরা যাবে না বরং বাঁধের বিকল্প কোনো পরিবেশবান্ধব ও প্রকৃতি নির্ভর টেকসই সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর তার জন্য অবশ্যই গবেষণার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের গবেষকগণ গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান প্রদানে সক্ষম। তাদের পরামর্শ নিয়ে এবং স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বন্যা ব্যবস্থাপনা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই আমাদের জরুরি ভিত্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণে টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রধান নদী ও শাখানদীগুলোর মুখ খনন করে দিতে হবে, যাতে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে। নদীর তলদেশ খনন করে দিতে হবে যাতে পানি বেশি পরিমাণে দ্রুত সাগরে চলে যেতে পারে। নদীর মুখ বন্ধ করে রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ করা যাবেনা। নদীর উৎসস্থলে ও অববাহিকায় ব্যাপক ঘন অরণ্য সৃষ্টি করে বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে প্রবাহিত হওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। সর্বোপরি সবাইকে বন্যা নিয়ন্ত্রণে ও প্রকৃতি রক্ষায় সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ














সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা সিটির ‘বঞ্চিত’ অপসারিত কাউন্সিলরদের পুনর্বহালের দাবি
বঙ্গভবনের সামনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
ধর্মপুর-সাতরার রাস্তার সংস্কার কাজ উদ্বোধন করেন জামায়াতের কুমিল্লা মহানগর সেক্রেটারি অধ্যাপক এমদাদুল হক মামুন
বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ ঢুকে পরার চেষ্টা, বাধা
কুমিল্লা নগরীর ২৭ হাজার কিশোরী পাবে বিনামূল্যে এইচপিভি টিকা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানববন্ধন
সুমি জুয়েলার্সের ২৭তম বর্ষপূর্তি উদযাপন
বঙ্গভবনের সামনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
বঙ্গভবনের সামনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
বুড়িচংয়ের আলোচিত আদনান হায়দারসহ গ্রেপ্তার ২
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২