বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪
১৪ কার্তিক ১৪৩১
পল্লীচিন্তা ও পল্লীউন্নয়ন
আখতার হামিদ খানের ১১০ তম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধার্ঘ
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০২৪, ১২:০০ এএম |

 পল্লীচিন্তা ও পল্লীউন্নয়ন


পল্লীসংগঠনের কথা আজকাল নানাজনের মুখে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেই চিন্তায় একটা অস্বচ্ছতা থেকে গেছে। এ নিয়ে পুনর্বিচার প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের কাছে পল্লী পুনর্গঠনের দুটি উপায় রয়েছে Ñ(১) সরকারি এবং দলীয় ব্যবস্থার সহায়তায় পল্লী পুনর্গঠন, (২) পল্লী সংগঠন চিনাতার সঙ্গে যুক্ত করে পল্লী পুর্নগঠনের প্রচেষ্টা। এই দুটি পথ পরিপূরক হতে পারে কিন্তু এক নয়, এটা পরিষ্কার করে জেনে নেওয়া দরকার। অতঃপর আমাদের বিচার করতে হবে কোনটা শ্রেয় ?
পুরনো বিপ্লবী চিন্তায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার লড়াইকে প্রাথমিকতা দেওয়া হয়েছিল। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিল প্রাধান্য। এই ঝোঁকটা আছে আজকের রাজনীতিতেও আখতার হামিদ খানের চিন্তার অবস্থান অনেকাংশে এর বিপরীত মেরুতে।
আখতার হামিদ খান মনে করতেন পল্লী সংগঠনের প্রতিষ্ঠায় সরকারের উপর যত কম নির্ভর করা যায় ততই ভাল। আখতার হামিদ খান বলেছেন, “সরকারের ক্ষমতাবৃদ্ধিটাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি।” (ইবহমধষ জবসরহধহপবং: অশযঃধৎ ঐধসববফ কযধহ) যথাসম্ভব সরকারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আমরা পল্লী সংগঠন করব, গ্রাম সংগঠনের ভিত্তি মজবুত করব। এই জায়গায় আখতার হামিদ খান (১৯১৪-১৯৯৯) চিন্তার সাথে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার একটা স্পষ্ট ও আশ্চর্য মিল রয়েছে। “রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত”  নামক প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রতন্ত্র গড়ে উঠেছে, সেখানে ক্ষমতা সমাজের হাতে না থেকে রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতার বিচার থেকে বোঝা যায় যে, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই একই অবস্থা। রবীন্দ্র-ভাবনায় এই অবস্থা ক্ষতিকারক। সমাজ যদি রাষ্ট্রের উপর অতি নির্ভরশীল হতে শেখে তবে মুক্ত সমাজ গঠিত হতে পারে না। তখন সাধারণ মানুষ খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া মানে শেষ পর্যন্ত অল্প কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। বেড়ে ওঠে আমলাতন্ত্র। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র ও দলীয় আমলাতন্ত্র হাত ধরাধরি করে চলে। রাষ্ট্রের কিছু বিশেষ কর্তব্য স্বীকার্য। তাতে ত্রুটি  ঘটলে ন্যায়সঙ্গত সমালোচনা নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু রাষ্ট্রের ওপার অতিনির্ভরতার অভ্যাস ভাল নয়। এতে আমলাতন্ত্র প্রবল হয়, সমাজ দুর্বল হয়। 
সমাজের হাতে ক্ষমতা াখতে গেলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। আর বিকেন্দ্রিত ক্ষমতার উৎস হবে গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ পল্লী সংগঠনের কথা বলেছেন। আখতার হামিদ খান পল্লী সংগঠনের কথা বলেছেন। যাই হোক, চিন্তাটা মূলত বিকেন্দ্রীকরণ সম্বন্ধে। গ্রামের জনগণ নিজেদের সমবায়িক চেষ্টায় পল্লী সংগঠনের কাজ করবে।
এখন এই ধরনের গ্রাম বা পল্লী, যেটা রাষ্ট্রের উপর অধিক নির্ভরশলীল নয়, সেটা বাস্তবে গঠন করা সম্ভব কি না সে বিষয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ দেখা দেয়। নগরবাসী মানুষ রাষ্ট্রোর উপর নির্ভরশীল হওয়ার ব্যাপারে এতই অভ্যস্ত যে বিকল্প ব্যবস্থা তাদের কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু একটু সহজভাবে ভাবলেই বুঝতে পারা যায় যে এটা মোটেই অবাস্তব নয়। আখতার হামিদ খান বা রবীন্দ্রনাথ কেউই রাষ্ট্র বা নগর তুলে দেওয়ার কথা বলেননি। আখতার হামিদ খান বলেছেন গ্রাম ও নগরের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা থাকবে। বিশ্বমুখিতাকে বিসর্জন না দিয়েও পল্লী বা গ্রাম যতদুর সম্ভব আত্মনির্ভর হতে একথাই তাঁরা ভেবেছেন। অর্থাৎ আবশ্যক বস্তুগুলির উৎপাদনে গ্রাম সক্ষম হবে। আমাদের আবশ্যক বস্তুগুলি কী কী ? খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। প্রসঙ্গত বলা যায়, যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুই গ্রামে তৈরি হবে এমন ভাবা যায় না, তবে প্রধান প্রধান প্রয়োজনীয় বা অতি আবশ্যক বস্তুগুলি গ্রামেই তৈরি হবে। এই ক্ষেত্রে নাগরিকদের অভিজ্ঞতা আর যাঁরা গ্রামে বাস করেন তাঁদের অভিজ্ঞতা দুই প্রান্তে। গ্রামের লোকেরা নিজেরা নিজেদের ঘর-বাড়ি তৈরি করনে, তা বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার জন্য নয়, তবে শহরে অন্য ব্যাপার। গ্রাম খাদ্যের ব্যাপারে স্বনির্ভর হবে এটাই তো স্বাভাবিক, এতে সন্দেহের কিছুই নেই। গ্রাম থেকেই তো উদ্বৃত্ত খাদ্য নগরে জোগান যায়। আখতার হামিদ খান বলেছেন গ্রামের লোক নিজেদের বস্ত্র তৈরি করে নেবে। হতেই পারে কোনও কোনও গ্রাম নিজেরাই তুলা উৎপাদন করবে, আবার প্রয়োজনে খানিকটা তুলা বাইরে থেকে আনা যেতে পারে। সুতো কটা, কাপড় বোনা গ্রামেই হবে, এজন্য দীর্ঘ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। গ্রামে এখন অনেকেই শহর থেকে আনা শাড়ি জিসন পরছে, সেটা অন্য ব্যাপার। আমাদের প্রসঙ্গ হল গ্রামের পক্ষে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব কি না সে বিষয়টা যুক্তি দিয়ে বোঝা। 
আমাদের চিরাচরিত কৃষিব্যবস্থা স্বনির্ভর ছিল, কারণ সে ব্যবস্থা ছিল জৈব সারের উপর নির্ভরশীল। আর জৈব সার তো গ্রামেই তৈরি হয়। গত ২৫-৩০ বছর ধরে যে নতুন কৃষিব্যবস্থা আমাদের দেশে গ্রহণ করা হয়েছে, যেটাকে অনেকে গ্রিন রিভোলিউশন বলে থাকেন, সেটা অনেক পরিমাণে রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু রাসায়নিক সার তো গ্রামে তৈরি হয় না, তা নগর থেকে আনতে হয়। ফলে আমাদের কৃষিব্যবস্থা কিছুটা আমদানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ১৯৬০-৬৫ সালের সঙ্গে আজকের তুলনা করলে দেখা যাবে শস্যের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গত ৮০-এর দশকের শেষ তথা ৯০-এর দশকের শুরু থেকে রাসায়নিক সার ও ঔষধ ব্যবহারের বিপজ্জনক দিকটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠৈছে। একথা প্রমাণিত হয়েছে যে অত্যধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার জমির দীর্ঘকালীন ক্ষতি সাধন করে। ক্রমশ একথাও সত্য বলে প্রামাণিত হয়েছে যে, জৈব সারের উপর নির্ভর করাটাই আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব দিতে পারে। সম্প্রতি আবারও জৈব সারের উপর নির্ভরশীলতা এদেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আখতার হামিদ খান“প্রাকৃতিক চাষ” পদ্ধতির পথপ্রদর্শক। তিনি  বলছেন যে জৈব সারের উপর নির্ভর করাটাই আমাদের দীর্ঘকালীন কৃষিব্যবস্থার পক্ষে উপযোগী, আর সেইদিকেই আমাদের যেতে হবে। জৈব সার ব্যবহারের ঝোঁকটা হল স্বনির্ভর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 
স্বনির্ভরগ্রাম গঠনের এই ঝোঁক বিজ্ঞানকে অবহেলা করে, এ অভিযোগ ঠিক নয়। গ্রামকে স্বনির্ভরতার দিকে নিয়ে যেতে হবে এর অর্থ এই যেয় যে পুরনো পদ্ধতিগুলো অবিকল থেকে যাবে। বিজ্ঞানের নানা গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত সুলভ শৌচালয়,  ধূমহীন চুল্লি প্রতিটি গ্রামের ক্ষেত্রেই  গ্রহণীয়। পরিবেশ দূষণ রোধক, জৈব সার উৎপাদন, সৌর শক্তির ব্যবহার ইত্যাদি নানা মঙ্গলজনক বিষয়ে ক্রমাগত পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। এইসকল গবেষণা গ্রামকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

আমরা বিশ শতক পার হয়ে এলাম। বিশ শতকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষ মতার লড়াই ও তার ফলস্বরূপ দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনও এক চিন্তাশীল মানুষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে কী না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে কী না জানি না, তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ আর হবে না। একথার মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের ধ্বংসাত্ম ক্ষমতার ভয়ংকর পরিণামেরই ইঙ্গিত করেছিলেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে পৃথিবীর সভ্যতার সামান্য অংশও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের হাতে এতটাই ক্ষমতা এনে দিয়েছে যে, অল্প কয়েকজন মানুষ সম্পূর্ণ মনুষ্য প্রজাতি ও সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে। বর্তমানে আরও এক দুশ্চিন্তার বিষয়, সারা পৃথিবীতে নানা ধরনের সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। ধ্বংসের নিত্য নতুন অস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের হাতে রয়েছে। প্রথমে একমাত্র আমেরিকার হাতে আণবিক বোমা ছিল, পরে সোভিয়েত ইউনিয়নও এই ক্ষমতার অধিকারী হয়, পরে পাঁচটি দেশ এবং ক্রমশ পৃথিবীর বহুদেশ আজ এই ক্ষমতার অধিকারী। আমরা এমন এক ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করতে পারি যখন সন্ত্রাসবাদীদের হাতেও ছোট ছোট আণবিক বোমা পৌঁছে যাবে, সেটা আজ না হলেও দু’দশ বছর পর সম্ভব হবে। কে তখন সমাজকে বাঁচাবে ? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শান্তিমুখী হওয়া চাই, নয় তো মানুষ হয়ে উঠবে আত্মঘাতী মানুষ। মনুষ্য সমাজ হয়ে দাঁড়াবে আত্মঘাতী মনুষ্য সমাজ। 
এর থেকে মুক্তির জন্য চাই, ক্ষমতার যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ। স্বনির্ভর গ্রাম বা পল্লী পুনর্গঠনের মাধ্যমেই সুস্থ ও নিরাপদ পৃথিবী গঠন করা যেতে পারে। আমাদের চিন্তাকে, আমাদের যুক্তকে, আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সৃজনাত্মক রাস্তায় ঘুরিয়ে দিতে । ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে কি না সেটা নির্ভর করবে আমাদের সচেতন নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার ওপর। মানুষই পারে ধ্বংস ডেকে আনতে, আবার মানুষই পারে মনুষ্যত্বকে রক্ষা করতে। 
মানুষের ইতিহাস যেমন কেবল অহিংসার ইতিহাস নয়, তেমনই শুধুমাত্র সংঘর্ষের ঘটনাবলীও নয়। মানুষের অন্তরে একদিকে যেমন রয়েছে আদম হিংস্রতা, আবার অন্যদিকে রয়ছে দয়া, প্রেম, করুণা, সহানুভূতির শক্তি। মানুষই খ্রিস্ট, বুদ্ধ, আবার মানুষই হিটলার। একদিকে মানুষ যে করুণার উদাহরণ রাখতে পারে তার জুড়ি নেই, অন্যদিকে এই মানুষই অকাতরে শিশু হত্যা, নারী হত্যা চালিয়ে যেতে পারে। মানুষের ভিতরেই হিংসা ও অহিংসা, এই দুই শক্তির সংগ্রাম অবিরত চলছে। একদিকে রয়েছে নিজের স্বার্থকে আলাদাভাবে দেখা, অর্থাৎ অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা, অপরদিকে রয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন আকাক্সক্ষা। উন্মত্ততাকে পরাজিত করে মানুষ তার অন্তরকে পরিবর্তিত করতে পারবে কি না সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ভবিষ্যতের হাতে, যে ভবিষ্যতের স্রষ্টা মানুষ নিজেই। 
আমরা কি কেবল নিজেদের সুখ নিয়েই ব্যস্ত ? আমরা কি আমাদের সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনি তথা ভাবী প্রজন্মের জন্য চিন্তিত নই ? মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে চলছে ছোট স্বার্থ এবং বৃহৎ সত্যের ভাবনা, রবীন্দ্রনাথ যেটাকে ছোট আমি আর বড় আমি আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষ যখন কেবল নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ নিয়েই ব্যস্ত তখন তার নিজত্বটা ছোট আমিতে পরিণত হয়, আর মানুষ যখন অন্যের ভিতর নিজেকে সম্প্রসারিত করতে পারে তখন এই আমিটা বড় আমিতে পরিণত হয়। আমরা কোন্ আমিকে বাড়াবার চেষ্টা করব ? শান্তির কাজে সচেষ্ট হওয়াটা কি মানুষের সাধ্যের বাইরে ? মানুষের সমাজ আজও যে বেঁচে আছে এতেই প্রমাণ হয় যে, হিংসা আজও সম্পূর্ণভাবে জয়ী হয়নি। একটি পরিবারের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় সেখানে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হয়, আবার সহানুভূতির শক্তিও আছে। এইরকম এক সংগ্রামশীল সমাজে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা কোন পথ গ্রহণ করব ? 
ব্যক্তি-স্বার্থের এই যুগেও পল্লী উন্নয়ন পরিষদের সংগঠিত গ্রামগুলিতে গ্রামোন্নয়নে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় মানুষের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধনের শক্তি আছে, ব্যক্তি-স্বার্থ এখনও সম্পূর্ণ জয়ী হয়নি। মূল প্রশ্ন হল, নিজের বিবেকের কাছে ব্যক্তির দায়বদ্ধতা। এই যে নতুন সমাজ যেখানে ক্ষমতার লড়াই প্রধান কথা নয়, যেখানে সম্প্রীতি স্থান ব্যক্তিস্বার্থের উপরে, যেখানে সমাজ সংগঠন বিকেন্দ্রিত, প্রত্যেক সমাজ কর্মীর প্রচেষ্টাকে সেইদিকে চালিত করতে হবে। আমাদের সাধ্যের সীমা সংকীর্ণ, তবু আত্মসচেতন প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তা ও প্রচেষ্টা মূল্যবান। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কাব্য কণিকা:
“কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধা রবি,
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি,
মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।”
আমরা কেউই সূর্যের মতো সারা পৃথিবীতে আলোকিত করব একা, এতবড় স্পর্ধা শোভা পায় না। তবু সমাজের মূলে আছে বিবেক, নিজ নিজ শক্তি অনযযায়ী পৃথিবীকে শোনাব আমরা বেঁচে থাকার নতুন মন্ত্র। এটাই একজন সমাজকর্মী হিসাবে আমাদের দায়িত্ব, প্রত্যেকের দায়িত্ব। পুরনো বিপ্লবীরা এখনও পুরনো চিন্তার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি পাননি। যদিও কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। গঠনমূলক কাজ ও প্রতিবাদী আন্দোলন দুয়েরই গুরুত্ব আছে। প্রশ্নটা আজ প্রতিবাদের পদ্ধতি নিয়ে। হিংসাত্মক আক্রমনেল পথে কি কোনও সদুদ্দেশ্য কখনওই লাভ করা যায় না ? পুরনো বিপ্লবীদের এই প্রশ্ন। উত্তরে বলতে হয়, হ্যাঁ, সাময়িকভাবে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতেই পারে কিছুটা। কিন্তু তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক পদার্থের যেমন কিছু গুরুতর পার্শ¦পরিণাম থাকে, হিংসাত্মক প্রক্রিয়ারও অবস্থা তেমনই। মানুষের হাতে ধ্বংসের শক্তি যত বাড়ছে, হিংসার পার্শ্বপরিণামও ততই সমাজের পক্ষে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। নতুন সমাজ-সংগঠন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পদ্ধতি নিয়ে নতুন চিন্তা আজ তাই অতি জরুরী। তর্কটা শুদ্ধ অহিংসা নিয়ে নয়, দেশবোধ নিয়ে, আদর্শবাদের মুখোশপরা হিংসার মাদকতার বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ নিয়ে। 
আশার কথা হল সারা পৃথিবীতে এই সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য যাঁরা সদর্থে চিন্তা-ভাবনা করছেন তাঁদের চিন্তা-ভাবনা প্রায় একই পথে চলেছে, যার ভিতর স্থান পেয়েছে স্বয়ম্ভর সমাজ রচনা, পল্লীর পুনর্গঠন অথবা গ্রাম সংগঠন। রাষ্ট্রের মাধ্যমে ক্ষমতার যে কেন্দ্রীকরণ তার থেকে সমাজকে বাঁচাতে গেলে  গ্রাম সংগঠন বা তলা থেকে সমাজের পুর্নগঠন একন্তই দারকার। স্বনির্ভর সমাজÑএকথার সরলার্থ করলে দাঁড়ায় স্থানীয় মানুষ স্থানীয় উপকরণকে অবলম্বন করে স্থানীয় প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে যাবে। বর্তমানে সারা বিশ্ব জুড়ে বিকল্প সমাজ, স্বনির্ভর পল্লী নির্মাণের ভাবনা শুরু হয়েছে। অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নবনির্মাণ প্রচেষ্টাতেও বৈচিত্র্য মেনে নিতে হবে।
আমরা একা নই, বারং আমরা যুক্ত হতে প্রয়াসী বিশ্বময় এক নতুন আন্দোলনের সঙ্গে, যার ভিত্তিতে আছে আত্মশক্তি, সমবায়, আর শান্তির জন্য সংগ্রাম। স্বাধীনতা। অতি পরিচিত একটি শব্দ। কিন্তু শব্দটার মানে কী ? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনের শব্দটার একটা পরিষ্কার অর্থ ছিল। স্বাধীনতা মানে বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি। অধিকাংশের জন্য এই অর্থটাই যথেষ্ট মনে হত। 
কিন্তু বিদেশি শাসক যখন এদেশ ছেড়ে চলে গেল তখন পুরনো প্রশ্নটা আবার ফিরে এল। পুরনো অর্থটাকে এবার আর যথেষ্ট বলে মানা গেল না। স্বাধীনতা বলতে শুধু বিদেশি শাসকের অধীনতা থেকে মুক্তিই বোঝায় না, বরং বোঝায় আপন শক্তি অথবা আত্মশক্তির অধীনতা। সারা দেশের মানুষকে নিয়ে যখন ভাবি তখন স্বাধীনতা বলতে বুঝতে হবে, দেশের মানুষের হাতেই থাকবে দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবার অধিকার। 
আমাদের সংবিধান একটি অসামান্য রচনা। যদিও পশ্চিমি গণতন্ত্রের অনুকরণে রচিত তবু ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিচার করে দেখলে এই সংবিধানকে অতুলনীয় বললেও ভুল হবে না। পশ্চিমি দেশে ভোটের অধিকার প্রথমে সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের উচ্চস্তরের কিছু লোকের ভিতর, ধীরে ধীরে সেটা জনসাধারণের হাতে এসে পৌঁছেছে। মহিলারা বহুদিন পর্যন্ত ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও শিক্ষায় অনগ্রসর দেশে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গনির্বিশেষে সর্বসাধারণের  জন্য ভোটের অধিকার মান্য করবার উদাহরণ অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। জনসাধারণে এই আস্থা, এই সাহসিকতা, অসাধারণ। 

স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিল্পের উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটেছে, ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবেই আরও বিস্তার ঘটবে। শিল্পের বিস্তার  সত্ত্বেও কিন্তু বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এপথে বেকার সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা আশা করা যায় না অন্তত আগামী বিশ-ত্রিশ বছরের ভিতর। আর এরই ভিতর সমাজ সংহতি ভেঙে পড়তে পারে ক্রমবর্ধমান হিংসা ও বিশৃঙ্খলার আঘাতে। এই নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে বিকল্প ব্যবস্থার কথা। কী সেই বিকল্প ব্যবস্থা ? আমরা যে কোনও প্রস্তাবের কথাই বলি না কেন, সমালোচকেরা  তাকে খারিজ করে দেবেন অবাস্তব বলে। অথচ এঁদের নিজেদেরও কোনও বাস্তব প্রস্তাব নেই, অথবা হয়তো এঁরা বর্তমান সংকটের চরিত্র ও ব্যাপকতা সম্পূর্ণভাবে বোঝেন না। 
কথাটা আবারও সরলভাবে বলা যাক। শিল্পায়নের ধারা ঠেকানো যাবে না, ঠেকবার প্রশ্নও উঠছে না। কিন্তু এ পথে এ দেশের সংকটের সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব না, কোনও যুক্তিসঙ্গত সময়সীমার ভিতর। এ কথাটা নগরবাসী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মেনে নিতে চান না, তাঁদের মনের ভিতর কোথাও একটা বাধা আছে। সম্ভবত তাঁদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রার সঙ্গে ওই কথাটাকে মেলানো যাবে না, এইরকম একটা বোধই বাধা হয়ে ওঠে। কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে না দেখলেও চলে। রানীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কিছু  মিশিয়ে এই যে আমাদের সমাজের সমস্যা, একে গভীরভাবে দেখবার ও বুঝবার আগ্রহ থাকাটা যুক্তিমনস্ক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও নাগরিকের পক্ষেই স্বাভাবিক। চতুর্দিকে হিংসার উন্মত্ততা, ভোগবাদের ও সেই সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার প্রসার, রাজনীতি ও প্রশাসনসহ সমাজের নানা স্তরে দুর্নীতির প্রকোপ, অর্ধবেকারত্ব ও সমাজবিরোধীদের অপ্রতিরোধ্য অত্যাচার, সর্বত্র পরিবেশের ভয়াবহ অবনতি, এইসব মিলে সার্বিক বিনষ্টির এক চিত্র আমাদের চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কোন পথে অগ্রসর হতে হবে, কোন কাজটাকে প্রাথমিকতা দিতে হবে ? 
আখতার হামিদ খানের এ বিষয়ে একটা সরল উত্তর ছিল। গ্রাম সংগঠন প্রতিষ্ঠানকে তিনি প্রাথমিকতা দিয়েছিলেন। 
পল্লী সংগঠন বলতে আখতার হামিদ খান বোঝেননি, রবীন্দ্রনাথও নয়, শহরের রাজনীতির গ্রামে সম্প্রসারণ। তাঁরা বুঝেছিলেন গ্রামীণ সমাজের এক মৌল পুনর্গঠন, যাতে গ্রামের মানুষ তাদের প্রাচীন বিভেদ অতিক্রম করে, নিজেদের সমবেত শক্তিতে, পল্লীর সমস্যার-দারিদ্র্য ও অর্ধবেকারত্ব সর্ব বিবিধ-সমাধান করতে পারবে প্রধানত নিজেদেরই পরিকল্পিত উদ্যোগে। এটাকে ব্যর্থ চেষ্টা বলে প্রচারের অভাব নেই। অথচ এ কাজ নিয়ে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে কিছু উদ্যোগী সংস্থা অগ্রসর হয়ে চলেছে। আখতার হামিদ খান- অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো নামী মানুষ এঁরা নন, কিন্তু এঁদের সাফল্য আমাদের মনে নতুন চিহ্নিত করে এঁ^রা পল্লীবাসীর সমবেত উদ্যোগকে স্বনির্ভর পল্লী নির্মাণের পথে চালিত করছেন। জলের সমস্যার প্রধান সমাধান নয় অসংখ্য নলকূপ বসানো অথবা বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ। প্রয়োজন হচ্ছে বৃষ্টির জলকে ধরে রাখবার মতো জলাশয় অথবা ছোট বাঁধ নির্মাণ, সেই জলকে সাধারণ চাষির খেতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা, বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষরক্ষার সুচিন্তিত পরিকল্পনা। গ্রামের উদ্বৃত্ত শ্রমেরসাহায্যেই, বাইরের সামান্য সহায্য নিয়ে, এইসব কাজ সুসম্পন্ন করা যায়। এসব কাজের জন্য সরকারি উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে থাকলে শুধু অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়, গ্রামের মানুষের মনে  ব্যর্থতাবোধ জমে ওঠে, আত্মশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। পল্লীকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে হলে সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও নানা পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়ে, যেমন শিক্ষার সঙ্গে গ্রামের প্রয়োজনের সংযোগস্থাপন, নব-নব প্রযুক্তির উদ্ভাবন পল্লীউন্নয়নের সঙ্গে যার যোগ পল্লীবাসীদের কাছে সহজে বোধগম্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সেই নতুন আন্দোলন, গ্রামবাসীদের ভিতর বিভেদের দেয়ালগুলি ভাঙতে যেটা সহায়ক। গঠনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে প্রয়োজন মতো প্রতিবাদী আন্দোলনও যুক্ত হবে। কিন্তু  প্রতিবাদী আন্দোলনই প্রধান হয়ে উঠলে শেষ পর্যন্ত এমন এক উন্মাদনা এমন কী গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল হবার সম্ভাবনা যাতে পল্লী সংগঠনের কাজ পথভ্রষ্ট হয়। 
পল্লীসংগঠনকে ভিত্তি করে যে সমাজদর্শন তার কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা এবার পর পর সংক্ষেপে বলা যাক।
প্রথমত, গ্রামের উদ্বৃত্ত শ্রমের ফলে গ্রামেই এমন কাজ খুঁজে পায় যাতে শুধু জীবিকা নয়, নতুন সমাজগঠনে সহায়ক হবার চেতনা ও গৌরব লাভ করা যায়। গ্রাম থেকে শহরে জীবিকার ব্যর্থ সন্ধানে যাত্রার বেগ কমে আসে, গ্রাম ও শহর উভয়ের পক্ষেই যেটা মঙ্গলজনক। পল্লীর পুর্ণগ নে যাঁরা উদ্যোগী নগর থেকে  এসে পল্লীর সঙ্গে তাঁরা যোগস্থাপন করতে পারেন, কিন্তু শুধুই সহায়ক হিসাবে, অন্য কোনও স্বার্থে নয়। পল্লী সংগঠনের প্রতিষ্ঠা আমাদের দেশব্যাপী বেকার সমস্যার সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
দ্বিতীয় কথা, পল্লী সংগঠনের প্রতিষ্ঠা যতই সুদৃঢ় হবে, রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা ততই কমবে। আশা করা যায়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে লড়াইয়ের আতিশয্য এতে হ্রাস পাবে। সমাজের পক্ষে এটা একটা মঙ্গলের কথা। 
তৃতীয় কথা, গ্রামীণ সমাজ আজ নাগরিক অপসংস্কৃতির, চাকচিক্য ও দ্রুততালের উত্তেজনার উপদ্রবে আত্মস্থতা ও স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। নতুন পল্লীসমাজ পুনরুজ্জীবিত করবে তার নিজস্ব জীবনদর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে এমন লোকসংস্কৃতিকে। নগরের সংস্কৃতিও এতে লাববান হবে। পল্লীর ওপর আদিপত্য স্তাপনের আকাক্সক্ষা নগরকে ত্যাগ করতে হবে। আদিপত্য নয়, সামঞ্জস্য স্তাপনই নগরের লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। নগরের একটা বড় সুবিধা আচে, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সংবাদ নগরেই প্রথমে এসে পৌঁছায়। পল্লী ও বিশ্বের ভিতর সেতু স্থাপনই হতে পারে নগরের যোগ্য লক্ষ্য । 
স্বাধীনতার অর্থ কী ? এই প্রশ্ন দিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। সেখানেই ফিরে যেতে পারি আবারও। স্বাধীনতা শব্দটার মধ্যেই অধীনতার কথা আছে। কার অধীনতা ? এ কথা সহজেই গ্রহণযোগ্য যে, অপরের ইচ্ছার অধীনতাকো স্বাধীনতা বলা চলে না, বরং স্বধীন মানুষ নিজের ইচ্ছারই অধীন। কিন্তু এখানেই জটিলতা শুরু হয়ে যায়। মানুষের মনে পরস্পরবিরোধী নানা ইচ্ছাই থাকে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি লাইন মনে পড়ে যায়, “যাহা চাই, তাহা ভুল করে চাই।” কোন ইচ্ছার অধীনতাকে স্বাধীনতা বলব? নিজের ইচ্ছাকে মেনে চলব এ কথা বলবার পরও ওই নৈতিক প্রশ্নটা থেকেই যায়। 
আবারও রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হওয়া যাক। “ছোটো আমি” আর “বড় আমি”-র ভিতর প্রভেদের কথা তিনি বলেছিলেন। বহুবার উচ্চারিত হবার ফলে শব্দগুলি ঘষা পয়সার মতো বিবর্ণ হয়ে গেছে, তবু মূল্য হারায়নি যদি চিন্তা করতে প্রস্তুত থাকেন পাঠক। প্রশ্নটা আমিত্বের গ-ি নিয়ে, অথবা আত্মপর সম্পর্ক নিয়ে। এ বিষয়ে আলোচনার পরিধির ভিতর যেমন ব্যক্তিবিশেষকে তেমনি সম্প্রদায়বিশেষকে সহজেই নিয়ে আসা যায়। অপর ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায়ের প্রতি আমরা তাকাতে পারি দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এক দৃষ্টিভঙ্গিতে অপর ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায় আমার প্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে বিভেদের বোধটাই প্রধান। অন্য একভাবে তাকালে কিন্তু দৃশ্যটা সম্পূর্ণ বদলে যায়, অন্য ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায় তখন আমার সম্প্রীতির প্রসারণের ক্ষেত্র, সে না থাকলে আমার আমিত্ব সংকুচিত অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এই যে সংকীর্ণ সীমা থেকে বৃহতের ভিতর প্রবেশ এতেই আমিত্বের মুক্তি। স্বাধীনতা যদি হয় মুক্তিরই অন্য নাম তবে চেতনার এই প্রসারকেই বলব স্বাধীনতা। 
ভাবের দিক থেকে এটাই মূল কথা। কিন্তু ভাবকে যখন আমরা কাজে প্রয়োগ করতে চাই তখন অন্য অনেক কথা এসে যায়। মূল ভাবটি সাধারণ সত্য হিসেবে গ্রহণীয়। কিন্তু প্রয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত স্তানকালের দ্বারা প্রভাবিত, বহুত্বে চিহ্নিত, যে বহুত্বকে উপেক্ষা করলে অযথা গোলমাল বেড়ে যায়, সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়। 
প্রয়োগের ক্ষেত্রে পল্লী সংগঠনের দুয়েকটি বড় সুবিধা আছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, জয় বাংলা এর সারা বিশ্বের। সারা বিশ্বের জয়ই আমাদের আকাক্সক্ষার বস্তু। কিন্তু সারা বিশ্বকে নিয়ে তো কাজ শুরু করা যায় না। প্রতিবেশী, কাছের মানুষ, এদের নিয়ে কাজ করাটাই অধিকাংশ সমাজসেবীর পক্ষে স্বাভাকি। এই কাছের মানুষের গ-িটারই নাম দেওয়া যেতে পারে পল্লী। গঠনমূলক কাজের পক্ষের পল্লীর ঘনিষ্ঠতা একটা বিশেষ সুবিধা। দ্বিতীয় একটা কথাও আছে। আগেই লক্ষ করেছি যে, আমাদের ঐতিহ্যে নৈতিকতার যে ধরনটা গড়ে উঠেছে সেটা প্রধানত পরিবার কিংবা আত্মীয়সমাজকে আশ্রয় করতে অভ্যস্ত। পল্লী এই আত্মীয়সমাজের সঙ্গেই তুলনীয়। যদিও পল্লীতে দুর্নীতির অভাব নেই তবু সুনীতির কথাটা এখানেই সাধারণের পক্ষে সহজবোধ্য ভাষায় বলা সহজ। সমাজে সুনীতি ফিরিয়ে আনতে গেলে পল্লীকে ভিত্তি করে কাজ আরম্ভ করাটা স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত। স্বনির্ভর গ্রাম হবে দেমের পুনর্গঠনের ভিত্তি। তবু গ্রামের পাশে পাশে নগরও থাকছে, থাকবে। এদেশের সমাজকে হতে হবে অনিবার্যভাবে বহুত্বমুখী। পল্লী ও নগরের ভিতর যোগস্থাপন আবশ্যক, এমনকী পল্লীর ধাঁচটা নগরের কেন্দ্রে না হরেও সন্নিহিত অঞ্চলে কিছু পরিমাণে স্থাপন করা সম্ভব। তবুও এ দুয়ের ভিতর নানা দিক থেকে পার্থক্য যাবে। এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আধিপত্য যদিও  অগ্রাহ্য তবু পার্থব্য মেনে নিতে দোষ নেই, বরং সেটা আবশ্যক। গ্রামের বিধান শহরে চালু করা যাবে না।
কিছুক্ষণ আগে বহুত্বের কথা বলেছিলাম। গ্রামের তুলনায় নগরে বৈচিত্র্য বেশি, এটাই স্বাভাকি। চিন্তার নানা ধারা এবং সেই সঙ্গে জীবনযাপনের ন্নাা ধরন নগরে পাশাপাশি থাকবে, সেই বৈচিত্র্যকে ও বহুমুখিতাকে মেনে নেবার মতো ঔদার্যের প্রয়োজন। অসহিষ্ণু মন বৈচিত্র্যকেই অন্যায় বলে ভুল করে। অথচ এ দুয়ের ভিতর পার্থক্য মৌলিক। একের অন্যায় অপরকে আঘাত করে। সহিষ্ণু সমাজে বিচিত্র জীবনধারা পরস্পরকে আঘাত না করেই পাশাপাশি বাস করে। আমাদের সময়ে বিমেষভাবে একটি স্পর্শকাতর বিষয়, নারীপুরুষের সম্পর্ক। একদিকে নারীমুক্তির আন্দোলন দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে “মৌলবাদী” আন্দোলনে দেখা দিয়েছে নারীস্বাধীনতার ওপর বর্বর আক্রমণ। নগরে পারিবারিক জীবন ভেঙে পড়ছে, এই গতি ঠোকনো কঠিন। এরই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিবাহ ও নারীপুরুষের জীবনযাত্রা বম্বন্ধে ধ্যানধারণার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এবিষয়ে অসহিষ্ণুতা শুধু তিক্ততা সৃষ্টি করবে, পরিবর্তনকে ঠেকাতে পারবে না। গ্রামে পারিবারিক জীবনে অপেক্ষাকৃত স্থায়িত্বরক্ষার চেষ্টা সফল হবার সম্ভাবনা বেশি। 
বৈচিত্র্যকে ঔদার্যের সঙ্গে গ্রহণ করার পরেও কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন। দুর্নীতে যে স্বাধীনতার বিরোধী এ কথা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা নি®প্রয়োজন, কারণ একের দুর্নীতি অন্যের স্বাধীনতার ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ। গ্রামে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোপধকে প্রাধান্য দিতে হবে। 
সর্বত্র নাগরিকের দাবি হবে, সুবিচার। আইনের শাসন গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার ভিত্তি। সেই ভিত্তি আজ আক্রান্ত। এই আক্রমণকে প্রতিহত করা নাগরিকমাত্রেরই কর্তব্য। তবে আইনের ভিতরই যখন অন্যায় লুকিয়ে থাকে তখন আইন অমান্য করার শিক্ষাও আখতার হামিদ খান দিয়েছেন। 
পল্লী ও নগরের পরিপুরকতার কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করবার প্রয়াস পল্লীতে ও নগরে সর্বত্র প্রয়োজন। প্রয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশা অনুযায়ী এই প্রয়াসের রূপভেদ ঘটবে। কিন্তু কিছু কথা আছে যেখানে মতভেদের অবকাশ দেখি না। শান্তি চাই। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ তবু সুদূঢ় প্রতিবাদ চাই। সেই সঙ্গে চাই এই উপলব্ধি: বাইরের কোনও ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে চাই অন্তরের পরিবর্তন। দুটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলেই দুর্নীতি দূর হবে এমন ধারণা রাখা ভুল। এজন্য চাই “সত্যশোধক” আন্দোলন, সংস্কৃতির রূপান্তর। মুলকথা, ধর্মের অজুহাতেই হোক আর দলীয় রাজনীতির নামেই স্থান দিতে হবে মিথ্যা প্রচারের ঊর্ধ্বে। সংকীর্ণতাই বন্ধন, চিত্তের প্রসারেই মুক্তি। এর বাইরে স্বাধীনতার কোনও সদর্থ নেই। 
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, স্বরাজ হচ্ছে “আপন দেশকে আপনি সৃষ্টি করে তোলার অধিকার।” আজ যদি ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ক্ষমতার প্রমত্ততায় কিছু মানুষ আপন দেশেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে লজ্জাবোধ না করেন তবে তো ইতিহাসের ধিক্কারই হবে তাঁদের প্রাপ্য। আশা রাখতে হবে যে, এই অন্ধকারের ভিতরই বেড়ে উঠছে নতুন এক প্রজন্ম যাঁরা প্রকৃত পল্লী চিন্তায় ভাবিত হয়ে অন্য এক ইতিহাসে রচনা করবেন, গড়ে তুলবেন এদেশে স্বাধীন মানুষের গৌরবের সঙ্গে বাস করবার যোগ্য এক নতুন সমাজ। একুশ শতকের জন্য বিদায়ী বিশ শতকের এই হতে পারে একমাত্র প্রার্থনা। সমস্ত অগৌরবের মধ্যেও বিশ শতক দিয়েছে আখতার হামিদ খানের মতো অসাধারণ মানুষকে। একুশ শতকের জন্যও আখতার হামিদ খানের পল্লীচিন্তা ও পল্লীউন্নয়ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে যে, আপন দেশকে আপনি তাঁদের সৃষ্টি করে নিতে হবে, অন্য কেউ এসে এ কাজ তাঁদের জন্য করে দিয়ে যাবে না।












সর্বশেষ সংবাদ
এড. বদিউল আলম সুজন নারী শিশু ট্রাইব্যুনাল-এর পিপি হওয়ায় মনোহরগঞ্জ উন্নয়ন ফোরামের শুভেচ্ছা
মনোহরগঞ্জে সরকারি খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ
কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পি.পি. নিযুক্ত হলেন অ্যাড. সুজন
কুমিল্লায় শচীন মেলা শুরু আজ
টুটুল পালালেন অস্ট্রেলিয়ায়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা সদরের সাবেক চেয়ারম্যান টুটুল অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে গেছেন
কুমিল্লা জেলা পিপি এড. কাইমুল হক রিংকু
সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নিয়োগ পেলেন ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া
কুমিল্লায় ১৮ দিনে ২৭ অভিযানে ৬৭ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
কুমিল্লায় শচীন মেলা শুরু আজ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২