আপনার পরিচয় ছিল, এইতো দু'দিন আগেও, আপনি তখন বেঁচে ছিলেন। এখন আপনার লাশ মিলেছে, মিলছে না পরিচয়। আপনার পরিচয় অজ্ঞাত- অপরিচিত লাশ।
বিষয়টা
ভাবতেই অবাক লাগে। কাফন- দাফন, সৎকার হয়তো জুটবে, কিন্তু আপনি বেওয়ারিশ,
স্বজনদের স্পর্শ, শেষ শ্রদ্ধা, একমুঠো মাটি ছাড়াই। নিজেকে এমন অবস্থায়
কামনা করে না কেউই। সারদেশে অপরিচিত লাশের ৭৭ ভাগই শনাক্ত হতো না, এখন তা
৫০ ভাগে নেমেছে। আবার যারা শনাক্ত হয় তাদের ১৬ ভাগ খুনের শিকার, সুযোগে পাড়
পেয়ে যায় খুনি। একটি দেশের জন্য বেওয়ারিশ লাশ অথবা পরিচয়বিহীন লাশ ভালো
কোন খবর নয়। তাহলে পরিত্রাণ- মুক্তি কি?
দুর্ঘটনা- খুনে অনেক নিহতের মুখ
চেনার উপায় থাকে না। সেই লাশের নাম পরিচয় শনাক্ত করা যায় না সহজে। তাহলে
কি ভাবে শনাক্ত করা হয় অপরিচিত লাশ। বেশ কিছু প্রক্রিয়ায় লাশ শনাক্ত করা
হয়। লাশ শনাক্তের কাজ করে পুলিশই। প্রথমে প্রথাগত- ম্যানুয়াল নিয়মে।
চেহারায় স্পষ্ট চেনা না গেলে, অজ্ঞাত লাশের আলামত হিসেবে মোবাইল ফোন, হাতের
আংটি, জন্মদাগ, গায়ের তিল, শরীরের বিশেষ কোন দাগ বা চিহ্ন এসব দেখে আত্মীয়
-স্বজন লাশ শনাক্ত করে। কেউ যদি দাঁত ফিলিং করে কালচে অথবা সোনালী কালার
করে তবে সেসব দেখেও লাশ শনাক্ত করা যায়, বিশেষ স্বতন্ত্র চিহ্ন। শরীরের
পোশাক- পরিচ্ছদ দেখেও লাশ শনাক্ত করা হয়। দেহের গঠনও অনেক সময় লাশ শনাক্তে
কাজে লাগে।
কিন্তু চেনাই যাচ্ছে না, কোন ভাবেই শনাক্ত হচ্ছে না তখন
ফরেনসিক পরীক্ষা লাগে। যাদের পরিচিত কেউ লাশ শনাক্ত করতে আসে না কিংবা
মুখম-ল চেনা যায় না কিংবা পুড়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে লাশের শরীর থেকে টিস্যু
নেওয়া হয়। শরীরের রানের মাংস নেওয়া হয়। চুলগুলো ইনটেক থাকলে- চুল টেনে
ওঠালে চুলের গোড়ায় যে মাংস থাকে ওই মাংস ও চুল নিয়ে ডিএনএ প্রোফাইল করে
রাখা হয়। এরপর আত্মীয়-স্বজন বা যে কোন মামলা থেকে যদি খোঁজ আসে তখন তার
ছেলে-মেয়েদের ডিএনএ পরীক্ষা করে মিলিয়ে লাশ শনাক্ত করা হয়। এমন ভাগ্য সবার
হয় না। অধিকাংশই বেওয়ারিশ হয়ে দাফন বা সৎকার হয়ে যায়। দাফন- সৎকারের পর
তাদের সম্পর্কে পরবর্তীতে আর কোন তথ্য মিলে না। ঘটনাও চাপা পড়ে যায়।
অবশ্য
পুলিশ মৃত দেহের অনেক ছবি তুলে রাখে। মুখ, হাত- পা, মাথা, বিভিন্ন অঙ্গ-
প্রত্যঙ্গের ছবি বিভিন্ন সাইড থেকে তুলে রাখে। কারণ লাশ উদ্ধার হলে,
মৃত্যুর কারণ খুঁজে না পাওয়া গেলে-অভিযোগ না থাকলে অপমৃত্যুর মামলা হয়। যা
আইনী প্রক্রিয়ায় আদালত হয়ে শেষ করতে হয়। যাদের লাশ মিসিং হয়, যারা হারিয়ে
যায়, অপহরণ, খুন বা দুর্ঘটনার কারণে নিখোঁজ হয়ে যায়, তাদের জিডি বা
মামলার বিবরণ বা তাদের আত্মীয় -স্বজনরা এসব ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করতে
পারেন। যখন লাশ ময়নাতদন্ত করে রেখে দেওয়া হয় ফ্রিজে তখন আত্মীয়-স্বজনরা
শনাক্ত করে অনেকেই লাশ নিয়ে যায়। এসবও অধিকাংশের জন্য মিলে না। গরীব-
সাধারণ এসব সুবিধা খুব একটা পায় না। এমন সুব্যবস্থা সব সময় করাও হয় না।
ক্ষেত্র বিশেষে এমনটা ঘটে।
অপরিচিত, অজ্ঞাত, বেওয়ারিশরা হতভাগ্য। তাদের
ভাগ্য বিড়ম্বনা মিটাতে নিজেদের ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করে পুলিশ ব্যুরো অফ
ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), তারা সিস্টেম ডেভেলপ করে। সারা দেশেই এখন তাদের
ইউনিটে এই সুবিধা রয়েছে। দূরে কোথাও স্পর্শকাতর লাশ উদ্ধার হলে সেখানে গিয়ে
শনাক্তের চেষ্টা করে, থানা পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী। লাশ শনাক্ত করার
পদ্ধতি নিয়ে পিবিআই কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। ২০১৮ তে তারা পুরো ব্যবস্থাটি
দাঁড় করায়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে মাঠে কাজ শুরু করে। যাদের জাতীয় পরিচয়
পত্র- এনআইডি নেই এবং যাদের বয়স ১৮ বছরের কম এই প্রযুক্তিতে তাদের পরিচয়
শনাক্ত সম্ভব নয়। মানে যাদের তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভান্ডারে নেই,
তাদের পরিচয় এ পদ্ধতিতে শনাক্ত করা যায় না। এখন পর্যন্ত অসংখ্য ক্লুলেস
খুনের রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়। অপরিচিত লাশ বেশি পাওয়া যাওয়া
ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি ডিভাইস দিয়ে লাশ শনাক্তের কাজ শুরু
হয়। এখন সারাদেশে পিবিআইয়ের সব ইউনিটে বিদেশ থেকে আনা বিশেষ প্রযুক্তির ওই
ডিভাইস রয়েছে। এতে অজ্ঞাত লাশ শনাক্তকরণে সফলতা আসছে। সাথে অজ্ঞাত লাশ
শতভাগ শনাক্তকরণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থার পর দেশের যে সব নাগরিকের
সঠিক জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তাদের অজ্ঞাত লাশ হওয়ার সুযোগ থাকার কথা নয়।
লাশ
শনাক্তে পিবিআই ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন
সিস্টেম (এফআইভিইএস) ব্যবহার করে। তারা দু'টি ভার্সনে কাজ করে থাকে। একটি
ল্যাপটপ ও অন্যটি স্মার্ট ফোন দিয়ে। ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার দিয়ে
আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ঘটনাস্থল থেকে তথ্য পাঠানো হয়
পিবিআইয়ের সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে। সেখান থেকে
নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় এনআইডি তথ্য ভান্ডার থেকে পরিচয় শনাক্ত করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। তবে জাতীয়
নির্বাচন কমিশনে থাকা তথ্য অনেক আগের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থায় নেওয়া। সে
কারণে মেলানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে কারিগরি সমস্যা হয়। অবশ্য অনেক কর্মকর্তা
ফিঙ্গারের ছাপ বারবার নিতে নিতে দক্ষ হয়েছেন। অনেক সময় একটি লাশের তথ্য
একাধিক জনের সাথে মিলে যায়। সেখান থেকে যাচাই করে পরিচয় শনাক্ত করা হয়।
সিআইডির কাছেও লাশ শনাক্তের একই প্রযুক্তি রয়েছে। তারা মামলা তদন্তে এর
ব্যবহার করে। এ প্রযুক্তির ফলে শনাক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ, মামলা
থাকলে তাও বেড়িয়ে আসবে।
এতোকিছুর পরও অজ্ঞাত লাশের বেশিরভাগের পরিচয়
শনাক্ত করা যায় না কেন। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকে না, তাদের ম্যানুয়ালি
পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। আবার অনেক সময় এনআইডি থাকার পরও ফিঙ্গার
প্রিন্ট মেলে না। পঁচে যাওয়া বা আগুনে পুড়ে মৃত্যু হওয়া অজ্ঞাত লাশের পরিচয়
মেলানো যায় না। খুন করে লাশ গুম করার পর কোনোভাবে তা জনসম্মুখে এলেও ওই
লাশ চেনার উপায় থাকে না। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব,
ছিনতাইসহ নানা কারণে হত্যাকা- সংঘটিত হয়। হত্যার পর অনেক সময় লাশ বিকৃত করে
ফেলা হয়। ফলে পরবর্তীতে আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা ভুক্তভোগীর
অবস্থান খুঁজে পান না। এরপরই তারা হয়ে যান বেওয়ারিশ লাশ। বিভিন্ন দুর্ঘটনার
কারণেও পরিচয় মিলছে না অনেক লাশের। কোন ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে নানা
চাপে লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এসব মৃত্যুর
ঘটনায় বিশেষ তৎপরতা না থাকলে পুলিশও বেশি গুরুত্ব দেয় না। এছাড়া আত্মীয়-
স্বজন ও ভুক্তভোগীকে খুঁজে না পেয়ে এক সময় ভুলে যান। পুলিশের মনোযোগও
হারিয়ে যায়। উদ্ধার হওয়া লাশের বেশিরভাগই সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া
ভবঘুরে কিংবা ছিন্নমূল মানুষ।
যাদের খোঁজ খবর খুব একটা নেওয়া হয় না।
বাকী ৪০ ভাগ সাধারণ মানুষ। আবার অজ্ঞাত লাশের ৩০ ভাগ সড়কের পাশের ধানক্ষেত-
জলাশয়, অথবা মজাপুকুর, ডোবা থেকে উদ্ধার করা। এদের অধিকাংশই হত্যার শিকার।
কারণ পানিতে লাশ দ্রুত পঁচে। এছাড়া ইটভাটা, হোটেলে পানির কাজসহ বিভিন্ন
কাজ করতে গিয়ে অনেকের হাতের ফিঙ্গার- আঙ্গুল ক্ষয় হয় এবং পঁচে যাওয়া অনেক
লাশের আঙ্গুল বিকৃত হয়ে যায়। অজ্ঞাতপরিচয় লাশের একটি বড় অংশের জাতীয়
পরিচয়পত্র- এনআইডি থাকে না। মোট কথা এনআইডি না থাকা, লাশ পঁচে যাওয়া ও পুড়ে
যাওয়াদের বেশিরভাগেরই পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
অজ্ঞাত লাশ
শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সময়ের দাবী। শনাক্ত হলে অজ্ঞাত খুনের কারণে অযথা
হয়রানিও কমবে। লাশের পরিচয় মিললে দায়েরকৃত মামলা সহজ ও দ্রুত হয়। বিচার
ব্যবস্থায়ও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অপহরণের পর হত্যা কিংবা হত্যার পর লাশ গুম
এমন ঘটনা কমবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে।
স্বেচ্ছাসেবী
সংগঠন - আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সারা দেশে বেওয়ারিশ লাশ দাফনে কাজ করে।
দেশের অধিকাংশ জেলায় তাদের নিজস্ব পৃথক কবরস্থান নেই। তবে কুমিল্লায়
টিক্কারচরে পৃথক কবরস্থান রয়েছে। নিজেদের কবরস্থান না থাকায় তারা বেওয়ারিশ
লাশের নাম্বারিং করতে পারে না। নাম্বারিং করা গেলে লাশ দাফনের পরও পরিচয়
মিললে তা সহজে খুঁজে বের করা যেত, কবরটা কোথায়। দাফনের পরও তদন্তে অনেকের
পরিচয় বেরিয়ে আসে। আগে কুমিল্লা জেলায় বছরে প্রায় দেড়'শ বেওয়ারিশ লাশ দাফন
করতে হতো। এখন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অজ্ঞাত
তালিকায় পুরুষ, নারী ও শিশু রয়েছে। তিন ভাগের এক ভাগই নারী।
দেশে অনেক
মানুষই বিভিন্নভাবে মারা যান বা নিহত হন। হাজার হাজার অজ্ঞাত পরিচয়ের মধ্যে
হত্যাকা-ের শিকার আছেন অনেকে। যার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে শনাক্ত না
হলেও অজ্ঞাত লাশের ময়নাতদন্ত ও ছবি সংরক্ষণ করার কথা। বেওয়ারিশ হওয়ার পর
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ অন্যান্যরাও লাশের ছবি তুলে রাখে। সমস্যা হচ্ছে
এই ছবি প্রচার করা হয় না। অজ্ঞাত লাশের ছবি ও পরিচয়- ক্লু (যতটুকু সম্ভব)
দিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হলে, ৯৯৯ -এ ফোন দিয়ে স্বজন বা ওই
ব্যক্তির পরিচিত কেউ তার লাশ শনাক্ত করতে পারেন। পাশাপাশি পত্রিকায়ও
বিজ্ঞাপন দেওয়া যেতে পারে। যা দেখে নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনরা তৎপর হতে
পারে। এভাবে লাশ খুঁজে পাওয়াটা সহজ হবে। অনেক পুরনো লাশেরও, দাফন- সৎকার
হয়ে গেলেও, একটা পরিচয় মেলানোর সুযোগ থাকবে।
পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।