কয়েকদিন ধরে সারাদেশ জুড়ে
যা হয়েছে তা কোনোভাবে কারও কাক্সিক্ষত নয়। একেবারেই নয়। সবদিক থেকেই
ঘটনাগুলো একদিকে যেমন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো; অন্যদিকে নিন্দার। আন্দোলনকে
ঘিরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হলো। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার
মতো নির্দেশ দিতে হলো। এর বাইরে আসলে কী কোনো ধরনের সমাধান ছিল না?
ছয়
জনের প্রাণ গেল শুরুতেই। ব্যাপক সহিংসতা হলো। ক্যাম্পাস রক্তাক্ত হলো।
পুলিশ, বিজিবি, টিয়ারগ্যাস সবই ছিল। ভয়, আতঙ্ক, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, সহিংসতা,
অসহায়ত্ব সবই এই ঘটনাগুলোর অনুষঙ্গ। এই পরিস্থিতি কেন হলো?
আমরা সবাই
জানি, বৈষম্য বিরোধী প্ল্যাটফর্ম থেকে শিক্ষার্থীরা অনেকদিন ধরেই আন্দোলন
করে আসছিল। আন্দোলন তখন পর্যন্ত সহিংস ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর একটি
বক্তব্যের পরে সেই আন্দোলন থেকে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে
বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার-এই শ্লোগানকে কেন্দ্র করে শেষ
পর্যন্ত আন্দোলনটির গতি প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাল্টাতে থাকে।
এরপরে
ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে এবং পরের দিনের সহিংসতায় ৬ জনের
প্রাণ যায় এবং বিভিন্ন জায়গায় এখনো সহিংসতা চলছে। এই সহিংসতা আমাদের অচেনা।
সরকারকে
কেন আন্দোলনকে এখানে হামলা করে দমাতে হবে? একটি দাবি দাওয়ার প্রতি সরকার
একমত নাও হতে পারেন, অনেকেরই হয়তো এই আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি
আছে, কিন্তু মত প্রকাশের অধিকারকে তো স্বীকার করতে হবে।
আলোচনার চেষ্টা
করা কী যেত না? সরকারের পক্ষ থেকে কী সেই চেষ্টা ছিল? সমঝোতার পথ কি একদমই
ছিল না? আমি বিশ্বাস করি আন্দোলনকারীদের এই ধরনের শ্লোগান দেওয়া একেবারই
ঠিক হয়নি। কারণ এইগুলোর মীমাংসা ৭১ সালেই হয়ে গেছে। এই টার্ম আমাদের
ইতিহাসে একটি নেতিবাচক টার্ম এবং আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি।
আমি
এটিও বিশ্বাস করতে চাই না যে, শিক্ষার্থীরা সবাই নিজেকে এই পরিচয়ে পরিচিত
করাতে চায়। তাদেরও এই শব্দটির প্রতি এলার্জি রয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই ভুল
ভাঙানোর জন্য কি মুক্তিযুদ্ধের কোনো ফোরাম রাস্তায় নেমে তাদের সঙ্গে আলোচনা
করতে চেয়েছে?
না তার কিছুই হয়নি। স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধারা এসেও এই
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের
সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন? অনেককিছুই হতে পারতো, কিছুই কি হয়েছে?
এসব
কিছু না করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিলেন আন্দোলন
দমানোর। এর বিপরীতে যা হয়েছে সবই সরকারের বিপক্ষে গেছে, তারচেয়ে বেশি
ক্ষতি হয়েছে দেশের। ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরেছে। এরপরের আন্দোলন আর ছাত্রদের
হাতে রইল না। সত্যিকার অর্থেই আন্দোলন চলে গেল ছাত্রশিবির, জামায়াত,
বিএনপির হাতে।
আন্দোলন তাদের হাতে যাওয়ার আগে কি তা রোধ করা যেত না?
অবশ্যই যেত। কিন্তু সরকার কি শুনেছে? ছাত্রদের আন্দোলনের পালস কি বোঝার
চেষ্টা করেছে? করেনি।
সরকার যদি সবার হয়ে থাকে, তাহলে সেই সরকারকে
জনগণের কথা শুনতে হবে। কেন এই কথা না শোনার প্রবণতায় আক্রান্ত আওয়ামী লীগ?
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল
আওয়ামী লীগের কেন এই প্রবণতা হবে?
দলটি টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আছে।
এজন্যই হয়তো দলটির এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে তারা যা চাইবে তাই
হবে। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচন জনগণের আশা আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি।
এবং নির্বাচনে জনগণ অবহেলিত হয়েছে।
কারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক
নেতাদের জনগণের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে
এটি বলা খুব কঠিন নয় যে, দলটির জনসম্পৃকতা কমে যাচ্ছে। কারণ হয়তো তারা মনে
করছে ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগণের খুব বেশি দরকার নেই।
যার কারণে দলে এখন
সবাই নেতা হতে চায়, কেউ আর কর্মী বা সমর্থক হিসেবে নিজেকে সীমিত রাখতে চায়
না। সবার চাওয়া-পাওয়া আছে। তাই জনগণের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক নেই।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জনগণের সঙ্গে বিরাজমান দূরত্বই মূলত এই
সংকট তৈরি করতে সহায়তা করেছে বলে মনে হয়।
আর জনগণকে তোয়াক্কা করছে না
বলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দায়িত্বে থেকেও দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলছেন।
সরকারকে আরও ধৈর্যশীল এবং বিচক্ষণতার সাথেই এগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
মানুষের
দাবি, অধিকার আদায়, প্রতিবাদ সবই তো সরকারের কাছেই করবে। আর সরকারের
দায়িত্বও হলো সেগুলো যথাসাধ্য এবং যৌক্তিক উপায়ে সমাধা করা। কিন্তু এর
বিপরীতে গেলেই সমস্যা।
যদিও এই ধরনের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন,
কিন্তু এই আন্দোলনকে পুঁজি করে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মাধ্যমে
জাতীয় সম্পদ ধ্বংস এবং প্রাণহানী যেন না হয় সেই বিষয়ে আন্দোলনকারীদের আরও
সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল।
এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, আমাদের সার্বিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কতদিন লাগবে কেউ বলতে পারছে না। এমন কি হওয়ার কথা ছিল?
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তো
না খুব একটা, এখন হচ্ছে। আগে পাশাপাশি রুমে থেকেও সবাই যার যার স্মার্ট
ফোনেই ব্যস্ত থাকতো। পাশের রুমের জন মেসেজ লিখে যোগাযোগ করতেন। এখন এক রুমে
সবাই একত্রিত হচ্ছে, পারিবারিক আড্ডা জমছে, সবাই কাছাকাছি হচ্ছে। উনো বা
কার্ড, লুডু, কেরামও খেলা হচ্ছে পরিবার মিলে। এমন পারিবারিক বন্ধন ভুলতে
বসেছিল সবাই। চাহিদা হারিয়ে গিয়েছিল।
ইন্টারনেট সেবা নিয়ে ডাক,
টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই)
সন্ধ্যায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় মহাখালীর তিনটি ডাটা সেন্টার। যার ওপর
নির্ভর করে দেশের ৬০ ভাগ ব্র্যান্ডউইথ। এরপরই বন্ধ হয়ে পরে দেশব্যাপী
ইন্টারনেট সেবা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দেশের প্রায় ১৩ কোটি গ্রাহক।
এছাড়া চট্টগ্রামের সাবমেরিন ক্যাবলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠিক করতে কত সময়
লাগবে এমন সুনির্দিষ্ট খবর নেই। ফেসবুক, গুগুল, ইউটিউব, টিকটকের সাথে
সরকারের যোগযোগ হয়েছে। কিন্তু সরকার যেগুলোকে বির্তকিত কনটেন্ট বলছে সেগুলো
নিয়ে তাদের প্রাইভেসি পলিসিতে সন্তুষ্ট নয় সরকার। সরকারের মুখপাত্র বলছেন,
এ সব কোম্পানী বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার স্থাপন করে দেশের আইন মেনে ব্যবসা
পরিচালনা করতে হবে। এসব নিয়ে কঠোরতা তৈরি হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে
রোববার নাগাদ দেশে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে পারে পুরো দমে। তখন নেট-
ফেসবুক মুক্ত, স্বভাবিক হতে পারে।
পরিচিতি: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।