আমি
একজন লেখক ও সাংবাদিক, গণক নই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন
আর্থ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ কিংবা পর্যালোচনা করাই আমার
লেখার প্রধান বিষয়বস্তু। সাংসারিক অথবা পারিবারিক কারণে বাংলাদেশ ছাড়াও
ইউরোপের যুক্তরাজ্য এবং আটলান্টিকের অন্য পারে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে আমাকে
যাতায়াত করতে হয়। গণমাধ্যমের একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে, হয়তো বা
দীর্ঘদিনের পেশাগত অভ্যাসের কারণেই বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ঘটনা বা বিষয়ের
প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে থাকে।
এ ক্ষেত্রে আমি বিস্ময়ের সঙ্গে
লক্ষ্য করছি যে ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী ষোড়শ শতাব্দীর খ্যাতনামা ফরাসি
সাধু (সন্ন্যাসী) এবং ভবিষ্যৎ বক্তা মাইকেল নস্ট্রাডামাসের কিছু বাণী নিয়ে
যে সরস আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, তা যেন আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং
আধ্যাত্মিকতা কিংবা অতিপ্রাকৃত বিষয়াদির সঙ্গে মিলেমিশে সমাজের বিভিন্ন
পর্যায়ে রাহুগ্রাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক কিংবা
মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো বলবেন, এটি কোনো সমাজে বিরাজমান বিভিন্ন ব্যর্থতা,
হতাশা কিংবা দিগদর্শনের অভাব থেকেও ঘটতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা
প্রযুক্তি যখন সমাজকে কোনো জটিল পরিস্থিতি কিংবা বিভিন্ন সমস্যা থেকে
বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়, তখনই সমাজের কোনো অংশ সহজাতভাবে
আধ্যাত্মিকতা কিংবা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের ওপর আস্থাশীল হয়ে পড়তে পারে।
গত এক সপ্তাহে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে।
পেনসিলভানিয়ায়
অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনী সভায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যা করার জন্য গুলি
চালানো হয়েছে। তাতে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গেছেন ট্রাম্প। তার পরপরই আগামী
নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা
প্রত্যাহার করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে
বাইডেনের স্বাস্থ্যগত কিংবা শারীরিক অবস্থার আরো বিপর্যয় ঘটে।
বার্ধক্যজনিত
জটিলতা ও স্মৃতিদুর্বলতাও তাঁকে কাঁবু করেছে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর
এক সপ্তাহ আগেও প্রায় ৮২ বছর বয়স্ক এই রাজনীতিক তাঁর দ্বিতীয় টার্মের
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার দৃঢ়প্রত্যয় জানিয়েছিলেন। বয়স কিংবা শারীরিক কারণে
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ডেমোক্রেটিক দলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট
বারাক ওবামাসহ কারো কথায়ই কর্ণপাত করেননি বাইডেন। শুধু তাই নয়, বাইডেন তাঁর
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে নিজ ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট
পদে লড়ার জন্য সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। এশিয়ান-আমেরিকান কমলা হ্যারিসই এ
ক্ষেত্রে হবেন প্রথম অশ্বেতাঙ্গ এবং নারী প্রার্থী, যিনি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন রক্ষার জন্য রিপাবলিকান
কর্তৃত্ববাদী প্রার্থী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে
লড়ার সার্বিক প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত।
দলের ভেতরে এবং বাইরে কমলার
জনসমর্থন দ্রুত বাড়ছে এখন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় প্রেসিডেন্ট জো
বাইডেনের জনসমর্থন তুলনামূলকভাবে অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল প্রার্থিতা
প্রত্যাহারের আগে। কিন্তু এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে এক নতুন সমীকরণ। আগামী
মাসে শিকাগোতে অনুষ্ঠিতব্য দলীয় কনভেনশনে কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট
পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। বর্তমানে ভাইস
প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন
দলের নতুন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহে
ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতাকর্মীরা এখন আবার নতুন উদ্যমে
মাঠে নেমে পড়েছেন।
১৮ জুলাই উইসকনসিন রাজ্যের মিলওয়াকি কনভেনশনে
রাতারাতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বেড়ে যেতে দেখা যায়। সেটা বোধ হয়
সম্ভবত তাঁর প্রতি সহানুভূতির কারণে। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে প্রেসিডেন্ট জো
বাইডেনের তুলনায় অনেক এগিয়ে যান ট্রাম্প। সাধারণ মানুষ বহু অপরাধে অভিযুক্ত
ট্রাম্পের ভেতরে যেন এক জাতীয় বীরের সন্ধান করতে শুরু করেছে। সে কারণেই
ট্রাম্প তাঁর বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদের অভিযোগের জবাবে বলতে শুরু করেছেন,
‘আমি গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়েছি।’ ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা
হ্যারিস ট্রাম্পের সেই উক্তিকে একটি নেহাত ভ-ামি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি
বলেছেন, ট্রাম্প একজন নীতিজ্ঞানহীন স্বেচ্ছাচারী। তাঁর কাছে গণতন্ত্র ও
মানবিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে পরিবেশ কিংবা ভু-প্রকৃতির কোনো মূল্য নেই।
তিনি এমনকি আঞ্চলিক বাণিজ্য কিংবা সহযোগিতায়ও বিশ্বাস করেন না। তাঁর কাছে
ক্ষমতা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদের চাবিকাঠি। সে কারণেই ইসরায়েলের ইহুদিবাদী
নেতারা বলেছেন, ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হলে তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক
কাজ করার সুযোগ পাবেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করাতে
না পারলেও চলমান হত্যাকা-ের অবসান চেয়েছিলেন। তিনি সেই অঞ্চলে বিরাজমান
সমস্যার একটি দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলেন। ট্রাম্প
নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আর দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক কোনো সমাধানের কথা
বলবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
গাজার ভবিষ্যৎ কী হবে সুনির্দিষ্টভাবে সে
ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। তবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের
অবৈধ বসতি নির্মাণের কার্যক্রম আরো গতি লাভ করবে বলেই অনেকে মনে করে। শুধু
তাই নয়, নতুন রাজনৈতিক জীবন লাভ করবেন ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নির্বাচিত হলে ট্রাম্প জাতিসংঘ এবং তার অধীনে
পরিচালিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অর্থনৈতিক সহযোগিতা কিংবা বরাদ্দ বন্ধ
করে দিতে পারেন। এখানে আরো উল্লেখ্য, অতীতে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প ও
তাঁর ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার নেতানিয়াহুকে তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে
ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটির রাজধানী স্থানান্তরে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলেন এবং
অবরুদ্ধ গোলান মালভূমির একটি অংশে ইসরায়েলের কর্তৃত্ব স্বীকার করে
নিয়েছিলেন। যদিও ক্ষমতায় থাকাকালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কিংবা ভাইস
প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারেননি, তবু ফিলিস্তিনকে
কেন্দ্র করে জাতিসংঘের নির্দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি কোনো
স্বেচ্ছাচারিতা দেখানোর প্রয়াস পাননি।
পরিতাপের বিষয় এই যে প্রেসিডেন্ট
বাইডেন নিজেকে একজন ইহুদিবাদী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ইহুদি
রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি তাঁর মমত্ববোধের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। এ
ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটস কিংবা রিপাবলিকান-কারো প্রতিই
মুক্তিকামী ফিলিস্তিনবাসীর বিশেষ আস্থা নেই। ইসরায়েলের সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দলের এক অঘোষিত অথবা গোপন চুক্তি সব সময়ই
কার্যকর থেকে যায়। সেখানে তারা সবাই এক ও অভিন্ন। অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় যখন মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো, তখনই
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের আমন্ত্রণে দুই হাউসের সম্মিলিত সভায় ভাষণ দিতে গত
সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে পৌঁছেছেন ইসরায়েলের ঘাতক প্রধানমন্ত্রী
নেতানিয়াহু। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আবার পূর্ণমাত্রায় ইসরায়েলকে
অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করেছে। গাজায় গণহত্যা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের সম্ভাবনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তা ছাড়া ফিলিস্তিন সমস্যার
দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানেরই বা কী হবে? সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে-ই বিজয়ী হন না কেন তাতে বিশ্ববাসীর তেমন কিছু আসে
যায় না।
আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠেয়
আসন্ন ব্রিকস সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা
বলয়ের সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বৈশ্বিক দক্ষিণের (গ্লোবাল সাউথ) অনেক
রাষ্ট্রের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বিভিন্ন স্বার্থের
দ্বন্দ্ব ও সংঘাত অনেক বেড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী ডোনাল্ড
ট্রাম্প তেমন কিছুই করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন,
ট্রাম্প শুধু বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে যেতে পারবেন;
বিশ্বশান্তি, বাণিজ্য কিংবা পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে
পারবেন না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক