মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী ফারদু খানের গন্তব্য কারওয়ান বাজার, অল্প সময়ে অফিস যাওয়ার জন্য সকাল ৮টার দিকে তাকে একের পর এক বাইকারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল।মিরপুরের পল্লবী স্টেশনে বাইক রাইডাররা তার কাছে ভাড়া চাচ্ছিলেন আড়াইশ টাকা, তিনি দুইশ টাকা দিতে চাওয়ার পরও কেউ রাজি না হওয়ায় বাসে করে চলে যান ফারদু।
এখান থেকে মেট্রোরেলে কারওয়ান বাজার যেতে খরচ পড়ে ৫০ টাকা।
বেসরকারি চাকরিজীবী ফারদু খান বলেন, তার অফিস শুরুর সময় সোয়া ৯টায়; মেট্রোরেল যখন চালু ছিল তখন তিনি বাসা থেকে বের হতেন ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে।
“তখন ৯টা ৫ বা ১০ এর মধ্যে চলে যেতাম। এখন দুই ঘণ্টা আগে বের হলেও যেতে পারছি না, আরও এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে। এত মানুষের চাপ, গাড়ি পাওয়া কষ্ট হয়ে যায়। গরমের মধ্যে অসহ্য লাগছে।”
কেবল সময় নয়, খরচ নিয়েও চিন্তিত ফারদু বলেন, “এখন দিনে ৬০০-৭০০ টাকা খরচ হচ্ছে, বাইকে সাধারণত দেড়শ টাকায় চলে যাওয়া যায়। মেট্রো না থাকায় তারাও বেশি ভাড়া চাচ্ছে, আমি যতই বেতন পাই না কেন; এভাবে তো সম্ভব না চলা।”
২০২২ সালে মেট্রোরেল চালুর পর থেকে এই পথে যাত্রী সঙ্কটে বাসের সংখ্যা কমতে থাকে; এখনও যাত্রীর তুলনায় বাস কম থাকায় যাতায়াতে আরও ভুগতে হচ্ছে বলে জানালেন ফারদু খান।
তিনি বলেন, “সরকার মেট্রোরেল দ্রুত খুলে দিলে জনগণের সুবিধা হত; এটা খুব প্রয়োজন।”
গত ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির মধ্যে মেট্রোর লাইনের নিচে মিরপুর-১০ গোলচত্বরে ফুটব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুনের মধ্য দিয়েই একটি ট্রেন ছুটে যায়। পরে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরদিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় একদল মানুষ। তারা টিকেট ভেন্ডিং মেশিন, মূল স্টেশনে যাত্রী প্রবেশের পাঞ্চ মেশিনসহ সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ওইদিন পল্লবী ও ১১ নম্বর স্টেশনেও হামলা হয়।
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামতে এক বছর সময় লেগে যাবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক।
কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত অনেক যন্ত্রপাতিই মেরামতযোগ্য অবস্থায় নেই। এগুলো নতুন করে আমদানি করতে হবে।
আর এই ট্রেন বন্ধ থাকায় আড়াই লাখের বেশি যাত্রীকে ফিরে যেতে হয়েছে এক বছর আগের সেই ভোগান্তির জীবনে।
রোববার সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মেট্রোরেলের পল্লবী স্টেশন থেকে শেওড়াপাড়া স্টেশন পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেল, অফিসগামী যাত্রীদের কেউ কেউ দৌড়ে বাসে উঠছেন, কেউ বাইক রাইডারের সঙ্গে দর কষাকষি করছেন, কেউ আবার অটোরিকশায় করে যাচ্ছেন।
অপেক্ষমান যাত্রীদের মধ্যে সময় মত অফিসে পৌঁছাতে পারা নিয়ে অস্থিরতা দেখা যায়, এদিন সকালে ঢাকার রাস্তায় যানজটও ছিল অনেক বেশি। যাত্রীরা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর দীর্ঘদিন ধরে তারা স্বস্তির যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন; পুরনো অভ্যাসে ফিরতে তারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন না; তার সঙ্গে অর্থ ও সময় দুইই খরচ হচ্ছে।
শেওড়াপাড়া থেকে নাবিস্কোতে নিয়মিত যাতায়াত করেন বেসরকারি এক ব্যাংকের কর্মকর্তা তানজিলা ইয়াসমিন। অফিসে যাওয়ার জন্য তিনি মেট্রোরেলে শেওড়াপাড়া স্টেশন থেকে ফার্মগেট গিয়ে নামতেন; এরপর বাকি পথ যেতেন রিকশায়। মেট্রো বন্ধ থাকায় তাকে অটো রিকশায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। তানজিলা বলেন, মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ার পর তাকে হাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হতে হচ্ছে; সঙ্গে বেড়েছে খরচ। ঘর থেকে বের হলেই মেট্রো স্টেশন, আধা ঘণ্টা আগে বের হলেই চলে যেতে পারতাম। এখন জ্যামে বসে থাকতে হয়। ৪০ টাকার জায়গায় খরচ হচ্ছে দুইশ থেকে আড়াইশ টাকা। আরামদায়ক একটা সেবায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, এখন আবার পুরনো ভোগান্তিতে ফিরে যেতে হল।”
মেট্রোরেলে হামলার ফলে উদ্বেগেও ভুগছেন তানজিলা। তিনি বলেন, “হয়ত কয়দিন পড়েই আমার স্টেশন চালু হয়ে যাবে, কিন্তু এই ঘটনা এমন ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে; মেট্রোরেলেও নাশকতা হতে পারে, যে ভয়টা আগে ছিল না।”
হামলাকারীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তিনি।
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে মতিঝিলে যাবেন বেসরকারি চাকরিজীবী পাভেল মাহমুদ। তিনি কয়েকজন বাইক রাইডার এবং অটো রিকশা চালকের সঙ্গে দর কষাকষি করলেন। বাইক রাইডাররা তার কাছে ভাড়া চাচ্ছিল সাড়ে ৩০০ টাকা, আর অটোরিকশা চালক ৪০০ টাকা। পরে তিনি ৩২০ টাকায় বাইকে করে অফিসে যান।
পাভেল বলেন, এমন পরিস্থিতি আরও কিছুদিন চলতে থাকলে তাকে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
“মেট্রোরেলের কারণে শুধু ওই চাকরিটা করি, এখন অফিসে সময় মত পৌঁছাতে পারি না; জ্যামে বসে থাকতে হয়- এমন পরিস্থিতিতে আছি। আগে আধা ঘণ্টা, ৪৫ মিনিট আগে বের হলে চলে যেতে পারতাম৷ এখন তিন ঘণ্টা আগে ঘর থেকে বের হতে হয়, আমাদের রুটিন; ঘুম সব কিছুতে এর প্রভাব পড়ছে।”
দ্রুত মেট্রোরেল খুলে দেওয়ার পাশাপাশি যারা স্টেশনে হামলা চালিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান পাভেল মাহমুদ।
তিনি বলেন, “এটা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত ঘটনা। সবার ভালো ছিল, এই কাজটা কেমনে করলো মানুষ! আশপাশের সিসিটিভির ভিডিও দেখে তাদের বিচার করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে মেট্রোরেলে আক্রমণ করার সাহস করতে না পারে।”
মিরপুর ১১ নম্বর থেকে মতিঝিলে মেট্রোরেলে চড়ে অফিসে যেতেন বেসরকারি চাকরিজীবী ইলিয়াস আহমেদ।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল সুবিধার কারণে তিনি এত দূর থেকেও খুব সহজে অফিসে যাতায়াত করতে পারছিলেন এতদিন।
ইলিয়াস হোসেন বলেন, “এতো দূরে অফিস। কিন্তু কোন চিন্তা ছিল না, কারণ মেট্রোরেলে আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যেতাম। এখন মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ায় খুব বিপদে পড়ে গেছি। জ্যামে বসে থাকতে অস্থির লাগে, সময়ও নষ্ট হচ্ছে। চিন্তায় এখন বারবার ঘুম ভেঙে যায়।”
রোববার সকালে অফিসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “রাস্তায় এত জ্যাম ছিল! মেট্রো না থাকায় সবাই বাস বা সিএনজি, প্রাইভেট কারে করে বেরিয়েছে। এ কারণে এত বেশি জ্যাম।”
মেট্রোরেলের ভরসায় ফার্মগেইট থেকে টিকাটুলি গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মিতালী রায়। মেট্রোরেল বন্ধের ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তাকেও। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষক বলেন, “মেট্রোতে করে মতিঝিলে এসে রিকশায় টিকাটুলিতে আমার ভার্সিটিতে পৌঁছাতে ৩০-৩৫ মিনিট সময় লাগত। অথচ এখন তো ভাবা যাচ্ছে না।
“ফেব্রুয়ারিতে এখনে জয়েন করেছি মেট্রোরেলে সহজে আসতে পারব সেই চিন্তা করে। এখন যদি মেট্রোরেল না চলে আমার যাওয়া-আসা অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। সময়ও নষ্ট হচ্ছে অনেক বেশি। আজকে এই জ্যামের মধ্যে কীভাবে যে যাব, সাহস পাচ্ছি না।”
মিরপুর ১১ নম্বর থেকে কারওয়ান বাজার যেতে এখন অন্তত দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে বের হতে হয় ব্যাংক কর্মকর্তা মনজুর হোসেনকে।
তিনি বলেন, গরমের মধ্যে এখন তাকে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হচ্ছে, যেখানে আগে অল্প সময়ে আরামদায়ক যাত্রা ছিল।
“কোথাও থামার বিষয় ছিল না; এখন তো মোড়ে মোড়ে সিগন্যালে পড়তে হয়। যে সময়টা বাঁচত সেটা পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যেত; আরেকটু বেশি সময় ঘুমাতে পারতাম। এখন যত সময় নিয়েই বের হই না কেন, সময়ের মধ্যে পৌছাতে পারব কিনা সে চিন্তা থাকেই।”