আমার
কলিজার টুকরো ছেলেটা কই, আমার নিমাই চানরে কে গুলি করে মারল! আমার বুকটা
খালি করল কে? তার কি একটুও বুক কাঁপলো না ! আমার ছেলেরে কেউ আইন্না দাও,
আমি জড়াই ধরি। না জানি আমার সোনার চান কত কষ্টে দম গেছে, আহারে কোন পাষ-
আমার নিরীহ ছেলেডারে গুলি করল, আমার চিকিৎসার খরচ আর কে দিবে। অ’ আল্লাহ
তুমি আমার বুক খালি করে কলিজার টুকুরাটা ছেলেরে কিভাবে নিলা। আমার তো সব
শেষ হয়ে গেছে।
এভাবেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছিলেন ঢাকায়
গুলিতে নিহত কাদির হোসেন সোহাগের মা নাছিমা বেগম। ২০ জুলাই রাজধানীর
গোপীবাগ এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী কাদির
হোসেন সোহাগ (২৫)। বন্ধুরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত
৩টার পর তার মৃত্যু হয়। নিহত সোহাগ দেবিদ্বার উপজেলার ভানী ইউনিয়নের
সূর্যপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। সে ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় একটি মেসে
ভাড়া থাকত। সোহাগের পিতা মোহাম্মদ আলী ২২ বছর আগে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন।
এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি। সোহাগ ও সহিদুল- দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায়
মানুষের বাসায় কাজ করেন তাদের মা নাছিমা বেগম। মায়ের অসুস্থতার পর সংসারের
হাল ধরতে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি নেন সোহাগ। কিন্তু ঢাকায় গোলাগুলিতে
উপার্জনক্ষম পুত্র সোহাগকে হারিয়ে মাথায় বাজ পড়ে মা নাছিমা বেগমের।
পুত্রশোকে কাতর এ মায়ের কান্না থামছে না কিছুতেই।
২০ জুলাই রাত ৮টার
দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাত তিনটার দিকে মারা যাওয়ার পরদিন ২১ জুলাই সোহাগের
মরদেহ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়ি দেবিদ্বারের সূর্যপুরে। এদিনই জানাজা শেষে
বাড়ি পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
সোহাগের মৃত্যুর বিষয়ে
খোঁজ-খবর জানতে গণমাধ্যম কর্মীরা তার বাড়িতে গেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা
নাছিমা বেগম। এসময় বার বার মুর্ছা যেতে যেতে তিনি বলেন- ২২ বছর ধরে আমার
স্বামী নেই। সোহাগের যখন তিন বছর তখন আমার স্বামী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়। আর
ফিরে আসেনি। সে এখনও বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানিনা। তবুও আমরা ধরে
নিছি তিনি আর বেঁচে নেই। স্বামী নিখোঁজের পর সংসারের হাল ধরতে সোহাগ ও দেড়
বছরের সহিদুল ইসলামকে নিয়ে ঢাকায় মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করতে শুরু করি।
কাজ করে ছেলে সোহাগকে নবম শ্রেণি ও সহিদুলকে মাদরাসায় ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত
পড়িয়েছি। এরপর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে সোহাগ আমার চিকিৎসা ও সংসারের হাল ধরতে
একটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানীতে চাকরি নেন। ১০/১২ দিন আগে ওই চাকরিটাও তার
চলে যায়। পরে নতুন আরেকটি কোম্পানীতে চাকরির কথা বললে তাঁরা কাগজপত্র নিয়ে
দেখা করতে বলেন। এরপর ১৫ জুলাই রবিবার বাড়িতে এসে কাগজপত্র নিয়ে যায়
সোহাগ। পরের শনিবার (২০জুলাই) আমার ছেলে মারা যায়। আমি এখন কি নিয়ে বাঁচব?
আমার ছেলে রবিবার দুপুরে শেষবার আমাকে ফোন করে জানায় ‘মা ঢাকায় অনেক
গোলাগুলি হচ্ছে, অনেক মানুষ নাকি মারা যাচ্ছে’- এ কথা শুনে আমার বুকে কেঁপে
উঠে। আমি বলি- বাবারে তুই রুম থেকে বের হইস না, ছেলে আমাকে বলে ‘না মা,
আমরা সব বন্ধুরা রুম থেকে বের হইনি। তবে মা মেসে কোন খাবার নেই, আমার কাছেও
কোন টাকা নেই, তুমি যদি পার আমার বিকাশে ৫০০ টাকা দিও। আর তুমি ঠিকমত
ওষুধগুলো খাইও। পরে আমি আমার ছেলের নম্বরের ৫০০ টাকা পাঠাই। ওই টাকা নিয়ে
সন্ধ্যায় নাস্তা আনতে গেলে আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়। আমি আমার ছেলের হত্যার
বিচার কার কাছে চাইব। কেউ কি আমার ছেলেকে ফিরায় দিতে পারবে বলে হাউ মাউ করে
কাঁদতে থাকেন মা নাছিমা বেগম।’
সোহাগের ছোট ভাই সহিদুল ইসলাম বলেন,
ভাই গুলি খাওয়ার পর তার বন্ধুরা আমাকে ফোনে জানায়। আমি রাত ৩টার দিকে ঢাকা
মেডিকেলে পৌঁছাই। গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকে ব্যান্ডেজ করা। আমাকে দেখে ভাই
বলে, তুই এত রাতে এখানে কেন আসছিস। তুই মাকে দেখে রাখিস। এই কথা বলে রাত
৩টা ১৫ মিনিটের দিকে ভাই মারা যায়। ভাই একমাত্র আমাদের সংসার চালাত। বাবা ও
ভাই হারিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
নিহত সোহাগের চাচা এখলাছুর
রহমান বলেন, ২২ বছর আগে সোহগের বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর তার মা বিভিন্ন বাসা
বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন। তার মা অসুস্থ হলে গেলে তার চিকিৎসার
খরচ ও সংসারের হাল ধরে সোহাগ। নতুন একটি কোম্পানীতে চাকরির কথা চলছিল তার।
দুই একদিনের মধ্যে সেখানে যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেটা আর হলো না। ছোট বেলা
থেকে বাবার আদর পায়নি ছেলেটা, অভাব অনটনে বড় হইছে। ধরতে গেলে ওরা এতিম ছিল।
একটা গুলি এই পরিবারটাকে একবারে পথে বসিয়ে দিল।
ভানী ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান হাজী জালাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ছেলেটা কোন রাজনীতির সাথে জড়িত
ছিল না। সংসারটা সে-ই চালাত। ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। এটি
অত্যান্ত হৃদয় বিদারক। আমি পরিষদ থেকে তার মাকে বিধাব ভাতার কার্ড করে দেব।
দেবিদ্বার
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও নিগার সুলতানা বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক
মৃত্যু। তার পুরো পরিবার সর্ম্পকে আমি খোঁজ খবর রাখছি। সরকারিভাবে সোহাগের
মাকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।