নিয়মিত
গ্রাহকদের শিশুসন্তান দুধ পাবে না, তা হয় না– এটা ভেবেই গুলি ও সহিংসতার
মধ্যে পান্থপথের কালভার্ট বস্তি থেকে দুধ বিক্রেতা বাবা তাঁর ১৩ বছর বয়সী
কিশোর ছেলে মোবারককে পাঠিয়েছিলেন গ্রাহকের বাড়িতে দুধ দিয়ে আসতে। গাভি পালন
করে বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালান তিনি। হয়তো এও মনে
করেছিলেন, কিশোরকে কেউ গুলি করবে না। কিন্তু বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছাতে গিয়ে
গ্রিন রোডে গত শুক্রবার গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা যায় কিশোর মোবারক
আলী। এক মায়ের সন্তানকে দুধ পৌঁছে দিতে গিয়ে খালি হয়ে যায় আরেক মায়ের বুক।
একই
নির্মমতার শিকার হতে হয় রামপুরার কিশোর শ্রমিক সোহাগকে। কোম্পানির পক্ষে
গ্রাহকের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়ে রামপুরায় নিজ বাড়িতে ফিরে দুপুরের
খাবার খাওয়ার কথা ছিল তার। ‘মা, আমি বাড়িতে এসে খাব’- এ কথা মোবাইলে বলার
সময়ই তার মাথা ভেদ করে গুলি চলে যায়। চিরতরে হারিয়ে যায় সংসারের ঘানি টানতে
শ্রমিক বাবাকে সহায়তাকারী কিশোর সোহাগ। পরিবারকে ক্ষুধার্ত থাকতে দেবে না
এই জেদ নিয়ে ভোলা থেকে ঢাকায় এসেছিল কিশোর সিয়াম; কাজ নিয়েছিল গুলিস্তানের
একটি দোকানে। কাজ থেকে ঘরে ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে লুটিয়ে পড়ে সেও
লাশ হয়ে যায়।
সহিংসতার প্রথম দিনেই চট্টগ্রামের ফার্নিচার দোকানে নিহত
হন এক কর্মচারী। দোকানের ভেতরে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের
বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের কর্মচারীকে। এমনিভাবে সাম্প্রতিক কোটা
সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন
শ্রমিকরা।
এদিকে গত সোমবার সিদ্ধিরগঞ্জের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আগুনে
পুড়ে যাওয়া শাখা থেকে তিন শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের
ভাষ্যমতে, অনেক শ্রমিকের সঙ্গে তারা ওই ভবনে রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন।
সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা ব্যাংকে আগুন লাগিয়ে দিলে অন্যরা বের হতে পারলেও
তিনজন বের হতে পারেননি। স্পষ্টত, ‘দুর্বৃত্তদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ
দেওয়া হয়েছে’- মন্ত্রীর এ অভয়বাণী দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ভবন ও শ্রমিক
কোনোটাই রক্ষা করতে পারেনি।
প্রতিটি মৃত্যুই পরিবারের জন্য পাহাড় সমান
ভারী এবং স্বপ্নভঙ্গের বিভীষিকা। কিন্তু একজন শ্রমিকের মৃত্যু মানে গোটা
পরিবারকে অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতে নিক্ষেপ এবং অনাহার ও নির্মম বাস্তবতার
মুখোমুখি করা। যে দেশের অধিকাংশ শ্রমিক দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল,; নেই
কোনো সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি, সেখানে শ্রমিককে করোনা, জলাবদ্ধতা, হরতাল,
সহিংসতা, কারফিউ সবকিছুকে উপেক্ষা করে পথে নামতেই হয় পরিবারের মুখে অন্ন
তুলে দেওয়ার জন্য। শ্রমিক নামে বলেই সচল থাকে দেশের অর্থনীতির চাকা,
মধ্যবিত্তের চাকরি-সংসার। হরতাল ও অবরোধে কত কোটি শ্রমিক পরিবার কতদিন
অনাহারে থাকে, তার হিসাব কি কোনোদিন কেউ নিয়েছে?
‘মজুরিতে নেয় না কেউ,
দোকানি দেয় না বাকি, পোলাপানরে খাওয়াব কী?’ এবারের কারফিউতে সারাদেশের
শ্রমিকদের এটাই ছিল বিক্ষুব্ধ উচ্চারণ। তাই রাস্তায় বের হতে হয়েছিল তাদের
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু তাদের ফিরে যেতে হয়েছে লাশ হয়ে অথবা কাতরাতে
হচ্ছে হাসপাতালে যন্ত্রণায়; ধিক্কারে ও চিরজীবনের জন্য বোঝা হয়ে যাওয়ার
দুশ্চিন্তায়।
প্রতিটি প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মতো এবারও
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিবাসী শ্রমিক, যাদের আলঙ্কারিক নাম দেওয়া হয়েছে
রেমিট্যান্স যোদ্ধা। এক নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস পোড়ানোর কারণে বিপাকে
পড়েছেন সাড়ে সাতশর বেশি শ্রমিক। এ রকম ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তাৎক্ষণিক
সহায়তা ও বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের পাসপোর্ট ও টিকিটের ব্যবস্থা করা জরুরি।
এ
শ্রমিকরা কেউই কোনো মিছিলে বা ভাঙচুরে যোগ দিয়ে গুলির টার্গেট হননি বা
কোনো পক্ষাবলম্বন করেও সহিংসতার শিকার হননি। হয় কাজ থেকে ফেরার পথে অথবা
দায়িত্ব পালনকালে গুলির শিকার অথবা দু’পক্ষের সহিংসতার মধ্যে পড়ে নিহত বা
আহত হয়েছেন। তাদের অপরাধ, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য কাজ করতে
যাওয়া। এ কাজ করতে যাওয়া শুধু তাদের মৃত্যুকে আলিঙ্গন বা পঙ্গুত্ব বরণ করতে
বাধ্য করেনি। তাদের পরিবারের জন্যও ডেকে এনেছে বিভীষিকা।
অবশ্য এবারের
বিভীষিকা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, পুরো জাতিই এর
অসহায় শিকার। প্রতিটি হত্যাকা- ও সহিংসতার তদন্ত করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া এবং সব ধরনের বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে
দেশের মানুষের প্রতিবাদ করা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া এ
ক্ষত প্রশমন সম্ভব নয়। পাশাপাশি প্রত্যেক নিহত ও আহত শ্রমিক পরিবারকে
স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে পরিবারের জীবিকা,
সন্তানদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার সব দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আহত
শ্রমিকদের দেশ-বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সব ব্যবস্থা করতে হবে।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের দেখতে গিয়ে
চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের এবং সহায়তা দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন,
আমরা এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রায়ই বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা তার চেয়ে বেশি কেউ অনুভব করে না। জাতি
সেটা বিশ্বাস করে বলেই দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া ও স্বজন হারানোদের
বেদনা ভাগ করে নেওয়ার দাবিতে তারা আজ সোচ্চার।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস