সহিংসতা, অবরোধ ও
হরতাল হলেই এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় চারদিকে। বৃহত্তর অর্থনীতিতে স্বল্প ও
দীর্ঘমেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে, যার ক্ষতিপূরণ দিতে হয় পুরো জাতিকে।
স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতির চাকা বন্ধ হলে ক্ষতির অঙ্কও বাড়তে থাকে কেননা তা
পুরোপুরি চালু করতে বেশ সময় লাগে। ফলে সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত
ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে থাকে।
এতে ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তাদের ক্ষতি তো
হয়ই, সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন
খায়, তাদের সংকট প্রবল হয়ে পড়ে। এটা সবারই জানা যে, করোনার পর থেকে দেশের
অর্থনীতি এমনিতেই বহুমুখী চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা এ চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়েছে। তার ওপর
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে অস্থিরতা তাতে অর্থনৈতিক
চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে।
সহিংসতা ও অবরোধে আমদানি-রপ্তানিসহ শিল্পের চাকা
বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবস্থা আরও নি¤œমুখী হয়। অচল
অবস্থার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো পণ্য খালাস করা যায় না বিধায় বন্দরে
হাজার হাজার কন্টেইনারের স্তূপ জমে এবং ব্যবসায়ীদের এর জন্য ভাড়া গুণতে হয়
অনেক বেশি। বেনাপোল স্থলবন্দরেও একই চিত্র দেখা যায়।
দেশের অর্থনীতির
মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাত। মাঝখানে মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ হলেও
তা থেমে গেছে। কিন্তু এখন মাথাব্যথা হিসেবে দাঁড়িয়েছে সহিংসতা-অবরোধ। এর
কারণে রপ্তানিমুখী পণ্য বন্দরে পাঠানো এবং বন্দর থেকে আমদানিকৃত কাঁচামাল
দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত কারখানাগুলোয় পৌঁছানো যাচ্ছে না।
একদিকে
সময়মতো রপ্তানিপণ্য বন্দরে পৌঁছাতে পারছে না, আরেকদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রচারণা চলছে। মূলত এই দুই
বিষয়ের প্রভাব পড়ছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে। এছাড়া সরবরাহ চেইন বিঘœ হওয়ায়
কৃষি উপকরণ যেমন সার, বালাইনাশক, বীজ, গ্রোথ রেগুলেটর, সেচ কাজের জন্য
ডিজেল ইত্যাদি স্থানীয় বাজারে পৌছাতে পারছে না, ফলে কৃষক এগুলো সংগ্রহ করতে
পারছে না। আবার কম সরবরাহের কারণে এগুলোর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কৃষি
উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
অস্থিতিশীলতা যদি দীর্ঘদিন থাকে, তাহলে দেশি
বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়।
কারণ, তারাও আস্থার সংকটে ভুগতে থাকে, যেটা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।
সহিংসতা,
অস্থিরতা, কারফিউয়ের কারণে রপ্তানিকারকদের অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে, নতুন
অর্ডার পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে। ডলার সংকট, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অস্থিতিশীলতায় বায়াররাও
বাংলাদেশকে নিয়ে পুনঃবিবেচনা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম কমিয়ে
প্রবাসী আয় বৃদ্ধির যে পথ তৈরি করেছে তাও যদি শ্লথ হয়ে যায় তবে বর্তমান
সঙ্কটের মূল আরও গভীরে যাবে। এসব বিষয় নিয়ে এখনই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির
ওপর একটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ কোটি ডলার
লোকসান তুলে পুনরায় অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চেম্বার
অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালের
অবরোধ-হরতালে প্রতিদিন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয় ২ হাজার ২৭৭ কোটি
৮৬ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বর পর ছয়দিন হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির
আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়নের ডলারের বেশি।
বাংলাদেশে
বর্তমানে বছরে প্রায় ৫০ লাখ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়। সে
হিসাবে একদিনের হরতাল বা অবরোধ বা সহিংসতা বা কারফিউয়ের কারণে দেশে ক্ষতি
হয় প্রায় ১৪ হাজার কোটি ডলার। সুতরাং দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সহিংসতা,
জ্বালাও-পোড়াও ও অবরোধের মতো কর্মসূচি পরিহার করা উচিত।
সংঘাত চরম আকার
ধারণ করলে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে পর্যটন খাত। এ খাতটি করোনার সময় থেকে
ক্ষতি মোকাবিলা করে আসছে। সহিংসতা-অস্থিরতার কারণে নতুন করে আরও বেশি
ক্ষতির মুখে পড়েছে এই খাত।
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যে।
এদিকে ঝুঁকি নিয়ে পরিবহন চালাতে গিয়ে ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিকরা। ট্রাক
প্রতি গড়ে ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ভাড়া। এতে পরিবহন
খরচ বেড়ে যাওয়ায় মাঠপর্যায়ে দাম বেড়েছে।
সব মিলিয়ে একদিকে কৃষক পণ্যের
ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
এমনিতেই দীর্ঘ ১৫ মাস দেশে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। সরকার
বিবিধ উদ্যোগও নিলেও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন,
চিনি, শাকসবজি, মাছ, মাংস; কোনোকিছুই সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার
নাগালে থাকছে না। এ অবস্থায় ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সপ্তাহব্যাপী স্থবিরতা,
সহিংসতা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করবে, তাতে
কোনো সন্দেহ নেই।
সহিংসতার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পরিবহন খাত। ফলে
পরিবহন ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন
দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা পরিবহন শ্রমিকরা। এ খাতে প্রায় ১৫ লাখ
মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন চলাচলও বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে
কম-বেশি সবাই আক্রান্ত হচ্ছে।
এমনিতেই ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত
হরতাল-অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে পরিবহন খাতে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা
ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
সহিংসতার
কারণে বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছাড়াও চলমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা
বড় একটি সময় ক্লাস করতে না পারার ঝুঁকিতে আছে। আগেও আমরা দেখেছি
হরতাল-অবরোধের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়েছিল। হরতালের কারণে
শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়মিত বন্ধ থাকে এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার
প্রস্তুতি ব্যাহত হয়। বর্তমানে সব ধরনের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল ও
স্থগিত হওয়ায় দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে
ঘটে যাওয়া সহিংসতা, কারফিউ ও অস্থিরতায় আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে
আস্থাহীনতার। এখনো সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
আমদের মনে রাখতে হবে, এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক
উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে; তাই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে গতিশীল
অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
দেশের সব পক্ষকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে
মনোনিবেশ করতে হবে। সবার উচিত হবে এমনভাবে কর্মসূচি পরিচালনা করা, যেন
ব্যবসা-বাণিজ্যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতিতে ও মানুষের জীবিকা নির্বাহে
আঘাত না আসে। এজন্য দৃঢ় অঙ্গীকার প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি, সবার যৌথ
প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই দেশের অর্থনীতিকে সন্তোষজনক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা
সম্ভব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়