কুমিল্লার গোমতী নদীতে পানি বেড়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকেই বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীর পানি। টানা তিন দিনের বৃষ্টির পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরা থেকে ঢলের পানি মিলে গোমতীর এই ভয়ঙ্কর রূপ গত বিশ বছরে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা । প্রচন্ড স্রোত আর পানির অস্বাভাবিক উচ্চতায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কার পাশাপাশি ঘর ছেড়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নিতে হয়েছে সহস্রাধিক পরিবারকে। অন্তত ৪ হাজার হেক্টর চরের জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ক্রমাগত পানি বাড়তে থাকায় গোমতীর দু'কূল ছাপিয়ে বন্যা হওয়ার আশংকা তৈরী হয়েছে। বুধবার রাতে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান জানান, নদীর পানি বৃদ্ধির পক্ষ নেই তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমরা বেড়িবাঁধের ভেতরে যেসব মানুষ বসবাস করেন তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য বলেছি। কোথাও কোথাও মাইকিং করা হয়েছে। সকল স্কুল কলেজ গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবকরা মিলে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করবেন।
গোমতী পাড়ের বাসিন্দারা জানান, গত ২০ বছরের বেশি সময় পর এ বছরই গোমতীর পানি এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। চরের ভেতর বসবাসকারী সহস্রাধিক পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। বুধবার দুপুরে বেড়িবাঁধের ভেতরের গ্রামগুলো তলিয়ে গেছে পানের নিচে। নদীর বাঁধের কয়েক জায়গায় ফাটল দেখা দেয়ায়- বালির বস্তা দিয়ে মেরামত করতে হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে।
সরেজমিনে বুধবার সকালে কুমিল্লা গোমতীনদীর আদর্শ সদর উপজেলার বানাশুয়া,পালপাড়া, রত্নবতী, টিক্কারচর,জালুয়াপাড়া, বুড়িচং উপজেলার ভান্তি, শিমাইলখাড়া,পূর্বহুড়া,নানুয়ার বাজার,মিথলাপুর,গোবিন্দপুর, ব্রাহ্মনপাড়া উপজেলার মালাপাড়া এলাকায় ঘুরে দেখা যায় গোমতীর তীর ঘেঁষে পানির ঢেউ। চরের হাজার একর সবজি ক্ষেত ডুবে গেছে। চরের বাসিন্দারা বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। প্লাবনের তোড়ে পানি উপচে আশেপাশের এলাকা ডুবে যাবার শংকায় অনেকেই বাঁধ দেখতে ভিড় করেছেন নদীর তীরে।
বুধবার দুপুরে বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের কিংবা যে পুরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদীর স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে লোকালয় দিয়ে। বেড়ি বাধের ভেতরের এই গ্রামটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। সেখানে কোন স্কুল কলেজ না থাকায় অনেকেই আশ্রয়ের যেতে পারেননি। কেউ কেউ আশেপাশের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। এই গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, গ্রামটিতে কোন স্কুল-কলেজ বা উঁচু ভবন নেই। যাদের পাকা বাড়ি ঘর নেই তারা আশ্রয়ের জন্য বেরিবাদের উপরে যেতে হয়েছে।
একই উপজেলার মালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন আজাদ জানান, তিনি পরিবার নিয়ে চরের ভেতর বসবাস করেন। গেলো ২০ বছরে৷ গোমতী নদীতে এত পানি দেখেন নি। তাঁর বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী সন্তান আর দুটি গাভি নিয়ে গোমতীর বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
বুড়িচং উপজেলার ভান্তি এলাকার আবুল কালাম জানান, তার ১২০ শতক জমির মুলা পানিতে তলিয়ে গেছে। যতগুলো সম্ভব মূলা তুলে নিয়ে আসা হয়েছে।
কামাড়খাড়া এলাকার নোয়াব মিয়া জানান, শিম ও চালকুমড়ার চাষ করেছিলেন। শিমগাছ ছোট ছিলো। মাচায় ঝুলছিলো কচি চাল কুমড়ো। সব এখন পানির নিচে।
সদর উপজেলার জালুয়াপাড়া এলাকার কৃষক রহিম মিয়া জানান, এক লাখ টাকা পুঁজি ব্যয় করে ঝিঙা, শশিন্দা,করলা ও চাল কুমড়ার চারা রোপন করেছেন। লতাগুলো মাচায় উঠবে এই সময়ে গোমতীর পানিতে তাঁর চারাগুলো পানিতে ডুবে গেছে।
টিক্কারচর এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। চরের ভেতর পানি গলা সমান হয়ে গেছে। ঘর থেকে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই বের করতে পারোন নি।
চাঁনপুর এলাকার সোহেল মিয়া জানান, তাঁর সন্তানদের বই খাতা, নিজের গায়ের জামা কাপড় মঙ্গলবার রাতে নিয়ে বের হয়েছেন। আজ বুধবার বৃষ্টিতে ভিজে ঘর থেকে খাট আলমারী বের করছেন।
একই এলাকার বাঁধের ভেতরে বসবাসকারী আমিনুল ইসলাম জানান, হঠাৎ করে এত পানি বাড়বে বুঝতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি হু হু করে পানি বাড়ছে। কোনরকমে বাচ্চাকাচ্চা, ছাগল মুরগি নিয়ে বাঁধের উপরে আশ্রয় নিয়েছি।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রোমেন শর্মা জানান, তিনি গতকাল রাত থেকে গোমতীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরেছেন। বিভিন্ন এলাকায় গোমতীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সব এলাকায় স্থানীয়রা মাটি ও বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
এদিকে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে গোমতী ছাড়াও কাকড়ী,পাগুলি ও সালদানদী দিয়ে ভারত থেকে পানি আসা অব্যহত রয়েছে। এতে করে কুমিল্লায় বন্যার আশংকা রয়েছে।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোঃ ওয়ালিউজ্জামান বুধবার দুপুরে জানান, নদীতে ক্রমাগত পানি বাড়ছে । পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ঝুকিপূর্ণ স্থানগুলো পরিদর্শন করছেন। যেসব এলাকায় ফাটল দেখা দিয়েছে সেসব পয়েন্টগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত করা হয়েছে।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লায় গোমতীর চরে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আইয়ুব মাহমুদ জানান, গোমতীর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি সরে না যাওয়া পর্যন্ত ক্ষতির পরিমান নিরুপন করা সম্ভব নয়। তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরী সভা ডেকেছেন।
এদিকে বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা, ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবক, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নদীর পাড়ে অবস্থান নিয়েছে। বুধবার সারাদিন দুর্গতদের সরলতায় স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বারবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে- যেকোনো প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবকরা পাশে দাঁড়াবে দূর্গতদের।