গরু-ছাগল,
হাঁস মুরগী কিচ্ছু বাঁচাইতে নাই, পানি সব ভাসাইয়া লইয়া গেছে, বসত ঘর
ভাইঙ্গা গেছে, রাত ১২ টায় ঘরের মধ্যে বুক সমান পানি, আমরা তখন দিশেহারা হয়ে
পড়ছিলাম, তখন কেউ কারও সাহায্যে আগাইয়া আসে নাই, সবাই যার যার জীবন লইয়া
টানাটানি। আমার তিন বছরের ছোট্ট নাতিনডারে মাথায় তুইল্যা সাতরাইয়া পার
হইছি, পরের বার সাতরাইয়া বউরে আনছি, কোন রকম জীবনডা বাঁচাইছি, এখন কোথায়
থাকব, কী খাব, কিছুই জানি না। একজনে একটা ছাউনি দিছে, আইলের ওপর কোন রকম
রাইত পার করছি। মুহুর্তে আমরা রাস্তায় নেমে গেলাম। সব হারিয়ে এমন
অসহায়ত্বের কথাগুলো বলছিলেন, কুমিল্লার গোমতীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত অঞ্চল
বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামের জামাল হোসেন (৪৫)। তিনি
ওই এলাকার মৃত ইদ্রিস মিয়ার ছেলে।
জানা গেছে, গত কয়েকদিনের অতি বৃষ্টি ও
ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে জেলার
বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া নামক স্থান দিয়ে গোমতির বাঁধ ভেঙে
লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। এতে বুড়িচং উপজেলার ৫ ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম
প্লাবিত হয়। জেলা সদরের সাথে উপজেলা সদরের প্রধান সড়কের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে
যায়। বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া জামাল হোসেন আরও বলেন, যে দিক দিয়ে বাঁধ ভাঙছে
তার ঠিক বরাবর আমার বাড়িডা ছিল, বাড়িতে টিনসেট তিনটি ঘর আছিল, এখন একটাও
নাই, আমাগো এখন বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ আশ্রয় দরকার।
শুক্রবার দুপুরে
বুড়বুড়িয়ার ভাঙন এলাকা গিয়ে দেখা গেছে, বাঁধের ওপর তাবুর নিচে হাজার হাজার
মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। গাছে গাছে
বাঁধা রয়েছে গবাদি পশু,হাঁস মুরগি। ছোট্ট শিশুরা পাউরুটি মুড়ি খাচ্ছে। কিছু
কিছু
এলাকায় মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালেও ছুঁয়েছে বন্যার পানি।
এদিকে, বাঁধের ওপর দিয়ে হাজার হাজার উৎসুক লোকজন বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে
চলাচল করছেন। তাদের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কামরুল হাসান
নামে একজন স্বেচ্ছাসেবী বলেন,বাঁধের যে অংশ ভেঙেছে মানুষ সেখানে এসে ছবি
তুলছে ভিডিও করছে, অথচ এই জায়গাটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ, তাদেরকে বুঝাতে পারছি
না, নিচের অংশে মাটি নেই একটু পর পর প্রবল স্রোতে মাটি ভেঙে পড়ছে, ভেসে
যাচ্ছে বিভিন্ন গাছপালা। লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেই চলে যাচ্ছে। তাদের
সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া একই এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ
শফিকুর রহমান বলেন, রাত ১০টার দিকে মসজিদের মাইক বলতে শুনছি, সবাই যেন ‘দা
কোদাল, খাঁড়ি নিয়া আইলের (বাঁধ) ওপর আসে। চারদিকে অন্ধকার, আমি কোদাল-খাঁড়ি
নিয়ে আইছি, ছোট্ট একটি গর্ত ছিল, সবাই
মিলে বস্তায় মাটি দিয়া গর্ত ভরাট
করছি, কিছুক্ষণ পানি যাওয়া বন্ধ ছিল। প্রায় ২০ মিনিট পর দেখি ওই গর্ত দিয়া
আবার প্রবল বেগে পানি যাওয়া শুরু হইছে, তখন সবাই চিল্লাচিল্লি শুরু করছে,
বাড়ি ঘরের ভিতর আতঙ্ক দেখা দিছে, কেউ কেউ ব্যাগ গুছাইয়া আগে আগে
বাধের
ওপর চলে আসছে যারা আসতে পারে নাই তারা পরে আসছে, অন্ধকারে কে আসছে আর কে
আসতে পারি নাই বুঝতে পারি নাই। আমার বাড়ি ঘর সব ভেসে গেছে শুধু কোদাল আর
খাড়িডা লগে আছে। শুনছি এখনও নাকি অনেকলোক বাড়ির ছাদে, ঘরের চালে আটকা আছে।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহিদা আক্তার বলেন, বাঁধ রাতে ভেঙ্গেছে,তাই
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা। বুড়িচং উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ষোলনল,
পীরযাত্রাপুর, বুড়িচং সদর, বাকশিমুল এবং রাজাপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ইউনিয়নের
গ্রাম গুলি পানিতে প্লাবিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সংগঠন, ফায়ার সার্ভিস ও
স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ উপজেলায় ১৫ টি আশ্রয় কেন্দ্র
খোলা হয়েছে। এর আগে সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী
খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, সকাল ৬ টা পর্যন্ত প্রায় ৬০ ফুটের মতো
বাঁধ ভেঙ্গে যায়, তবে পানি বের হওয়ার সাথে সাথে বাঁধ ভাঙ্গার পরিমান আরও
বাড়তে থাকে। পানি এখনো বিপদসীমার উপরে। বৃহস্পতিবার রাত ১২ টায় ছিল ১৩৪
সেন্টিমিটার উপরে, আজ শুক্রবার সকাল ৬টায় ছিল বিপদসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার
উপরে। শুক্রবার দুপুর ২ টায় ১০৯ সে: মি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা
বলেন, ‘১৯৯৭ সালে গোমতীর পানি বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত
হয়েছিল। কিন্তু গত দুই দিনে পানি বাড়ার হিসাব অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে
বৃহস্পতিবার রাত ১২ টায় ছিল ১৩৪ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপরে। যা বিগত ২৭
বছরের রেকর্ড ভঙ্গ
করেছে গোমতী।