বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির দেশ গড়তে হবে
মো. সাখাওয়াত হোসেন
প্রকাশ: শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪, ১২:১০ এএম |

 সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির দেশ গড়তে হবে মানুষ হিসেবে জন্ম নিলে প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে- এ অবধারিত সত্যকে আলিঙ্গন করতে কারও কোনো দ্বিধা নেই। তবে সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমাদের শোকের সাগরে ভাসায়, বেদনাক্রান্ত করে, ভুক্তভোগী পরিবারের নিকট সারা জীবনের কান্না হয়ে দেখা দেয়। কেবল ভুক্তভোগী পরিবারই একটি মৃত্যুর ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম উপলব্ধি করতে পারে, অন্যরা সেটি কখনোই পারবে না এবং সম্ভবও নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় যারা নিহত হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 
শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে অপরাধীদের প্রতি একটি বার্তাও পাঠানোর প্রয়োজন রয়েছে। মূলত এ ধরনের বার্তা অপরাধীদের অপরাধ কর্মে নিরুৎসাহ করে, রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল হতে সহায়তা করে। একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ৪ থেকে ৬ আগস্ট তিন দিনেই নিহত হয়েছেন ৩২৬ জন। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩, আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িতসহ সমর্থক ৮৭, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িতসহ সমর্থক ১২ এবং পুলিশ সদস্য ৩৬ জন। 
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত চলমান সহিংসতায় ৫৮০ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেখা যায়, চলমান সহিংসতাকে ঘিরে সারা দেশে লুটপাট, আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা জ্বালিয়ে ও গুঁড়িয়ে দেওয়া, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জমি দখলের মতো ঘটনা ঘটছে। প্রত্যেক ব্যাপারেই সবার সজাগ ও সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, যাতে অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবার জন্য নিরাপদ ও আশাব্যঞ্জক করা যায়। 
সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে শাহবাগে সমাবেশ হয়েছে, অনেকেই বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে এ সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে খবরগুলো ছড়িয়েছে, অতিরঞ্জিত করে কিছু সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারেও অবগত হওয়া গেছে। জাতির এ সংকটময় মুহূর্তে যারা গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে তৎপরতা দেখিয়েছে, তাদেরও শনাক্ত করা জরুরি। আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সব মহলে সমালোচনা হচ্ছে। যদিও সহিংসতায় পুলিশের অনেক সদস্য নিহত হয়েছেন। এনায়েতপুর থানায় ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। 
এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের তদন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পুলিশ সদস্যদের গুলি ছোড়া দেখে অনেকেই বলেছেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। নিরস্ত্র একজন শিক্ষার্থীকে নিবৃত্ত করতে কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যাতে শিক্ষার্থী কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কোন পরিস্থিতিতে গুলি করা যেতে পারে এবং গুলি করলেও কোথায় করতে হবে, এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা মৌলিক প্রশিক্ষণ থেকেই প্রদানের কথা। 
একজন নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে সরাসরি গুলি করার ঘটনা একেবারে বিরল। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা কীভাবে গ্রহণ করলেন, সময় নিয়ে হলেও ব্যাপারগুলোকে তদন্তের মধ্য দিয়ে বের করে নিয়ে আসা প্রয়োজন। তা ছাড়া যে ধরনের গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে, আন্দোলন সহিংসতা দমনে ব্যবহৃত সেগুলোর যথার্থ অনুমোদন রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান পরিচালনা করা উচিত। 
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-পরবর্তী সরকার পতনের পর সারা দেশে যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেসব কি নিছকই রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, না তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিয়ে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর কৌশল গ্রহণ করেছে, এটিও খতিয়ে দেখতে হবে। লুটপাট, অবৈধভাবে জমি দখলের ঘটনা, অগ্নিসংযোগের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংবাদে জানা যায়, যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার চিত্রা নদীর পাড়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তৈরি করা স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ৫ আগস্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। 
পরদিনই সেই জায়গা দখল করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এদিকে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতার তিনতলা একটি বিপণিবিতান দখলের চেষ্টা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ মুগ্ধর নামে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ব্যানার টাঙিয়ে দাবি করা হয়েছে, সেটা বিএনপির আঞ্চলিক কার্যালয়। এ ধরনের দখলদারির ঘটনা দেশব্যাপী যারা ঘটিয়েছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। অপরাধী যে-ই হোক, দেশীয় আইনে তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিরাপদ হয়ে উঠবে।  
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অপরাধীদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, অপরাজনীতি- সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে বের হয়ে আসার সংস্কৃতি লালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ দেশ আমাদের, এ দেশের সম্পদ আমাদের, বর্তমান প্রজন্ম আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিরত থাকতে হবে, রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন। রাষ্ট্রের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রকারান্তরে আমরা প্রত্যেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হই, যাকে টারশিয়ারি ভিকটিমাইজেশন বলে। 
অর্থাৎ এ ধরনের ক্ষতির কারণে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হয়। সংগত কারণেই সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সব দলের জন্য রাজনীতিতে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে। পরিবর্তনের জন্য যেহেতু আন্দোলন, সেহেতু পরিবর্তন ইতিবাচক না হলে হিতে বিপরীত হবে। বিশ্বের অনেক জায়গায় পরিবর্তন-পরবর্তী প্রভাব আগের তুলনায় আরও খারাপ হওয়ার নজির রয়েছে। সে কারণেই পূর্বতন জিঘাংসা জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক কারণে অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা পরিবর্তন করে দেশের সব নাগরিকের বসবাস উপযোগী বাংলাদেশ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। 
এদিকে পুলিশের সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নতুন অন্তর্র্বতী সরকার পুলিশের দাবিদাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে সময় নিয়ে সেসব দাবি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। দেখা যাচ্ছে, পুলিশের অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে। বিষয়টি কি পুলিশ বাহিনীতে নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করতে পারে; এটিও ভেবে দেখা জরুরি। তা ছাড়া কারও বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হলে ওই কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে তদন্ত করতে পারে, তদন্ত সাপেক্ষে দোষী সাব্যস্ত হলে বিভাগীয় শাস্তিসহ প্রচলিত আইনানুযায়ী বিচার নিশ্চিত করতে পারে। 
কারণ সরকারি চাকরিতে সরকারের নির্দেশনা মেনেই পুলিশসহ অন্যান্য শৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজেই কারও প্রতি রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কিংবা বিরাগভাজন হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যৌক্তিক হবে বলে মনে করছি না। তদুপরি পুলিশের প্রচলিত অনেক বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, সংস্কার এমনভাবে করতে হবে, যাতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রত্যেক সদস্যের যোগদান, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, বিদেশি মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ ও পদক প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। 
আলোচনা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হয়ে যোগদান পর্ব নিশ্চিত করা হয় পুলিশ বাহিনীতে। এ প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, যোগ্যতর প্রার্থীকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দিতে হবে। কেবল ফৌজদারি আইনে দোষী প্রমাণিত হলে কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে সম্পৃক্ত থাকলে সরকারি চাকরিতে প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, এর বাইরে রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হয়ে প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পাশাপাশি বাহিনীর মধ্যে সুশাসন চর্চা ও জবাবদিহিমূলক কর্মকাণ্ডের অনুশীলন জরুরি হয়ে পড়েছে। 
এসবের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পুলিশে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং বাহিনী জনবান্ধব পুলিশিংয়ের কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে। জাতির এ সংকটকালে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে, ভেদাভেদ ভুলে রাষ্ট্রের স্বার্থে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিহিংসার রাজনীতিকে চিরতরে বিলীন করতে হবে। সর্বোপরি বলা যায়, সব পক্ষের মধ্যে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গা নিশ্চিত করতে পারলেই মৃত্যুর মিছিল থেমে যাবে এবং জনজীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়













সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২