কুমিল্লার
বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করার পর ক্ষতিগুলো যখন ভেসে
উঠছে; তখন বানভাসীদের কান্নাও ততোটাই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে গোমতীর
ভাঙ্গনকবলিত এলাকাগুলোতে ভয়াবহ ক্ষতিগুলো দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন
সেখানকার মানুষ। সব হারিয়ে নিঃশ^ মানুষগুলোর সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
গোমতীর ভাঙ্গনের ফলে বুড়িচং উপজেলার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন অন্তত ৬টি গ্রামের
মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের বাড়ির ঘর ভেঙ্গে পড়েছে। দীর্ঘদিন পানির
নিচে থাকার পর ঘরের মালামাল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষকে
পুনর্বাসনের পাশাপাশি তাদেরকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) বুড়িচং
উপজেলায় গোমতীর ভাঙ্গনকবলিত বুড়বুড়িয়া, বেড়াজাল, মহিষমারা, ইন্দ্রাবতি,
খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজারসহ আশপাশের গুলো ঘুরে দেখা গেছে বন্যায় ভয়ানক
ক্ষতির চিত্র। এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়কই ভেঙ্গে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে
পড়েছে। অনেকের বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ শিকড় উপড়ে পড়ে
আছে। যেসকল মানুষের ঘরগুলো টিকে আছে; সেগুলোও যায় যায় অবস্থা। বেশির ভাগ
ঘরই কাত হয়ে আছে। ঘরের ভেতর থাকা সকল আসবাবপত্র নষ্ট গেছে। ঘরে পলি মাটির
স্তুপ পড়ে আছে। এসব দেখে হাহাকার করে উঠছেন সেই এলাকার মানুষ।
সোমবার
দুপুরে বেড়াজাল গ্রামের রশিদ পুলিশের বাড়ি সংলগ্ন দরিদ্র বিলকিস বেগমের
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বানের তোড়ে তার ঘরটি ভেঙ্গে পড়েছে। ঘরের ভেতরের
আসবাবপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার এই ক্ষতচিহ্ন দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন
তিনি। কান্না জড়িত কণ্ঠে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে তিনি বলতে থাকেন, ‘এই বন্যায়
আমার সব শেষ হয়ে গেলো, সব গেলো। এই পানি আমার সব কাইরা নিলো। আমি ঘর পামু
কই, থাকমু কই। হায় আল্লাহ, কি সর্বনাশ হইলো আমার।’ বলেই আবারো বুক চাপড়াতে
থাকেন তিনি।
একই চিত্র দেখা গেলো পাশর্^বর্তী ইন্দ্রাবতী গ্রামের
ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের বাড়িতে গিয়ে। বন্যার পানিতে ধীরেন দাসের ঘরটি
মাটিতে মিশে যায়। ছেলের বউ আর দুই নাতিকে নিয়ে ভাঙ্গা ঘরের ভিটির উপর
দাঁড়িয়ে নতুন ঘর তৈরির চিন্তায় চোখ ভেসে উঠে তার।
তিনি বলেন, ‘আমি
বেকার, কিছুই করি না। আমার ছেলে বিশ^জিত বিদেশে থাকে। তার পাঠানো সব টাকা
দিয়ে ঘরটা বানাইছিলাম। বন্যায় সব শেষ হয়ে গেলো। এখন কিভাবে নতুন ঘর করবো?
তাদেরকে নিয়ে কোথায় থাকবো। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।’
শুধু বিলকিস
বেগম কিংবা ধীরেন দাসই নয়- গোমতীর ভাঙ্গনের ফলে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া
উপজেলার অসংখ্য মানুষ এমন ঘরহারা হয়েছেন। আর যাদের ঘর টিকে আছে; তাদের সব
মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি হারানো মানুষজন এখন শেষ সম্বল খালি ভিটির
উপর হাতরে বেড়াচ্ছেন ঘরের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার বলেন, গোমতী নদীর ভাঙ্গনের সম্মুখে থাকা বুড়িচংয়ের
৬ টি গ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গ্রামগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে
হবে। পুনর্বাসন করতে হবে দ্রুত। যেহেতু এই এলাকার মানুষের একসময় সবই ছিলো-
এখন তারা অনেকেই নিঃস্ব। তাই তাদের মনোবলও ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকেই আগ্রাসি
আচরণও করছে। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে মানসিকভাবেও
প্রশান্তি দিতে হবে। বিষয়টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা মহোদয়ের
কাছে জানানো হয়েছে। বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে
জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, চলমান বন্যায় কুমিল্লার ১৪ উপজেলার
মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ৫
লক্ষাধিক মানুষ। বুড়িচং অংশে গোমতী নদীর ভাঙ্গন, ব্রাহ্মণপাড়া অংশে সালদা
নদীর ভাঙ্গন এবং সদর উপজেলা অংশে ঘুংঘুর নদীর ভাঙ্গনের ফলে বুড়িচং ও
ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষজন পানিবন্দী হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ১৫দিন পর পানি কিছুটা
কমতে থাকলেও এখনো অনেকে পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। ঘরবাড়ি ভেঙ্গে, মালামাল
নষ্ট হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এ দুই উপজেলার মানুষ।