বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
সুন্দরবনের মীমাংসিত পর্যটন, বন রক্ষা ও স্থানীয়দের জীবনযাত্রা
মোখলেছুর রহমান
প্রকাশ: শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:২৪ এএম |



সুন্দরবন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রভ বন, যার প্রায় ৬০ শতাংশের মালিকানা বাংলাদেশের। বনটিকে ইউনেসকো ১৯৮৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই বনটির অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক অবদান অপরিসীম। এই বনের দুটি অংশ রয়েছে: কোর জোন ও ইমপ্যাক্ট জোন। কোর জোন হলো বনের প্রাকৃতিক অঞ্চল বা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এই অংশকে মানুষের কার্যকলাপ ও অন্যান্য হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষার মাধ্যমে বনকে কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। কোর জোন সরকারিভাবে সংরক্ষিত এলাকা। অন্যদিকে ইমপ্যাক্ট জোন হলো বনের সেই অঞ্চল, যা চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে। এই অঞ্চলে মানুষ বাস করে, কৃষিকাজ, অন্যান্য জীবনধর্মী কাজ এবং মানুষের প্রয়োজনে রাস্তাঘাটসহ নানাবিধ ভৌত স্থাপনা তৈরি করে।
বেলজিয়ামের অ্যাগ্রিকনসালটিং ইউরোপ এসএ এবং বাংলাদেশের সদেব কনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড যৌথভাবে ২০১৭-৩৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফরেস্ট্রি মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করেছে। ২৬৯ পাতার এই মাস্টারপ্ল্যানে বনের নানাবিধ সম্পদ ও ইকোসিস্টেম সুরক্ষা প্রস্তাবনার আগে আটটি নীতিমালা, দুটি আইন ও বেশ কিছু রেগুলেশন পর্যালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০ পর্যালোচনা করা হয়নি। তাই এই মাস্টারপ্ল্যানে পর্যটনকে বন রক্ষা, উন্নয়ন বা উৎকর্ষ সাধনের কোনো উপাদান হিসেবেই উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে সুন্দরবন এলাকায় পর্যটন উন্নয়নের কাজ করা যাবে। তবে বনের কোর না ইমপ্যাক্ট কোন অঞ্চলে পর্যটন নিয়ে কাজ করা যাবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। বিষয়গুলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে অসমন্বয় ও চরম উদাসীনতার ফল। অথচ ২০২১ সালে বাংলাদেশ সুন্দরবনের পর্যটন থেকে ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে বলে বিদেশি সংস্থার রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী ২০১৯ সালে এই বনের চারদিকে ১০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। এই অঞ্চলটি সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোনও বটে। এখানে বাস করেন কমপক্ষে ১৪ লাখ মানুষ। এই ইমপ্যাক্ট জোনে রয়েছে মানুষের বাড়িঘর, বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, সরকারের নানা দপ্তর এবং স্থানীয় সরকারের বহুমুখী কর্মযজ্ঞ। 
এই এলাকায় গড়ে ওঠা রিসোর্টসহ নানাবিধ ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নিয়মিতভাবে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করেছে। উল্লেখ্য, বন বিভাগ স্বয়ং কোর জোনে নানারূপ স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এসব অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এবং বনের বাস্তু সংরক্ষণ, বনের সম্পদ সংরক্ষণের জন্য সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোনের পর্যটন উন্নয়নের বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যিকতা দেখা দিয়েছে। এসব পদক্ষেপ প্রণয়নের জন্য বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সবাই সুন্দরবনের পর্যটন মানেই কোর জোনের পর্যটনকে বুঝি। এর কারণ এখন পর্যন্ত ইমপ্যাক্ট জোনের পর্যটন ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কেউই ভাবছি না। কোর জোনে প্রতিদিন মেরিন ভেসেল হিসেবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অর্ধশতাধিক লঞ্চ ও জাহাজ সুন্দরবনের কোর জোনে প্রবেশ করে। সরকারের বন বিভাগ নির্ধারিত ফি গ্রহণের মাধ্যমে এদের প্রবেশাধিকার দেয়। 
ফলে বনের পশুপাখির বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও প্রজননব্যবস্থা আশঙ্কাজনকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সুন্দরবনের কোর জোনের পর্যটন সবচেয়ে বেশি অনিষ্টকারী। সুন্দরবনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বাস্তু এমনকি বনের সম্পদ রক্ষা করার জন্য বনের কোর জোনে এই ‘গণপর্যটন’ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। তবে ধারণক্ষমতা নির্ধারণ সাপেক্ষে সোলার ও ব্যাটারিচালিত জলযানকে অতি সীমিত পরিমাণে প্রবেশাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় গড়ে তুলতে হবে সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোনের পর্যটন। সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোনের পর্যটন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এলাকাবাসীর জীবনধারার উৎকর্ষ সাধন, বনের সম্পদ রক্ষা, এলাকাবাসীর বাঞ্ছিত সম্পদের ও সুন্দরবনের বাস্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রাকৃতিক মূলধন ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদের আহরণ ও যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও পরিবেশগত উপাদানগুলোর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। গ্রামবাসী পর্যটনের নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করবেন এবং বিক্রয়ের জন্য উপযোগী পদ্ধতিতে বাজারজাতকরণ করবেন। এ ছাড়া তারা নিজস্ব উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর সংরক্ষণ ও প্যাকেজিং করে এলাকার মানুষ ও পর্যটকদের কাছে বিক্রয়ের নিজস্ব পন্থা উদ্ভাবন করবেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোনের দাকোপ উপজেলার বানীশান্তা, কৈলাশগঞ্জ ও সুতারখালী- এই তিনটি ইউনিয়ন সুন্দরবনসংলগ্ন অবস্থায় রয়েছে। এখানে বসবাসরত মানুষের কর্মসংস্থান, আয়, বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যটন উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ইসিএ হলেও এখানে প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী) মানুষের বাস। বেঁচে থাকার অধিকার এবং ইসিএ নিষিদ্ধ কার্যক্রম মাথায় রেখে দাকোপে গড়ে তোলা যায় ‘সমবায়ভিত্তিক কমিউনিটি পর্যটন’ ব্যবস্থা। 
রিসোর্ট, হোমস্টে, স্থানীয় স্থাপত্যকলা অনুসরণে পর্যটন আবাসন স্থাপন ইত্যাদিসহ আগত পর্যটকদের ধারণক্ষমতা নির্ধারণ, পর্যটন পরিচালনা রীতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এলাকার মানুষের জীবনধারার ওপর পীড়ন রোধের প্রাসঙ্গিক সব বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। এ ছাড়া বনের জৈব বাস্তুর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বাস্তু সংরক্ষণের বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে স্থানীয় পর্যটন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।
এ অবস্থায় বর্তমানে পরিচালিত সুন্দরবনের কোর জোনে পর্যটনকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কোর জোনে কেবল ‘ইকো পর্যটন’ পরিচালনা যেতে পারে এবং এখানে মোট পর্যটকদের সংখ্যা কোনোভাবেই ১০ শতাংশে অতিক্রম করা উচিত নয়। অন্যদিকে বনের ইমপ্যাক্ট জোনকে পর্যটন পরিচালনার স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া উত্তম। এই জোনে ‘ইকো-কালচারাল পর্যটন’ পরিচালনা করা উচিত। ইমপ্যাক্ট জোনে মোট পর্যটকদের ৯০ শতাংশ প্রবেধিকার পেতে পারেন। আমার বিবেচনায় এটিই হতে পারে সুন্দরবনের মীমাংসিত পর্যটনব্যবস্থা। 
তাই অবিলম্বে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে কোর ও ইমপ্যাক্ট জোনের পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। 
সরকারের বিভিন্ন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি শক্ত সমন্বয় দরকার। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ও বিশেষজ্ঞ মত নিয়ে সুন্দরবনে একটি টেকসই পর্যটন উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। 
বন, মানুষ ও পরিবেশ রক্ষার এই আয়োজনকে রাষ্ট্রের সার্বিক মঙ্গল ও মর্যাদার জন্য করতে হবে। এরূপ কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক, নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের নতুন করে পথ দেখাবে। মানুষ, সমাজ ও পরিবেশের সার্বিক রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করবে সুন্দরবনের এই পর্যটনব্যবস্থা।
লেখক: পর্যটনবিষয়ক গবেষক














সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার অভিযোগ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২