বাংলাদেশের
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় দেড় কোটি মানুষ এখন প্রবাসী হিসেবে বিদেশে
বসবাস করছে। ছাত্র, শ্রমিক কিংবা উচ্চশিক্ষিত বিভিন্ন পেশার বাংলাদেশিরা
এখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য সমৃদ্ধ নগরী কিংবা
রাষ্ট্রে অবস্থান করছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে সেসব দেশের নাগরিকত্বও লাভ
করেছে। তবে উল্লেখ্য যে তারা যখন যেভাবেই সেসব দেশে বসবাস করুক না কেন,
তাদের নাড়ি পোঁতা আছে বাংলাদেশে।
পরবাস জীবন থেকে তারা তাই সর্বক্ষণই
বাংলাদেশের খবরাখবর ও ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে। তারা
ঘুমায় দুবাই, রিয়াদ, লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্কসহ বিভিন্ন মহানগরে, কিন্তু
স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশকে নিয়ে। অর্জিত অর্থ নিয়মিত স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়
পরিবারের ভরণ-পোষণ কিংবা ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য। হাজার হাজার মাইলের
দূরত্বে বসবাস করেও তাই তারা বিচ্ছিন্ন নয়।
সে কারণে নিষিদ্ধ হওয়া
সত্ত্বেও তারা আবুধাবি কিংবা দুবাইয়ের রাজপথে নেমে আসে বৈষম্যবিরোধী
আন্দোলনে সাড়া দিতে। চাকরি হারানো কিংবা জেল-জুলুমের পরোয়া তারা করে না। সে
কারণে অর্থাৎ মূল ভূখণ্ড বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগ্রামী মানুষের মতো তারাও
চায় আওয়ামী লীগের শাসকদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিগত দেড় দশকের অপশাসন, গুম,
খুন কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার। রাজনীতিকে কেন্দ্র
করে গায়েবি মামলা কিংবা ওয়ারেন্ট ইস্যু করে ঘরবাড়ি ছাড়া করাসহ বিনা বিচারে
জেলে ফেলে রাখার মতো অপরাধের বিচার চায় তারা।
যাদের তথাকথিত রাজনীতির
নামে খুন করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের সন্ধান চায় স্বজনহারা এই
মানুষগুলো। এতে দেশবাসীসহ প্রবাসীদের মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম নেই।
নিরপেক্ষ
বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইবর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান, নোবেল
বিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে
দেশবাসী কিংবা প্রবাসীদের মধ্যে কোনো বিতর্ক কিংবা বিরোধ নেই। তবে কারো
কারো কিছু বক্তব্য নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে প্রবাসীদের মধ্যে।
বিক্ষুব্ধ স্বদেশি ও প্রবাসীদের অনেকেই মনে করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে যা বলা
হচ্ছে, তা সঠিক নয়।
মুক্তিযুদ্ধের আগেই বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ করেছিলেন
এবং মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে হাজারো প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত
রয়ে গেছে। স্বদেশি কিংবা প্রবাসী বিক্ষুব্ধ অংশের মতে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ
দিয়েছে কিংবা মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ অর্থাৎ
কৃষক, শ্রমিক, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ও তাদের সন্তানরা এবং দেশের আক্রান্ত
পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস ও সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। নেতৃত্ব দিয়েছেন
প্রকৃত অর্থে মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ (প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী), মরহুম
সিরাজুল আলম খান ও দেশের অনেক চেনা-অচেনা নেতা। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা
অর্জনের পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর জাতীয় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে
নেতৃত্ব বলতে যা বোঝায়, আওয়ামী লীগ তার সবই কুক্ষিগত করেছে। আর পাকিস্তানের
জেল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বুঝতেই পারেননি তাঁর বন্দিদশায় পূর্ব
পাকিস্তানে কী ঘটেছিল। উল্লেখিত বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রবাসীরা
আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা-পরবর্তী এবং বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরের অপশাসন,
নির্যাতন, লুটপাট, দখল, অর্থপাচার এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে
সঠিক তদন্ত ও বিচার চায়।
আওয়ামী লীগের নেতাদের, বিশেষ করে অভিযুক্তদের
বিরুদ্ধে আইনি তদন্ত হওয়া একান্তই আবশ্যক। এবং এরই ভিত্তিতে তাঁদের সাজা
হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রবাসীদের বেশির ভাগের মতামত হচ্ছে,
আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের অপশাসন ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে যদি আওয়ামী
লীগকে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা (একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) করতে হয়, তবে
তা-ই করতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ
আদালতে শেষ পর্যন্ত বিচার হয়, তাহলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে। এবং
সেগুলো থেকেই বোঝা যাবে যে একটি গণসংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কী
ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন
সফর এবং বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমার উপরোক্ত
ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসীদের কিংবা দেশে অবস্থানরত বিশাল জনগোষ্ঠীর
মধ্যে যদি তেমন একটি মনোভাব কাজ করে, তাহলে তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া
যাবে না।
এ কথা অনস্বীকার্য যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন
রাজনৈতিক দল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে গঠিত এই দলটির পর্যায়ক্রমে
নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জননেতারা। এই দলটি তৎকালীন পাকিস্তানে
জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোতে গড়ে তোলা হয়েছিল।
কিন্তু এই দলকে তার সংসদীয় গঠনতান্ত্রিক কাঠামো থেকে পরবর্তী পর্যায়ে সরে
যেতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালে দেশে একদলীয়
বাকশাল গঠন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এতে জনগণের কোনো মতামত বা রায় ছিল না।
তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে নিয়ে
তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। শেখ হাসিনা সাধারণ নির্বাচনের
নামে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে পাতানো খেলার আয়োজন করেছিলেন, তা ছিল
নির্বাচনের নামে নেহাতই প্রহসন। সে নির্বাচনে তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা
বাহিনীকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। তখন থেকেই অর্থাৎ ২০১৪ সালের পর থেকে
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাব সরকারের
পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। তাদের মধ্যে নিয়ম-নীতি কিংবা পেশাদারি
সম্পূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছিল। বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে দল হিসেবে
আওয়ামী লীগ এবং সরকারের প্রশাসনযন্ত্র এক ব্যক্তির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত
হতো। গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা আইনের শাসনের প্রতীক জাতীয় সংসদটি পরিণত
হয়েছিল রাবার স্ট্যাম্পে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া যেন
প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। আর প্রশাসনযন্ত্র পরিণত হয়েছিল সম্পূর্ণ রোবটে। এ
ধরনের দেশ, সরকার, প্রশাসন কিংবা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা কেউ একাত্তরের আগে
কল্পনাও করতে পারেনি। সে কারণেই দেশ, রাষ্ট্র, প্রশাসন কিংবা সমাজ
ব্যবস্থাকে যারা এভাবে ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে একটি নিরপেক্ষ ও বিশদ
তদন্ত হওয়া উচিত। এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
নতুবা এভাবে কোনো দেশই ভবিষ্যতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কারণ
সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ
করতে বর্তমান নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ব্যর্থ হলে
ভবিষ্যতে অতীতের সে ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। এবং এই দেশটি শেষ
পর্যন্ত কারো না কারো করদরাজ্যে পরিণত হয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে
ফেলবে।
এখানে সাধারণ মানুষের কাছে আশঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা
লাভ কিংবা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে গিয়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন,
প্রশাসনের স্বচ্ছতা কিংবা সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহির মতো মৌলিক
বিষয়গুলো যদি কেউ ভুলে যায়, তাহলে বাংলাদেশের মতো ভৌগোলিক দিক থেকে
গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ টিকে থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া
কিংবা ভারতের চাপে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, অর্থনৈতিক মুক্তি কিংবা
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। সে কারণেই বাংলাদেশি কিংবা
প্রবাসীদের কাছে উপদেষ্টাদের কাছে প্রত্যাশা অনেক। বিশেষ করে বিদ্বান,
দেশপ্রেমিক ও সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত ড. আসিফ নজরুল ও ব্রি. জে.
সাখাওয়াত হোসেন (অব.)-এর মতো উপদেষ্টাদের গুরুত্ব অনেক। তাঁরা এ সরকারে যোগ
দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অনুরোধে। তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব
আমাদের বর্তমান ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রকে মেরামতসহ দেশের সংবিধানকে জাতির
বাতিঘরের মতো বলিষ্ঠভাবে পুনর্গঠন বা পুনর্লিখন করা, যা জাতীয় জীবনের
সর্বস্তরে আমাদের পথ দেখাবে। তাই সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘদিনের শাসন
ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো খতিয়ে দেখা জরুরি। সেসব
নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক। এর আগে কারো পরীক্ষার খাতায় নম্বর
দেওয়া থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। নতুবা সব কিছুই বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন
হতে পারে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য এবং সর্বোপরি এই
জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দেশের মানুষ এখন প্রাণ বিসর্জনের প্রস্তুতি
নিয়েছে। সুতরাং এই সংগ্রামী জনগোষ্ঠী কোনো ব্যক্তিবিশেষ, নেতা-নেত্রী কিংবা
কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। এটি আমাদের
জন্য একটি আশা ও ভরসার স্থল। সুতরাং নিজ নিজ স্বার্থ কিংবা সময়ের প্রশ্নে
তাড়াহুড়া না করে সব কিছু অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখতে হবে,
নিরপেক্ষভাবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একটি কমিশন গঠন করে দেশব্যাপী
তদন্ত করতে হবে, যাতে একই ভুল আমরা বারবার না করি।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক