স্মরণকালের
ভয়াবহ বন্যা দেখেছে ফেনীও কুমিল্লা জেলার মানুষ। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে
ফুটে উঠছে মানুষের ঘর বাড়ির ক্ষত ক্ষতির দৃশ্য। মানুষের জীবন, ঘরবাড়িরও
সম্পদের পাশাপাশি বড় ক্ষতি হয়েছে মাছ, কৃষি ও প্রাণীসম্পদের ।
বন্যা
পরবর্তী সময়ে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের
পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলাতে মাঠে থাকা আমন ধান, ফসল, শাক-সবজি, আখ, পান,
মাছের পুকুর, গরু-ছাগল ও মুরগীর খামারগুলো ভেসে গেছে। মৎস্য, কৃষি ও
প্রাণিসম্পদ খাতে পুনর্বাসনের চেষ্টা করতে হবে সরকার ও সবাই মিলে। ফেনী,
নোয়াখালী, লক্ষ¥ীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি,
রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার হবিগঞ্জসহ আরও কয়েক জেলায় বন্যায়
আমন ধানের বীজতলার মধ্যে অধিকাংশ আক্রান্ত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে মাছও ফসলি ধান।
বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুরু করায় কৃষি
মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সব রকমের সহায়তা দ্রুত
পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্রুত এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে খাদ্য
সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য ধানের চারা, মাছের পোনাসহ সার, বীজ ও কীটনাশক
নিশ্চিত করতে হবে। ২৩টি জেলার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের
সিনিয়র তথ্য অফিসার মোহাম্মদ জাকির হেসেনের গত ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের দেওয়া
তথ্য মতে এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ দুই লাখ আট হাজার
৫৭৩ হেক্টর। মোট ফসল উৎপাদনে ক্ষতি নয় লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ টন। যার আর্থিক
ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা চৌদ্দ
লাখ চৌদ্দ হাজার ৮৯ জন।
ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে আউশ ধান ছিল আটত্রিশ
হাজার ৬৮৯ হেক্টর, রোপা আমন আবাদ এক লাখ এক চল্লিশ হাজার ৬০৯ হেক্টর, বোনা
আমন ৭৬৪ হেক্টর এবং আমন বীজতলা চৌদ্দ হাজার ৯০৮ হেক্টর। ধান ছাড়াও
শাক-সবজি, আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেঁপে, টমেটোসহ আরও কিছু
ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় আক্রান্ত ২৩ জেলায় বিভিন্ন ফসল চাষ করা
হয়েছিল চৌদ্দ লাখ ত্রিশ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। গড়ে এ ফসলের ১৪ দশমিক
৫৮ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির এ তালিকায় আমন-আউশ ধানের পরই রয়েছে
শাক-সবজি। এক লাখ ছিয়াত্তর হাজার টন বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে,
যার মূল্য প্রায় সাতশত কোটি টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত
জেলায় আশি হাজার কৃষককে মাঝে প্রণোদনা চালু করেছেন। যার মধ্যে ধানবীজ, সার ও
নগদ অর্থ সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকদের
জন্য তের কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
এবারের বন্যার কারণে
খাদ্য উৎপাদন নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয় কৃষকদের। বীজ ও সার কোথা থেকে পাবেন
এ নিয়ে কৃষক ও বর্গা চাষিরা অনিশ্চয়তায় পড়েন। এখন কৃষি পুনর্বাসনের দিকে
সরকারকে দ্রুত মনোযোগ দিতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, দিঘি, খামারের
সংখ্যা এক লাখ আশি হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ নব্বই
হাজার ৭৬৮ টন। ক্ষতিগ্রস্ত পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা তিন হাজার ৭৪৬ লাখ।
দুধ, ডিম, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ এখন পর্যন্ত এ খাতে চারশত এগার কোটি
টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আমনের চারা ও বীজ এবং পরবর্তী সময়ে
সারের জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিশেষ
প্রণোদনা দিয়ে কৃষক ও খামারির সহায়তা করা যেতে পারে। দ্রুততম সময়ে আমনের
বীজতলা তৈরি, বন্যাকবলিত এলাকার নিকটতম এলাকায় বীজতলা প্রস্তুত করা, মাঠ
পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের
বন্যাত্তোর কৃষি পুনর্বাসনের কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা,
বন্যাকবলিত এলাকায় ব্লক এবং উপজেলা ভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা করা যেতে
পারে।
গত সপ্তাহের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী
দেশের বারটি জেলার শুধু মৎস্য খাতের ক্ষতিই এক হাজার ৫৯০ কোটি ছত্রিশ লাখ
টাকা ছাড়িয়েছে। এছাড়া বন্যাকবলিত অন্য জেলায়ও আরও কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের ওই হিসাব বলছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, দিঘি, খামারের
সংখ্যা এক লাখ আশি হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ নব্বই
হাজার ৭৬৮ টন। ক্ষতিগ্রস্ত পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা তিন হাজার ৭৪৬ লাখ
এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুধ, ডিম, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগিসহ এখন
পর্যন্ত এ খাতে চারশত এগার কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।
মাছ
উৎপাদনে কুমিল্লা বাংলাদেশে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখানে নদ-নদী, পুকুর,
দিঘি, জলাশয় ও প্লাবন ভূমিতে জেলার চাহিদার দ্বিগুণের বেশি মাছ উৎপাদন হয়।
কিন্তু এবারের চলমান বন্যায় মাছ উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা
মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায় প্রাথমিকভাবে এ খাতে ক্ষতির
পরিমাণ প্রায় পাচঁশত কোটি টাকা নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে
ক্ষয় ক্ষতির পরিমান সঠিকভাবে বলা যাবে। ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে
বলেও জানান বি-পাড়া উপজেলার মহালক্ষীপাড়া গ্রামের মাছ চাষী নাজমুল
হোসাইন।
কুমিল্লায় তেইশ হাজার ৪২টি খামার বা পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আয়তনে যা পাচঁ হাজার ৮৩৫ দশমিক ৬১ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত এসব খামার থেকে পচিশ
হাজার ৫৩৮ দশমিক ৫০ টন ফিনফিশ, ১০ দশমিক ২৮ টন চিংড়ি, দশ কোটি সতের লাখ
পোনা মাছের ক্ষতি হয়েছে। বাজার মূল্য হিসাবে মাছে তিনশত আটান্ন কোটি বার
লক্ষ, চিংড়িতে পাচঁ কোটি আট লাখ বিরানব্বই হাজার টাকার পোনা জাতীয় মাছের
ক্ষতি হয়েছে।
কুমিল্লার মতো এমন মাছের ক্ষতি হয়েছে আরও ১১ জেলায়। এসব
জেলায় চার হাজার পোলট্রি খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে ৫৬৭ কোটি টাকা
ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
ফেনি জেলার সোনাগাজী উপজোলার বড়হালিম
গ্রামের মুরগীর খামার ও মাছ চাষী মো. এরশাদ উল্লাহ জানান এবছরের বন্যায়
তাঁর চারটি মাছ চাষের পুকুর থেকে বন্যার পূর্বে মাত্র একলক্ষ বিশ হাজার
টাকার সিং মাছ বিক্রি করেন, প্রায় এগার লক্ষের টাকার মাছ বন্যার পানিতে
তলিয়ে যায়। এছাড়াও ২ হাজার লেয়ার মুরগির মধ্যে এগারশত মুরগি পানি বন্দী
অবস্থায় বেশির ভাগই খাদ্যের অভাবে মারা যায়। এতে বুঝা যায় বন্যায় কি পরিমান
মাছ ও মুরগীর খামার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আকস্মিক বন্যার ব্যাপারে কারো কোনো
ধারণা ছিল না। যার কারণে কোনো খামারিই আগে ভাগে মুরগি সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ
পায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা সরকারের সহযোগিতা না পেলে সংকটে পড়বে দেশের
ডিম ও মুরগির বাজার।
কুমিল্লা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা চন্দন কুমার
পোদ্দারের দেওয়া তথ্য মতে শুধুমাত্র কুমিল্লা জেলায় চার হাজারেরও বেশি
গবাদি পশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুই লাখ নয় হাজার বিভিন্ন জাতের
গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা এক লাখ বিশ হাজার, ১৬টি
মহিষ, ৩০ হাজার ছাগল ও ৭০০ ভেড়া। তার মধ্যে মারা গেছে ৩৫টি গরু, তিনটি
মহিষ, ১৭১টি ছাগল এবং সাতটি ভেড়া। এছাড়া ২ হাজার ২১৮টি খামারে ১৩ লাখ ৬৬
হাজার হাঁস-মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ১০ লাখ ২২ হাজার মুরগি এবং ২
সহস্রাধিক হাঁস। তবে এটি আমাদের চূড়ান্ত তালিকা নয়। প্রাথমিকভাবে তালিকাটি
তৈরি করা হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে
পরবর্তীতে চূড়ান্ত তালিকা করা হবে।
বন্যার পানিতে কুমিল্লা ছাড়াও তিন
জেলায় ডিম পাড়া লেয়ার মুরগি, ব্রয়লার মুরগি, সোনালি মুরগি, মুরগির বাচ্চা
অনেক মারা গেছে । একই সঙ্গে মুরগির খাবার নষ্ট হয়েছে প্রায় পাচঁ হাজার টন।
আবার প্রায় চার হাজার খামারে জিনিসপত্র ও স্থাপনা নষ্ট হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত
খামারও মাছ চাষিদের মাছও খামার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সহায়তা,
বন্যাকবলিত এলাকায় মাছের পোনা বিতরণ, বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায়
খামারও মাছ চাষীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।