দ্বিতীয় পর্ব
আমার
পত্রিকা পড়া শুরু হয় কলেজ-জীবনে। স্কুলে কোনো পত্রিকা রাখা হতো না। কথাটা
এরূপ- গ্রামের স্কুলে পত্রিকা রাখার ব্যবস্থা ছিল না। পরে ডাকযোগে পত্রিকা
আনার ব্যবস্থা হয়। দৈনিক পত্রিকা আসত ৩/৪ দিন পর। তারপরও স্যারেরা মনোযোগ
সহকারে পড়তেন। বাবা শিক্ষক ছিলেন, কখনও কখনও কোনো পত্রিকা বাড়ি নিয়ে আসতেন।
পরের দিন স্কুল-অফিসে জমা দিতে হতো। বলা যেতে পারে স্কুল জীবনে পত্রিকা
দেখেছি, পড়িনি।
১৯৬১ খ্রি: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হই। তখন
কলেজটি সামগ্রিকভাবে রানীদিঘির পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত। ধর্মপুরে ডিগ্রি শাখার
কাজ চলছে। বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক শাখায় কলেজ অভ্যন্তরে ব্যাঙপুকুরে পূর্বপাড়
মসজিদ বলা যাবে না, নামাজের ঘর এবং রিডিং রুম ছিল। এই রিডিং রুমে পত্রিকা ও
ম্যাগাজিন টেবিলে শক্ত করে টিনের পাত দিয়ে বাঁধা থাকত, ছাত্ররা অবসর সময়
পড়ত। অনেক সময় পড়ার সুযোগ পাওয়া যেত না। আমি তা দেখেছি, ঘুরে ঘুরে
পত্রিকা-ম্যাগাজিনগুলো দেখেছি, কিন্তু পড়তে বসিনি।
আমি ছাতিপট্টি
সুপারিবাগানে গুহ পরিবারে থাকি। এই বাসায় প্রতিদিন দু’টি পত্রিকা দুপুরে
হকার দিয়ে যেত। হকার দিয়ে যেত ‘ঞযব ঝঃধঃবসধহ’ (স্টেটম্যান), আর অভয়
আশ্রম-এর পক্ষ থেকে পাঠানো হতো ‘লোকসেবক’ পত্রিকা। দু’টি পত্রিকাই ভারতীয়।
অভয় আশ্রম থেকে যিনি পত্রিকাটি দিতে আসতেন, তিনি সাদা পোশাকধারী কংগ্রেসী
মুসলমান ভদ্রলোকের নামটি মনে করতে পারছি না। তখন ‘লোকসেবক’ পত্রিকায়
‘শৈলমারীতে সুভাস’ নামে ধারাবাহিক একটি লেখা শৈলেস দে নামে একজন সাংবাদিক
লিখতেন। এ লেখাটিতে নেতাজী সুভাস বসুর অন্তর্ধানের বিচিত্র সব কাহিনি এমন
চমৎকার ভাবে উল্লেখ করা হতো, বিকেলে দালানের সিঁড়িতে বসে গো-গ্রাসে গিলে
খাওয়ার মত মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। এতে পত্রিকা পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এদিকে
ইংরেজি ‘স্টেটম্যান’ পত্রিকাটি একজনই পড়তেন। তিনি অধ্যাপক অজিতকুমার গুহের
পিতৃদেব স্বর্গীয় নৃপেন্দ্র মোহন গুহ। এই পত্রিকা না পড়া পর্যন্ত অস্থিরতায়
ভোগতেন। পত্রিকাটি কখন হকার দিয়ে যাবে দুপুরের দালানের বারান্দায় অপেক্ষা
করতেন। তখন তিনি বাড়ি ভিতর পুকুরপাড়ের ঘরে থাকতেন। জমিদার পুত্র অর্থাৎ
ত্রিপুরা রাজার আইনজীবী মদনমোহন গুহের জ্যেষ্ঠপুত্র, কতটুকু পড়াশুনা
করেছেন, অর্থাৎ কতটা ডিগ্রিধারী ছিলেন তা জানতাম না। ব্যক্তিগত জীবনে
ক্রীড়াবিদ ছিলেন, ফুটবল খেলতেন এবং গুহ পরিবার কেন্দ্রিক একটি ফুটবলের
ক্লাব ছিল- ইয়ংম্যান ক্লাব। সম্ভবত তিনি এই ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
আমি যখন তাঁদের বাসায় থাকি, তাঁর বয়স সত্তরোর্ধ। চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ
হতে চলেছে, তাই পত্রিকাটি পড়তে অসুবিধা হচ্ছে চশমা দিয়েও ভালো দেখতে
পারছিলেন না। বিকেলে আমি কলেজ থেকে এলে আমাকে ডেকে পাঠাতেন- স্টেটম্যান
পত্রিকা পড়ে শোনানোর জন্য। সে এক মহাবিপদ। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র, ইংরেজিতে
কাঁচা, পত্রিকার ভাষা আমার কাছে দুর্বোধ্য, উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তিনি
প্রথম বলতেন ৯নং পৃষ্ঠা খোল এখানে খেলার সংবাদ আছে, পড়ে শোনাও। পড়তে
চেষ্টা করি, উচ্চারণ ঠিক করে দিতেন, অর্থ বলে দিতেন। এভাবে পৃষ্ঠা ধরে ধরে
পড়ে শোনাতে হতো। আমি এখন আমার সেদিনের বিপদের কথা কিভাবে বুঝাব। অনেক সময়
কলেজ দুটি হলে বাসায় দেরি করে আসতাম। নির্ধারিত সময়ে খোঁজ নিয়ে যখন আমাকে
পাওয়া যেত না, আপসোস করতেন, কষ্ট করে বড় বড় হরফের হেডিংগুলো পড়তেন। আজ
সেদিনের কথা মনে করে আকাশবিদারী চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। যদি ধৈর্যধরে এই
বৃদ্ধ শ্রদ্ধাভাজন নৃপেন্দ্র মোহন গুহকে কষ্ট করে পত্রিকাটি পাঠ করে
শোনাতাম তাহলে কিছুটা হলেও ইংরেজি ভাষা, ইংরেজি শব্দার্থ এবং ইংরেজি
পত্রিকার মাহাত্ম ধারণ করতে পারতাম। সেই সময় ভারতবর্ষে ‘স্টেটম্যান’
পত্রিকাটি ছিল সংবাদপত্র জগতের আইকন। যাঁরা এ পত্রিকাটি গ্রাহক, পাঠক
ছিলেন, তাঁরা অনেকটা বোদ্ধা পাঠক হিসেবে সম্মানীয় ছিলেন। বলে রাখি- তখন
প্রবাদ ছিল যে, ইংরেজি শিখতে হলে ‘স্টেটম্যান’ পত্রিকা পড়া আবিশ্যিক। বুঝি
নাই। বোকার ঢেঁকি ছাড়া আর কি ?
গুহ পরিবারে কলকাতার দুটি সিনেমা বিষয়ক
পত্রিকা মেগাজিন রাখা হতো- উল্টোরথ ও জলসা। এই দুই ম্যাগাজিন নিয়ে
কাড়াকাড়ি। কার আগে কে পড়ার সুযোগ পাবে। আমি তো ছাত্র। আমার জন্য নীতিগত
নিষিদ্ধ গ্রন্থ। পড়ার ক্ষতি হবে। গ্রাম থেকে এসেছি, বাবা কষ্ট করে টাকা
পাঠান। সুতরাং পাঠ্যবই হলো আমার জন্য মহাগ্রন্থ। কিন্তু বয়স- ইচ্ছা-সুযোগ
সন্ধানী অভিযাত্রা তা তো নীতি দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। একসময় মনে হতো-
সিনেমা বিষয়ক বই দুটি পড়তে না পারলে এ জীবনের কোনো অর্থ বা সার্থকতা নেই।
তাই কত লুকোচুরি করে রাত জেগে এসব ম্যাগাজিন পড়েছি- আজ তা রূপকথা। ইংরেজি
ম্যাগাজিন টাইমস (ঞরসবং), ও সিনেমার পত্রিকা ফিলম ফেয়ার বাসায় বেনুদা
(অশোককুমার গুহ, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর লোক ধরে নিয়ে
যায়। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধে শহিদ। তিনি পশ্চিম
পাকিস্তানের তিনটি কোম্পানির রিপেজেন্টটিটিব (জব) ছিলেন।) আনতেন। মুগ্ধতায়
বোম্বের নায়ক-নায়িকাদের ছবিগুলো দেখতাম। আমার সুযোগ ছিল। কারণ, বেনুদার
মালপত্রের হিসাবপত্র আমি রাখতাম। এই সুযোগে লুকিয়ে লুকিয়ে রুমে নিয়ে গিয়ে
তা দেখতাম। পাকিস্তান আমলে দেশে দুটি বিনোদন বিষয়ক পত্রিকা বের হতো-
চিত্রালী ও সিনেমা। কাজেই পত্রিকা পাঠক হিসেবে ছাত্রজীবনে তেমন কোনো আগ্রহ
বা পড়ার মাধ্যমে যে খবরাদি জানার নেশা তা তেমনভাবে সৃষ্টি হয়নি।
চাকরি
জীবনে একসময় পত্রিকা এক ধরনের বন্ধু হয়ে যায়। ৪৬ বছর নিয়মিত একটি পত্রিকার
গ্রাহক হিসেবে নিজেকে পাঠক হিসেবে এমনই অভ্যস্ত করে তুলি- তা অনেকটা
বৈবাহিক সম্পর্কের মতো। সকালবেলা পত্রিকাটি না পড়লে দিনটাই অন্ধকার মনে
হতো। পত্রিকা পড়ার ব্যাপারে আমার একধরনের মানসিক সংকীর্ণতা রয়েছে, বাসায়
পত্রিকাটি আমি প্রথম পাঠক হতে না পারলে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। কারও পড়া
পত্রিকা যেন তালাক দেয়া পাত্রীর মতো মনে হতো। অনেক সময় পত্রিকাটি হাতে
পেয়েছি, পড়ার সময় নেই, লুকিয়ে রেখে দিয়েছি, যেন অন্য কেই না পড়তে পারে।
এরূপ আচরণটা কিভাবে বিবেচ্য, তা জানি না, অভদ্রতার সীমাহীন আচরণ।
তা
বুঝি, কিন্তু স্বভাব পরিবর্তন করতে পারিনি। এখনও। জানি না কী অভিমানে ১
আগস্ট ২০২৪ থেকে আর বাসায় পত্রিকায় রাখব না- সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য
মোবাইল ও টেলিভিশনকে দায়ী করতেও মন চায় না। তবে এ দুটোর সামান্যতম হলেও
ভূমিকা আছে।
চাকরি জীবনে আমি যে কোনো ম্যাগাজিন বা সাময়িকপত্রের
নির্ভেজাল পাঠক ও সংগ্রহকারী। কলকাতার দেশ পত্রিকা পাগলের মতো হন্যে হয়ে
জোগার করেছি, সংগ্রহ করেছি। দেশে যেদিন থেকে বিচিত্রা, বোরবার ও সচিত্র
সন্ধানী পত্রিকা বের হয়েছে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যা আমার সংগ্রহে
ছিল। মন দিয়ে পড়েছি। আমার মনে বড় কষ্ট। আমি যখন কুমিল্লা শহরের
দিগম্বরীতলার শহীদ নিতাই সাহার বাসা থেকে ঠাকুরপাড়া কালীতলা কামিনীকুমার
চন্দের বাসায় ভাড়া বাসায় আসি, তখন আমার সংগৃহীত ম্যাগাজিনগুলো রাখার কোনো
ব্যবস্থা করতে পারিনি। এদিকে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি। বাধ্য হয়ে তিনটাকা সের
দরে ১৮০০/- (আঠারশ) টাকায় সব বিক্রি করে দিই। এই সর্বনাশের দায় আজ অনুভব
করি- আত্মহত্যার অপর নাম হলো বিদ্যাদেবীর প্রসাদ বিক্রি করে নি:স্ব হওয়া।
আমার জীবনে এতটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে আজ অনেকভাবেই পঙ্গু করে দিয়েছে। আমি
বর্তমানে যে অঙ্গনে বিচরণ করি, আমার জ্ঞানভান্ডারে যে অস্ত্রসমাহার ছিল,
যেকোনো যুদ্ধে জয়ী হতে কারও কাছে হাত পাততে হতো না। একথা যখন আমার মনে হয়,
আমি সাময়িক অস্থির হয়ে পড়ি। অসহায়বোধ করি। নি:স্ব দরিদ্র একজন পথের ভিখারি
মনে হয় নিজেকে। আজও সাময়িক পত্র অর্থাৎ ম্যাগাজিন কিনি, পড়ি, সংরক্ষণ করি।
এই প্রায়শ্চিত্ত থেকে নিজেকে দায়মুক্তির জন্য যখন আমার চাকরি করা শেষ হয়,
অবসরগ্রহণ করি তখন লেখালেখিতে মনোযোগী হই এবং একটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের
উদ্যোগ গ্রহণ করি। ‘অরণিকা’ সাহিত্য পত্রিকাটি হলো আমার দায়মুক্তির
হাতিয়ার, বিদ্যাদেবীর প্রতি ‘অর্ঘ্য’। এ ইতিহাস একদিন লিখব।