বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
আমার সোনার বাংলা
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:২৪ এএম আপডেট: ১১.০৯.২০২৪ ১:৫১ এএম |


 আমার সোনার বাংলা

স্বদেশী যুগে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চারণ কবির ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বাউলের সুর, ভাটিয়াল সুরে রামপ্রসাদী সুর গান গেয়ে দেশপ্রেমের বার্তা বাঙালির ঘরে ঘরে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সত্য রূপটিকে বাঙালির চোখে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি...........................
-এমন সহজ ভাষায়, এতখানি দরদ দিয়ে দেশের কথা এর আগে আর কেউ বলেননি। অবশ্য কবিবাক্যে এক-আধটু অত্যুক্তি থাকবেই। অর্ধেক মানুষ যেখানে খেতে পায় না, পরতে পায় না, সে দেশ সোনার দেশ হবে কি কবে? দেশবন্দনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘চির-কল্যাণময়ী তুমি ধন্য, দেশ বিদেশে বিতরিছ অন্ন॥’ এখানেও সেই অত্যুক্তি। জন্মবধি দেখে আসছি অন্নের জন্যে বছরের পর বছর বিদেশের দোরে ধর্না দিতে হয়েছে তথাপি দেশমাতাকে বলেছেন অন্নপূর্ণা। মনে রাখতে হবে যে কবির সত্য স্ট্যাটিসটিকসের সত্য নয়, সম্ভাব্যতার সত্য। উদ্যোগ আয়োজন ঠিকভাবে হলে সুজলা সুফলা বাংলাদেশের পক্ষে নিজ প্রয়োজন মিটিয়ে অন্ন বিতরণ করা বাস্তবিক পক্ষে অসম্ভব হত না। কাজেই সোনার বাংলা বললে কিছু অন্যায় বলা হয় না। হোক না কাদা মাটির দেশ, কিছু বা কাঁকর বালির-তথাপি সোনার দেশ কারণ কবি অন্যত্র বলেছেন, দেশটা মৃন্ময় নয়, চিন্ময় অর্থাৎ দেশটা মাটি দিয়ে গড়া নয়, মানুষ দিয়ে গড়া। মানুষগুলো সোনার মানুষ, সেজন্যেই সোনার বাংলা। এমন সরল সহিষ্ণু স্নেহকাতর, এমন স্বল্পে সন্তুষ্ট সদালাপী মানুষ আর কোথায় আছে? অপর পক্ষে এমন বুদ্ধিদীপ্ত তেজোদ্দৃপ্ত আদর্শবাদী ছেলেমেয়েই বা আর কোথায় গেলে পাব? 
জ্ঞানী গুণী কবি শিল্পী সাহিত্যিকের সত্যদৃষ্টিতেই দেশের সত্য রূপ ধরা পড়ে। তাঁরাই দেশকে ঠিকভাবে চেনেন এবং তাঁদের মারফতেই দেশকে আমরা চিনতে শিখি। যাঁরা দেশকে চিনতে শেখান তাঁদের  নামেই দেশের পরিচয়। কত রাজা বাদশা রাজত্ব করে গেলেন কিন্তু লোকে বলে রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ। সব দেশেই এই-ইংরেজরা বলে, শেক্সপীয়ারের ইংলন্ড, জনসনের লণ্ডন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোলরিজের লেক ডিষ্ট্রিক্ট। সকল দেশেই মুষ্টিমেয় কজনকে দিয়ে জাতির পরিচয়, বাদ বাকী সকলেই অজ্ঞাতকুলশীল। কোন জাতি যখন সেই পরিচয়কে কর্মে কথায় আচরণে প্রকাশ করে তখন সেটিই তার রক্ষাকবচ হয়ে তাকে সকল দুর্দৈব থেকে রক্ষা করে। বাংলাদেশে আজ যে দুর্দিন দেখা দিয়েছে তার প্রধান লক্ষণ, বাঙালির আচারে ব্যবহারে, কর্মে কথায় চিন্তায় কোথাও প্রমাণ নেই যে এ দেশ রামমোহনের বাংলাদেশ, বিদ্যাসাগর বঙ্কিমের বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, লালন শাহ হাসন রাজার বাংলাদেশ।আজকের বাংলাদেশ শুধু যে এঁদের অস্বীকার করেছে এমন নয়, সর্বপ্রকারে এঁদের অবমাননা করেছে। ফলে বাংলাদেশ আজ সকলের দ্বারা উপেক্ষিত এবং প্রত্যাখ্যাত। বড়কে যে ছোট করতে যায় সে নিজে কতখানি ছোট হয়ে যায় সে কথা তার মনে থাকে না।
বাঙালি শক্তিধর জাতি, অনেক সদগুণের অধিকারী, কিন্তু তার পুণ্যফল সে যে পুরোপুরি ভোগ করতে পারছে না তার কারণ বাঙালির স্বভাবে এবং জীবনে গৃহস্থালির অভাব। নিজের শক্তি সামর্থ্য গুছিয়ে গাছিয়ে রয়ে সয়ে ও ব্যবহার করতে জানে না, ওর মধ্যে প্রচুর অপচয়। অবশ্য বেহিসেবী, উড়নচণ্ডী বলে ওকে গাল দেওয়া যেমন সহজ তেমনি সেই কারণেই আবার ওর আকর্ষণকে কাটিয়ে ওঠা কঠিন। দোষে গুণে মিলিয়ে বাঙালি জীবন বড় বৈচিত্র্যময়। এদেশে যে বড় বড় কবি শিল্পী সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে তারও মূলে এখানকার জীবনের ঐ বৈচিত্র্য। কারণ শিল্প সাহিত্য ঐ বিচিত্রারই সৃষ্টি। কাজেই বাঙালিকে বুঝতে হলে তার দোষগুণগুলোকে একটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে বাংলাদেশের জীবন কোন কালেই নিথর নিশ্চল নিস্তরঙ্গ ছিল না। জীবনটা একইভাবে ছন্দোবদ্ধ মন্দাক্রান্তা তালে চলেনি। ছোট্ট পাহাড়ী নদীটির মতো আপাতদৃষ্টিতে ভারী একটি ভালোমানুষি ভাব আছে। শীতে গ্রীষ্মে হাঁটু জল, সামান্য তিরতিরে একটু স্রোতে, দেখলে মনে হয় একান্ত নির্জীব। কিন্তু বর্ষাগমে সেই শীর্ণকায়া পর্বতদুহিতা হঠাৎ একদিন খরকায়া হয়ে ওঠে, এমন প্রচণ্ড আকার ধারণ করে যে মাঠ ঘাট লোকালয় ডুবিয়ে ভাসিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিধ্বস্ত করে দেয়। বাঙালি চরিত্রের মধ্যেও এমনি একটা বেপরোয়া বেহিসেবী হঠকারী ভাব আছে। শ্যামলে কোমলে বাঙালি এমন শান্ত সুশীল মূর্তি ধারণ করতে পারে সে কথা ভাবা কঠিন। ওর বাইরের চেহারায় তার ভেতরের স্বভাব মিল নেই। আবার স্বভাবেও একটা দ্বৈত ভাব আছে। একই সঙ্গে সমাজে দুটো মননধারা পাশাপাশি চলছে। নব ন্যায়ের দেশ, চুলচেরা তর্কে তার পরম আনন্দ, যুক্তি তর্কে অসীম আগ্রহ। বিদ্বজ্জন সমাজ তাই নিয়েই মেতে থাকত; কথায় কথায় তর্ক-সভা বসত। পণ্ডিতেরা বিধান দিতেন, জনসমাজ তাই মেনে নিত। সাধারণ মানুষের স্বভাবই ঐ, সে বিনাবাক্যে মেনে নেয়। কিন্তু আমাদের নির্বাক জনসাধারণের মধ্যে ঐ পাহাড়ী নদীর মতো একটা প্রচণ্ড বেগ স্তব্ধ হয়ে আছে। বেগ না বলে একে আবেগ বলা যেতে পারে। পূর্বে যে দ্বৈত ভাবের কথা বলেছি তার দ্বিতীয়টি হল এই আবেগপ্রাবল্য। এক দিকে তার তার্কিকতা অপর দিকে আবেগপ্রবণতা। আবেগপ্রধান জাতের জীবনস্রোতে যে কোন সময় উত্তাল হয়ে উঠতে পারে। বড় রকমের ঢেউ উঠলে চকিতে কূল ছাপিয়ে যায়। একদা নবদ্বীপেরে নিমাই ভাবের বন্যায় সমস্ত বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলীর দেশ, মনটা অমনিতেই রসে জবজবে হয়ে আছে, একটু তাপের সঞ্চার হলে একেবারে বিগলিত ধারায় প্রবাহিত হয়। রস আবার নানান রকমের। আদিতে যেমন মোহন মূর্তি, অন্তে তেমনি ভয়াল। রস রোষে পরিণত হতে বিলম্ব হয় না। 
যুক্তি আর আবেগ দুই বিরোধী মনোভাব। বাঙালি চরিত্রে আবেগই প্রাধান্য পেয়েছে। নিয়ায়িকের দেশ হলেও যুক্তি বিচার অতি স্বল্প পরিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাচীন গ্রীসের নৈয়ায়িকদের মতো বাঙালি ন্যায়শাস্ত্রীদের তর্ক বিচারও নিতান্ত ংড়ঢ়যরংঃৎু তে পরিণত হয়েছিল। জনসাধারণের মনে তার কোন প্রভাব বিস্তার হয়নি। আমাদের সমাজে ইদানীং কালে যুক্তিবাদের যেটুকু প্রচার হয়েছে সেটুকু পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার ফলে। তাও খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি। ইংরেজী শিক্ষার ফলে বাঙালি মনীষার যে অত্যাশ্চর্য স্ফুরণ হয়েছিল আজ তা নির্বাপিতপ্রায়। কারণ সে মনীষাকে আমরা পড়ে-পাওয়া জিনিস হিসাবে দেখেছি বিচার বিশ্লেষণ করে তাকে বুঝবার চেষ্টা করিনি। রামমোহনের সংস্কারমুক্ত উদার মনোভাব আমাদের উচ্চশিক্ষিত সমাজ আজও পুরোপুরি বুঝতে পারে নি। বিদ্যাসাগর সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে সমভাবে মিশেছিলেন কিন্তু কৌতুকের বিষয় যে তাঁর সমকালে শিক্ষিত অশিক্ষিত বেশির ভাগ মানুষই তাঁকে শত্রু জ্ঞান করেছে। 
রবীন্দ্রনাথকে কল্পনাবিলাসী আকাশবিহারী কবি হিসাবেই দেখেছি। অথচ আমাদের দেশ এবং সমাজ সম্বন্ধে, দেশের অশিক্ষা অস্বাস্থ্য অব্যবস্থা অভাব অনটনের কথা তিনি যতখানি ভেবেছেন এবং বলেছেন কোন কোন দেশে কোন কবি কোন-কালে তা করেননি। শুধু বলে এবং লিখেই ক্ষান্ত হননি হাতে কলমে কিছু কাজও করেছেন। এঁরা ছাড়াও আরো অনেকে অনেক কিছু করেছিলেন কিন্তু ফল যতটা হতে পারত তা হয়নি। তার কারণ আমরা শুধু যে যুক্তিবিমুখ এমন নয়, কর্ম-বিমুখও বটে। ভাবের দোলায় দোল খেতে পারলে আর কিছু চাই না। ধর্মে যতখানি মতি কর্মে ততখানি মতি নেই। 
দেখা যাচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মনীষা যেভাবে দেশকে গড়তে চেয়েছিল তাকে সুনির্দিষ্ট পরিণতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দেশের অগ্রগতি বলতে বুঝতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান তালে অগ্রগতি। শহরাঞ্চল আর গ্রামাঞ্চল সুয়ো-রানী দুয়োরানী হলে চলবে না, উভয়ের প্রতি সমদৃষ্টি চাই। চাষের উন্নতি আর শিল্পোন্নতি একসঙ্গে চলবে, শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে হবে, খাদ্যের সঙ্গে আনন্দের উপকরণ যোগাতে হবে। অভাব কমবে সচ্ছলতা বাড়বে; উচ্চে নীচে ধনী দরিদ্রে শিক্ষিতে অশিক্ষিতে বৈষম্য কমবে। আমাদের নেতৃবৃন্দ একমাত্র রাজনীতিকেই সর্বরোগহস্তা বলে জেনেছেন। ফলে দেশ যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। অগ্রগতি যেটুকু হবার সেটুকু নেতাদের হয়েছে; অর্থাৎ কিনা দেশকে পেছনে ফেলে তাঁরা নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন ক্ষমতা অধিকারের ব্যগ্রতায়। রবীন্দ্রনাথ সেই স্বদেশী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন রাজনৈতিক অধিকার লাভের অপেক্ষায় বসে না থেকে এখন থেকেই দেশ গড়বার কাজে হাত দিতে হবে। দেশের যে অংশটিকে আমরা নিজের হাতে গড়ে তুলব সে অংশটিই আমাদের অধিকারে আসবে। তাঁর কথায় সেদিন কেউ কর্ণপাত করেনি। কাজেই আগে থেকে প্রস্তুত না থাকলে যা হয় স্বাধীনতা যেদিন এল সেদিন দেশসুদ্ধ লোক অপ্রস্তুত হল। স্বাধীনতার পরে তিপ্পান্ন বছর কেটে গিয়েছে এখনও দেশের অগণিত মানুষ অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন। অভাব অশিক্ষা অস্বাস্থ্য সর্বব্যাপী। এখানেই প্রমাণ যে দেশ স্বাধীনতা পেলেও আমরা দেশকে পাইনি।
জীবন হবে সর্বতোমুখী। বহুবিধ চরিতার্থতার সংযোগ জাতির জীবন সমৃদ্ধ হয়। রবীন্দ্রনাথ সেই জীবনচর্চাই চেয়েছিলেন। তাঁর সংগীতে সাহিত্যে সেই পরি-পূর্ণ জীবনের বার্তা। একথা মানতেই হবে যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে মোটামুটি বাংলাদেশের রবীন্দ্রযুগ বলা যেতে পারে। রবীন্দ্র-সংসার থেকে বাঙালি জাতি নিঃসন্দেহে কিছু রস সংগ্রহ করেছিল যার ফলে বাঙালি জীবন সহজ সুন্দর সরস এবং সজীব হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে জীবন গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরেই অনেকখানি শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। বাঙালির বহুমুখী জীবন এখন একমুখী, বলা যেতে পারে একরোখা। একমাত্র রাজনীতির চর্চা অন্য সকল চর্চাকে ব্যাহত করেছে। পিঠে রাজনীতির একটি কুঁজ তার চাপে সে ঝুঁকে পড়েছে। ঐ কুজটিকে সামলাতে না পারলে সে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। জীবন যদি একদিকে অত্যাধিক ঝুঁকে পড়ে-ইংরেজীতে যাকে বলে ষড়ঢ়-ংরফবফ হয়ে যায়-তাহলে আর জীবনের শ্রী ছাঁদ কিছু থাকে না। তাছাড়া যেখানে রাজনীতিই একমাত্র নীতি সেখানে সর্বপ্রকারের দুর্নীতি আশকারা পায়।
রবীন্দ্রনাথ-অন্তত ইতিহাসের অতি তীক্ষèদৃষ্টিসম্পন্ন সমীক্ষক ছিলেন। বাঙালি জীবনধারাকে তিনি যতখানি জেনেছিলেন, বুঝেছিলেন এমন আর কেউ নয়। বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ভারতবর্ষে চিরদিন সমাজতন্ত্র প্রবল, রাষ্ট্রতন্ত্রের ভূমিকা অপ্রধান। বলেছেন, দেশ ছিল দেশের লোকের, রাজা ছিল তার এক অংশে মাত্র, মাথার উপরে মুকুটটা যেমন থাকে আলগা। সমাজ পরিচালনা সমাজই করেছে। বিদ্যা দানের ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছেন, ক্ষুধিতকে অন্ন, ধার্মিককে মসজিদ মন্দির, অপরাধীকে দণ্ড, শ্রদ্বেয়কে শ্রদ্ধা। রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্র-তন্ত্রের পতনে দেশের অধঃপতন-দৃষ্টান্তস্বরূপ গ্রীস রোমের অকালমৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতবর্ষে রাজায় রাজায় কত মারামারি কাটাকাটি গেল, কত রাজ্য সাম্রাজ্যের পরিবর্তন হল তথাপি এ দেশ শতাব্দীর পর শতাব্দী আত্মরক্ষা করতে পেরেছে। বিদেশী রাজ তাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারেনি, কারণ স্বদেশী সমাজ তার রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। আজ যে রাষ্ট্রকে সর্বনিয়ন্তা হিসাবে দেখা হচ্ছে এ আমাদের দেশাচার নয় বিদেশী সমাচায়। পরানুকরণ প্রবৃত্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজ বুদ্ধির ‘পরে আমরা যে আস্থা হারিয়েছি, এটি বড় সুলক্ষণ নয়। 
রাষ্ট্র যদি সর্বশক্তিমানও হয় তাহলেও দেশের সকল মানুষের সকল অভাব অভিযোগ সে দূর করতে পারে না। সর্বার্থসাধক রাষ্ট্রে বাস করেও রুশ জনগণ অভাবক্লিষ্ট। রাষ্ট হচ্ছে আকাশের চাঁদ। আকাশে চাঁদ ওঠে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হয় কিন্তু আমার ঘর আলো হয় না। সেখানে আমাকে প্রদীপ জ্বালতে হয়। নিজের ঘর আমাকে নিজেই সামলাতে হবে। চাঁদের আলো যেমন দরিদ্রের কুটিরে আর রাজার প্রাসাদে তারতম্য করে না, রাষ্ট্রও তেমন ধনী দরিদ্র সক্ষম অক্ষমকে সমদৃষ্টিতে দেখবে এটুকুই তার কাছে কাম্য। রাষ্ট্র সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন অভিভাবক মাত্র। ইংরেজের আমলেই আমরা প্রথম শাসন কর্তৃপক্ষের মুখাপেক্ষী হতে শিখেছি। এর আগে স্থানীয় সমস্যাদি স্থানীয় সমাজই সমাধান করত। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী যুগ থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং সেদিনকার নেতৃবৃন্দের আবেদন নিবেদনের পালা নিয়ে উপ-হাস করেছেন। ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করে দেশবাসীকে আত্মনির্ভর হতে বলেছিলেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আজকের নেতৃবৃন্দও সেই ভিক্ষাবৃত্তিই শেখাচ্ছেন। একটু তার রকমফের হয়েছে এই যা। আমাদের দাবি মানতে হবে-যতই জোর গলায় বলি না কেন এটাও আসলে ভিক্ষাবৃত্তি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “চোখ রাঙিয়ে ভিক্ষা করা এবং গলা মোটা করে গভর্নমেন্টকে জুজুর ভয় দেখানোকে আমরা বীরত্ব বলে গণ্য করি।” এ কথার সত্যতা অর্থাৎ আমাদের নকল বীরত্ব আজ আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। অনুনয় বিনয়েরও প্রয়োজন নেই, চোখ রাঙাবারও  প্রয়োজন নেই। আমাদের শ্রমের যোগ্য পারিশ্রমিক দিতে হবে বললে আর কিছু বলবার বাকি থাকে না। শ্রমেরও মান থাকে, দাবিরও মান থাকে। নেতারা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে লোককে কাজ থেকে নিবৃত্ত করছেন, অপর পক্ষে  ভাতা এবং মাইনে বৃদ্ধির দাবিতে উশকিয়ে দিচ্ছেন। কাজ না করে বর্ধিত হারের দাবি ভিক্ষা ছাড়া আর কি? এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি উব্ধৃত করছি “যার অভাব আছে তার অভাবমোচন করে শেষ করতে পারব না, বরঞ্চ বাড়িয়ে তুলব, তার অভাবমোচনের শক্তিকে জাগিয়ে তুলত হবে সেটাই বড় কথা!”
বাঙালি চরিত্রে এমনিতেই একটু শৈথিল্য আছে, তার উদামকে উদ্দীপনার তাপে জীইয়ে রাখতে হয় নতুবা সে যেমন দপ করে জ্বলে ওঠে তেমনি আবর ধপ করে নিভে যায়। এখানেই নেতৃত্বের মাহাত্ম্য, সেজন্যে ঐ স্বভাব-শৈথিল্য সত্ত্বেও বাঙালি এককালে অসাধ্য সাধন করেছে। সে তুলনায় আজকের নেতৃত্ব কতখানি ব্যর্থ তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের জীবন আজ বলতে গেলে রুদ্ধগতি। সরকারি অফিসে বেসরকারী দপ্তরে, কল-কারখানায় ইস্কুলে কলেজে কাজ নামে মাত্র চলছে। বসে বসে মশা মারলেই মসিজীবী হওয়া যায়, শিক্ষাদানে বিরত থেকেও শিক্ষক হওয়া যায়, একছত্র না পড়েও ছাত্র হওয়া যায়। এই সর্বব্যাপী শৈথিল্য প্রধানত বর্তমান নেতৃত্বের অবদান। 
আজ আমাদের জাতীয় জীবনের যে দৈন্য দেখা দিয়েছে তা প্রধানত নেতৃত্বের দৈন্য। নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে যে কী বিষম বিপত্তি ঘটে আজ সবাই তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ধর্মনীতিতে যত মত তত পথ যতখানি উদারতা দেখিয়েছে রাজনীতিতে যত মত তত পথ ততখানি সংকীর্ণতা এবং বৈরিতা সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেকটি দল নিজ মতকে অভ্রান্ত মনে করে। তার নিজ মতে বা পথে যদি দেশের ভাল হয় তবেই তা গ্রাহ্য, অন্য মতে অন্য ভাবে কেউ ভাল করতে গেলেও তা বরদাস্ত করা হবে না। যত সব অভ্রান্ত মতবাদের ফাঁদে পড়ে দেশবাসী বিভ্রান্ত। অন্তহীন তর্ক, অর্থহীন বাদ প্রতিবাদ, অবিরাম বিরোধ প্রতিরোধে সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত। আমাদের ন্যায়বাগিশ পূর্বপুরুষদের তার্কিক স্বভাব আমাদের রক্তের মধ্যে সঞ্চারিত। বাঙালির এই স্বভাবের উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “কর্ম উদ্যোগের আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত বিপরীত পক্ষ নিয়ে বন্ধ্যা বুদ্ধির গর্বে প্রতিবাদ করতে তার অদ্ভুত আনন্দ, সমগ্রদৃষ্টির চেয়ে রন্ধ্র সন্ধানে ভাঙন-লাগানো দৃষ্টিতে তার ঔৎসুক্য। ভুলে যায় যে, এই তার্কিকতা নিস্কর্মা বুদ্ধির নিষ্ফল শৌখিনতা মাত্র।” 
বাঙালির ঐক্যবোধের অভাব-ঐ একটি দোষ তার গুণরাশি নাশ করেছে, তার শক্তি হ্রাস করেছে। নতুবা বাঙালির দুর্জয় শক্তি নব সার্থকতায় বাঙালি জীবনকে শ্রী সৌন্দর্য এবং ঐশ্বর্যে মণ্ডিত করতে পারত। 
ভাবলে দুঃখ হয়, এই যে একান্ত অকারণ ভ্রাতৃহননের নাম হয়েছে বিপ্লব। বাংলাদেশে বিপ্লব কথাটা সারাক্ষণ এমন অবাধে, এমন নির্বিচারে উচ্চারিত হচ্ছে যে, অতি-ব্যবহারে এর গুরুত্ব ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। যথার্থ যে বিপ্লব তা সমাজের সমস্ত শক্তিকে মুক্তি দেয়। দেশে দেশে বিপ্লব-কাহিনী প্রকৃতপক্ষে বিচিত্রবীর্য কাহিনী। আমাদের দলাদলিজাত এই বিচিত্র বিপ্লবে এক দল অপর দলের শক্তিকে প্রতিরোধ করছে। সমাজের অবরূব্ধ শক্তি মুক্তি লাভ না করে ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে। অর্থাৎ বিপ্লব বিপ্লবকেই বাধা দিচ্ছে। বেশ কিছু সংখ্যক আদর্শবাদী নির্ভীক যুবক ইতিমধ্যেই প্রাণ দিয়েছেন। আরো অনেক মূল্যবান জীবন বিনষ্ট হবে। এই শক্তির অপচয় বিপ্লবকেই দুর্বল করছে। বিপ্লব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির কিংবা এক দলের বিরুদ্ধে অপর দলের সংগ্রাম নয়। বিপ্লব অনেক বড় জিনিস। ব্যাপক অর্থে একে বলা যেতে পারে জীবন সংগ্রাম। আমাদের দেশে অগণিত মানুষ কোন প্রকারে কায়ক্লেশে জীবনধারণ করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। মানুষের মতো জীবন ধারণ করতে হ’লে জীবনের ধরন বদলাতে হয়। সমাজ ব্যবস্থার বদল বললেও খানিকটা ছোট করে বলা হয়। চাই জীবন-প্রণালীর আমূল পরিবর্তন। জীবনের জীর্ণতা, কুশ্রীতা, মলিন, দীনতা, ক্ষুদ্রতা দূর হয়ে জীবন সুস্থ সুন্দর আনন্দিত রূপ নেবে-তাকেই বলে বিপ্লব। সে বিপ্লবের কথা জীবন সুস্থ সুন্দর আনন্দিত রূপ নেব-তাকেই বলে বিপ্লব। সে বিপ্লবের কথা রবীন্দ্রনাথ যতখানি বলেছেন কোন দেশের কোন কবি ততখানি বলেননি। বিদ্রোহী বিপ্লবী যৌবনশক্তিকে তিনি যেভাবে অভিনন্দিত করেছেন তেমন আর কে? 
বিদ্রোহী নবীন বীর,
স্থবিরের শাসন নাশন,
বারে বারে দেখা দিবে;
আমি রচি তারি সিংহাসন, 
তারি সম্ভাষণ। 
উল্লেখমাত্র নি®প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথ যাঁদের বিদ্রোহী নবীন বীর বলে সম্ভাষণ জানিয়েছেন, তাঁরা ছুরিকাঘাতে কিংবা ভোজালি হাতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেন না। তাঁদের প্রতিপক্ষ কোন ব্যক্তিবিশেষ নয়। আসল প্রতিপক্ষ আমাদের জীর্ণ ভগ্ন রুগ্ন জীবন। এর প্রতিকারের জন্য মানুষকে রক্ষা করতে হবে, অভাব থেকে, ভয় ভাবনা থেকে, অশিক্ষা থেকে, অস্বাস্থ্য থেকে। অভাবমোচন করতে হলে চাই উৎপাদন বৃদ্ধি, ভয় ভাবনা ঘোচাতে হলে চাই নিশ্চিত ভবিষ্যতে আশ্বাস, অশিক্ষা অস্বাস্থ্য দূরীকরণের জন্মে চাই আনন্দিত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মানুষকে অত্যাচার করে এর কোন সমস্যার সমাধান হবে না। 













সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার অভিযোগ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২