পর্যাপ্ত
মজুত রয়েছে, বাজারে কোনও সংকট নেই। তবু বেড়েই চলেছে চালের দাম। গত দেড়
মাসে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত।
পর্যায়ক্রমে এখনও তা বেড়েই চলেছে। এদিকে চালের দাম আরও বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ
করেছেন আড়তদাররা। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজারে সংকট না থাকা সত্ত্বেও কেন বেড়েছে
চালের দাম?
আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত
সরকারের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারা চালের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাছাড়া
ক্ষুদ্র চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ না পাওয়ায় বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো
একচেটিয়া চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
সরকারিভাবে চালের মূল্য
নির্ধারণের জন্য বাজার মনিটরিং করার কথা থাকলেও তা হয়নি। যার ফলে বাজারে
পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও এক ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বড় বড়
প্রতিষ্ঠান দাম বাড়িয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর। চালের এই
কৃত্রিম সংকট নিরসনে সঠিক উপায়ে বাজার মনিটরিং না করলে অক্টোবর পর্যন্ত
চালের বাজারে অস্থিরতা থাকতে পারে বলে জানা যায়। তবে নভেম্বরে নতুন ধান,
বিশেষ করে আমন কাটা শুরু হলে চালের দাম কমার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন
ব্যবসায়ীরা।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বেশ কয়েকটি অজুহাত দিয়েছেন চালের
আড়তদাররা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশের ১৪ জেলায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে
বিপুল পরিমাণ চাল লাগায় দাম বেড়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম
বেড়েছে। ফলে ৫০ কেজি চালের প্রতি বস্তায় ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
মঙ্গলবার
(১০ সেপ্টেম্বর) পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও আশপাশের কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি
চালের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতিকেজি
দেশি বাসমতি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, নাজির শাইল চাল ৬৮ থেকে ৮০ টাকা, মাঝারি
মানের বিআর ২৮-২৯ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট
বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭৫ টাকা কেজি।
এছাড়াও মোটা স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে
৫৮ টাকা, হাইব্রিড মোটা ৫৬ টাকা। এসব চালের মূল্য মাস দেড়েক আগেও কেজিপ্রতি
দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত কম ছিল বলে জানান ব্যবসায়ীরা। নতুন ধান আসার আগ
পর্যন্ত চালের মূল্য আরও বাড়ার শঙ্কায় রয়েছেন তারা।
ঋণ না পাওয়ায় ছোট
আকারের প্রায় পাঁচ হাজার চালের মিল বন্ধ হয়ে আছে বলে জানান পুরান ঢাকার চাল
ব্যবসায়ী মেসার্স জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির মালিক মো. শাহীন মিয়া। তিনি বলেন,
ছোট ছোট মিলগুলো ঋণ পায়নি। ফলে মিল মালিকরা চাল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন।
এতে চালের বাজার ধান গুদামজাত করা ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। এসিআই, তীর,
রাঁধুনি, কৃষি, চাষির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ নিয়ে সারা বছর চাল জোগান
দেওয়ার জন্য ধান গুদামজাত করে।
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, চালের দাম বৃদ্ধির
বিষয়টি সমাধান করতে হলে সরকারকে শক্তহাতে ধান গুদামজাত করা সব
প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে চালের বাজার
নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও সম্ভব হবে। তাছাড়া বাজারে পুরাতন চালের দাম সবসময়ই
একটু বেশি থাকে। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান এলে চালের দাম কমবে। আর সরকারের
পক্ষ থেকে যদি কীটনাশক, সেচ, শ্রমিক মজুরি কমানো যায়, তাহলে মিল মালিকদের
বেশি দামে ধান কিনতে হবে না, তখন চালের দামও কমবে।
বিগত সরকারের
সিন্ডিকেট এখনও রয়ে গেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে চালের দাম কমার
সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন পুরান ঢাকার চাল ব্যবসায়ী মো. দোলন। তিনি
বলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে দাম মনিটরিং করার পদক্ষেপ কোনও সরকার এখনও নেয়নি। গত
সরকার মুখে বলে গেছে বাজার মনিটরিং করবে, কিন্তু করেনি। কারণ বাজার
মনিটরিং করে কাকে ধরবে? আসল সিন্ডিকেটের সঙ্গে তো তাদের লোকজন জড়িত। গোড়ায়
গলদ থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না।
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ছোট ছোট
প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বড় ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া
ব্যবসা করছে। এখন কিছু ব্যবসায়ী বা কোম্পানি যদি একাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে
তাহলে তো দাম বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা সরকারের নেই। তাছাড়া বাজারে এখন ধানের
দাম বেশি। ধানের সিজনে যারা প্রচুর ধান কিনে গোডাউনে জমা করেছে, এখন তারাই
বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং দাম বাড়াচ্ছে।
খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও শুধু বন্যা, ত্রাণ ও
আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে চালের দাম। সরকারিভাবে শিগগিরই
এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তানজিল আহমেদ নামে এক ক্রেতা বলেন,
আগের সরকারের সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরি। ধান ও চালের মজুত গড়ে তুলে যারা
সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, সরকারিভাবে বাজার মনিটরিং করে তাদের চিহ্নিত করা
উচিত। ধান উৎপাদনের এলাকায় এই সিন্ডিকেটের আধিপত্য বেশি বলেও মন্তব্য করে
এই ক্রেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুর,
পাবনা ও বগুড়ার মোকামে ধান-চাল মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির
চেষ্টা করছে বড় বড় চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট
প্রথা ভাঙতে চাল আমদানির এলসি উন্মুক্ত করার দাবি ব্যবসায়ীদের।