বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
বৈষয়িক আকাক্সক্ষা ও লোভ থেকে তিনি দূরে ছিলেন
শাহীন শাহ্
প্রকাশ: শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:০৯ এএম |

 বৈষয়িক আকাক্সক্ষা ও লোভ থেকে তিনি দূরে ছিলেন
মানুষ একসঙ্গে দুটি জগতে বাস করে। একটি হচ্ছে কল্পনার জগৎ অপরটি বাস্তব জগৎ। বাস্তবতার জগৎটি বিশাল না হলে কল্পনার জগৎটিকে বিশাল করে পাওয়া অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মন একজন কিংবদন্তি। তিনি বাস্তবতার জগৎটি বিশাল করে দেখতে পেরেছিলেন বলে- কল্পনার জগৎটিকে বিশাল করতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাসে এর যথেষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ করাগেছে। নিজেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশাল সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেগেছেন স্বমহিমায়। 
অদ্বৈত মল্লবমর্ণ বাংলা সাহিত্যে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে এক অমর উপন্যাস রচনা করে গেছেন। যেটিতে শব্দের মিলনমেলা ঘটিয়ে ভাষাশৈলী যথার্থ প্রয়োগ করে কালজয়ী উপন্যাসে পরিণত করেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলাদেশেরই কৃতি সন্তান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিকটবর্তী তিতাস পাড়ের গোকর্ণ গ্রামের দরিদ্র মালো পরিবারে ১৯১৪ সালে ১ জানুয়ারি শীতের মধ্যপ্রহরে লণ্ঠনের আলো-আঁধারে পৃথিবীতে আসেন। পিতার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ। অদ্বৈতেরা ছিলেন তিন ভাই বোন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবেই তিনি মা-বাবাকে হারান এবং কিছুকাল পরে দুই সহোদরকেও হারান। মাতৃহারা-পিতৃহারা-সহোদর ভাই হারানোর শৈশব কতটা দুঃখের, কতটা বিষণ্নতার, কতটা পীড়াদায়ক তা কোনো বিশেষণ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে যেন এক অসহারের চেয়ে অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে কেটেছে শৈশব-কৈশোর।
মায়া-মমতা কী, আদর কী, এসব কিছুই শৈশবের দিনলিপিতে ছিল না। অর্ধাহারে-অনাহারে বেড়ে উঠতে হয়েছিল। অনাদর-অবহেলা ছিল নিত্যসঙ্গী। জেলে পল্লী থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ধূলিধূসর পায়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়া করতেন। স্কুলে এসে যখন শ্রেণিতে বসতেন, তখন সুহৃদ শিক্ষকেরা মলিন চেহারা দেখে, উপবাসের চিহ্নগুলি পড়িয়া ফেলতে পারতেন। অন্তরে ছিল অদম্য সাহসীকতা। ভাতের অভাব, কাপড়ের অভাব, এমনকি কাগজ-কলম কেনার সাধ্য ছিল না। তবুও তাঁর শিশু মনকে টলাতে পারেনি এক মুহূর্তের জন্য। ভাঙতে পারেনি ভেতরের স্পৃহা। শত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও লেখাপড়া থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।
জেলে পাড়ায় মালোদের ঘরে ঘরে তখনও কোনো শিক্ষার আলো পৌঁছেনি। জেলে পাড়ার পরিস্থিতি ছিল এরকম যে, মুখের গ্রাস যোগানের জন্যে মালো শিশুদের বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে মুখ সরিয়ে, নদীর বুকে জাল ফেলা শিখতে হতো। তাদের নিয়মিত খাবার জুটত না। অদ্বৈতের মেধা দেখে, পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে, পিতৃহীন অদ্বৈতকে মালোরা চাঁদা তুলে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহরে পড়াতে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাদের বন্দি জীবন থেকে মুক্তি লাভের প্রত্যাশা। 
অদ্বৈত যদি লেখাপড়া শিখতে পারে, তাহলে বেপারীর হিসাব লেখাতে তাদের আর কারো পা ধরতে হবে না। হতে হবে না কোনো ধরনের বঞ্চনার শিকার। ঠকাতে পারবেনা প্রাপ্য হিসাব থেকে। বেপারীরা মালোদের হিসাব না বুঝার ভান করতেন। তাঁদের অজ্ঞতার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মালোদের জীবনকে পঙ্গু ও বিপন্ন করে রেখেছিল। যদি হিসেবের মধ্যে কোনো ধরনের ভুল বা গোঁজামিল থাকে, তাহলে তাদের বাঁচার ন্যূনতম পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। সেইজন্য অদ্বৈতের লেখাপড়া করার জন্য মালো বংশের একমাত্র ধন-শিক্ষিত করার প্রয়াসে, ভবিষ্যৎ মুখ উজ্জ্বল করিবার মানসে, গোকর্ণের মালোরা তাঁর মাধ্যমে তাঁদের নূন্যতম অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখছিলেন।
অদ্বৈত ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এম.ই.স্কুল ও অন্নদা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এককালের সতীর্থ- অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী বলেন, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ পড়তেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এম.ই.স্কুলে। ১৯২৭ সালে সেখান থেকে স্কলারশিপ পেয়ে অদ্বৈত আমাদের ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অন্নদা হাই স্কুলে ভর্তি হন। আমি তার চেয়ে এক ক্লাশ উপরে পড়তাম। তাঁর পড়াশুনার সীমা ছিল তুলনায় খুব বেশি’। সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন যখন, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আনন্দময়ী কালীবাড়ির সামনের একটি হলঘরে একটি বিতর্ক সভায় অদ্বৈত বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দেশে এখন ইন্দ্রনাথের মতো ছেলে দরকার’’। বলতে দ্বিধা নেই যে, মাত্র ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া একটি ছেলে শরৎচন্দ্রের লেখা শ্রীকান্তের সেই ইন্দ্রনাথ অর্থাৎ শ্রীকান্ত উপন্যাসটি পড়ে ফেলা-বুঝে ফেলা! শতবছর পরে এসে রীতিমত আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই উপন্যাসটি কয়েক বৎসর আগেও আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠ্য ছিল।
ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি ছিল দেশানুরাগী মানবতাবাদী এক যুবকের চরিত্র। অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী অদ্বৈত সম্পর্কে আরও বলেন ‘‘একবার একটি হাতের লেখা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন লিখতে বললে, অদ্বৈত লেখেন বিজ্ঞপ্তি। সেদিনের পক্ষে বিজ্ঞপ্তি শব্দটিও ছিল যথেষ্ট আধুনিক। বোধকরি বিজ্ঞপ্তি শব্দটি তারই সৃষ্ট, যে কিনা একজন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। 
অদ্বৈত মল্লবর্মণের মাত্র তের-চৌদ্দ বৎসর বয়স থেকেই কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর নাম ছিল, পাশাপাশি কবি হিসেবে অদ্বৈত রীতিমত অবাক করা খ্যাতি পেয়েছিলেন। নিয়মিত লিখতেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। কুমিল্লা অঞ্চলের পত্রিকাগুলির মধ্যে ‘মাস পয়লা’ ও ‘খোকা খুকুতে’ ও লিখতেন। অদ্বৈত ১৯৩২ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। দারিদ্রতার কারণে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে কলেজের পড়াশুনা বাদ দিতে হয়। পরে ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের অনুরোধে কলকাতায় চলে আসেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯৩৪ সালে মাসিক ত্রিপুরা পত্রিকায় প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ক্যাপ্টিন নরেনদত্তের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘নবশক্তিতে’ সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজে যোগদেন। ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের তিন বৎসর কার্যকাল শেষ হবার পর ‘নবশক্তি’র সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। ‘নবশক্তি’ ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণ তখন মোহাম্মদী ও আজাদে কাজ করেছিলেন কিছুকাল। মূলত ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অদ্বৈত মল্লবর্মণের নিয়মিত কোন চাকুরি ছিল না। ১৯৪৫ এ অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাগরময় ঘোষের অনুরোধে ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। ‘দেশ’ এর কাজ ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণ তখন অতিরিক্ত কিছু রোজগারের আশায় সাময়িকভাবে ‘নবযুগ’ ও ‘কৃষক যুগান্তর’ কাগজে কাজ করেন।
‘বিশ^ ভারতী’ এর মতো বিখ্যাত পত্রিকায় কিছুকাল প্রুফরিডারের কাজ করেছিলেন। সাগরময় ঘোষ অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন এইভাবে, ‘‘প্রত্যেহ বিকেল বেলায় লেখক, কবি- সাহিত্যিকেরা যখন আড্ডা দিতেন, সেই আড্ডায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রায়’ই অনুপস্থিত থাকতেন। তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু মানুষ যারা সবসময় নিজেকে আঁড়াল রাখতে ব্যস্ত থাকতেন অদ্বৈত সেই প্রকৃতির ছিলেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ থাকতেন উত্তর কলকাতার একটি বাড়ির ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। বাসায় তিনি পুরোনো বই এর পাহাড়ের মধ্যে নিজেকে আত্মগোপন করে, পুরাতত্ত্ব চর্চা করে অবসরের সময়টুকু যাপন করতেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার ও অসম্ভব রকমের সৎ মানুষ। সাদা-সিধে জীবন যাপন করতেন। 
১৯৩৪ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বৎসর অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাংবাদিকতা জীবনে এবং যুগপৎ সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবিস্মরণীয় কীর্তি অর্জন করেন। অদ্বৈতের চারদিকে ছিল কবি ও কবিতার, নদী ও নির্সগের জগৎ। সে জগতে অনায়াসে ডুবে যেতেন কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ। নির্সগের ঝলমলিয়ে ওঠা কবিতার সাম্রাজ্যে কবি দেখেছেন জীবন ও প্রকৃতি। অদ্বৈত মূলত ছিলেন একজন খ্যাতিমান কবি। তিনি হৃদয় থেকে অনুভব করতেন যে, মালো জীবনকে বিরাট একটি ক্যানভাসে তুলে ধরতে হলে, উপন্যাস-ই একমাত্র মাধ্যম, কবিতা নয়। সেই অনুভব থেকে কবিতা থেকে সরে গিয়ে গল্প-প্রবন্ধ, উপন্যাস রচনায় নিজেকে মনোনিবেশ করেছিলেন। 
উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে রাঙ্গামাটি ও শাদা হাওয়া যুগ থেকে যুগান্তরের পথিকৃৎ হয়ে থাকবে। রাঙ্গামাটি উপন্যাসটির গভীরে বিচরণ করলে অনুভূতিতে সঞ্চালন হবে যে, শহরের উচ্চ মাপের মানব-মানবীর শূন্যতার মধ্যে রাঙ্গামাটি হয়ে উঠেছে গ্রামবাংলার সমান্তরাল একটি নকশা কিংবা ছক পুনর্গঠনের প্রতিক। রাঙ্গামাটি উপন্যাসটি অদ্বৈত প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল। আর শাদা হাওয়া উপন্যাসের মূলধারণায় আছে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস। 
বিশেষ করে তিতাস একটি নদীর নাম লেখকের কালজয়ী লেখা। এটা শ্রেষ্ঠতম অমর কীর্তি। যতদিন তিতাসের পাড় থাকবে, পদ্মার পাড় থাকবে, যমুনার পাড় থাকবে, জেলে পাড়া থাকবে, ততদিন তিতাস একটি নদীর নাম অমলিন থাকবে। এই উপন্যাসটি ইংরেজি, ফরাসি ও উড়িষা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক এই উপন্যাসটি দিয়ে চলচিত্র নির্মাণ করেছেন, যা স্মরণযোগ্য। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস একটি নদীর নাম পাণ্ডুলিপিটি লিখে যখন প্রকাশনায় জমা দিয়েছিলেন, তখন এককালের সতীর্থ অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী বলেছিলেন- মানিক বন্দোপাধ্যায় লিখলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আর কি তোমার বই কেউ নেবে? জবাবে বলেছিলেন অদ্বৈত,‘‘সুবোধ দা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় অৎঃরংঃ, কিন্তু বাওনের পোলা রোমান্টিক। আর আমি তো জাউলার পোলা’-আর কিছু বলেননি’’। নিজের স্বকীয় প্রত্যক্ষতাই ছিল তার গৌরবের অন্যতম দিক। এই উপন্যাসে কিছু কিছু চরিত্রে এমন কিছু শব্দ মিশিয়ে চরিত্রকে বাস্তবের নোঙরে নিয়ে গেছেন, যা না উল্লেখ করলে নয়। 
এদের একটি হলো- ‘সুবলের বাপ গগন মালোর কোনো কালেও নাও-জাল ছিল না, সে সারা জীবন কাঁটাইছে পরের নৌকায় জাল বাহিয়া। যৌবনে সুবলের মা ভৎসনা করিত, এমন টুলাইন্না গিরস্তি কতদিন চালাইবা। নাও করবা, জাল করবা, সাউকারী কইরা সংসার চালাইবা! এই কথা আমার বাপের কাছে তিন সত্য কইরা, তবে আমারে বিয়া করতে পারছ। স্মরণ হয় না কেন্? আসলে নিঃশ্চেষ্ট লোককে ভৎসনা করিয়া ফল পাওয়া যায় না। খাইবা বুড়া কালে পরের লাথি-উষ্ঠা, যেমন মানুষ তুমি’’। 
‘‘করম আলী ও বন্দে আলীর মধ্যে সংলাপ লক্ষ্য করলেই তাঁর উপন্যাসের সাথে আত্মিকতা ফুটে ওঠে। মনিবের ঘরে খাওয়ার পর কাঁধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দে আলী বলে, ভাই করম আলী নিজে‘ত’ খাইলাম ঝাগুর মাছের ঝোল, আমার ঘরের মানুষের এক মুঠো শাক-ভাত জুটলনি কি জানি? করম আলী বলে, বন্দে আলী ভাই কথা কইছ মিছা না, তোমার আমার ঘরের মানুষ? তোমার আমার ঘরই নাই তার আবার মানুষ। দয়া কইরা রাইতে থাকতে দেয়, কি খায় কি পিন্ধে, কোনো দিন কি খোঁজ রাখতে পারছি? তা যখন পারছিনা, তখন তোমার আমার কিসের ঘর? আর কিসের মানুষ? জবাবে বন্দে আলী বলে বেবাক-ই বুঝি। তবুও মনিবের ঘরে পঞ্চসামগ্রী দিয়া খাইবার সময় যখন, ঘরের কথা মনে হয়, গলায় ভাত আটকাইয়া যায়, আর খাইতে পারিনা’’....।
অদ্বৈত মল্লবর্মন উপন্যাসের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেন ‘‘নদীর একটি দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই, নদীরও বহার শেষ নাই। কতকাল ধরিয়া কাল নিরবিচ্ছিনভাবে বহিয়াছে। তাহার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে, কত মানুষ মরিয়াছে।.......তাহার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের, কত কান্নার রোল উঠিয়াছে। কত অশ্রু আসিয়া জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে। আর মালোদের ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু হইয়াছে যে পথ সে সবই গিয়া মিশিয়া গিয়াছে তিতাসের জলে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ আজ থেকে প্রায় ৮৪ বছর আগে এই উপন্যাসটি রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ত্রিশের কোঠায়।
১৯৪০ এর দিকে ‘‘মোহাম্মদী’’ পত্রিকায় এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। এতো অল্প বয়সে এমন একটি সার্থক উপন্যাস রচনা করা, বাংলা সাহিত্যে বিরল ঘটনা। পল্লী প্রকৃতির নিরীহ মানুষের, নিরন্ন মানুষের ভিটে মাটিহীন ভয়ার্ত ও শোকার্ত মানুষের মনের কথা, তাঁদের জীবনচিত্র একজন শিল্পীর তুলি দিয়ে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে ভয়হীনভাবে নিরেট চিত্রগুলো বাস্তবতায় তুলে ধরা এক অবিস্মরণীয় বিস্ময়কর ঘটনা। যা হাজার বছরের পরিক্রমা অতিক্রম করেও জীবন্ত কিংবা মূর্ত থাকবে। 
অদ্বৈত মল্লবর্মণের কোন পারিবারিক দায় ছিল না। বাবা-মা-ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল বাল্যকালেই। স্বল্প আয় দিয়ে চিরকাল দূরের আত্মীয়দেরকে সাহায্য করেছিলেন। অর্থকষ্টের মধ্যেও তিনি সারা জীবন বই সংগ্রহ করেগেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যুর পর, বন্ধুরা তাঁর সংগ্রহীত বইগুলো কলকাতার ‘রাম মোহন লাইব্রেরির’ হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সঞ্চয়ের অবশিষ্ট উদ্বাস্তু মালো পরিবারে দিয়েগেছেন। সংসারের দারিদ্রকে তিনি হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছিলেন। বৈষয়িক আকাঙক্ষা ও লোভ থেকে তিনি দূরে ছিলেন। 
সমগ্র জীবন মানুষের কল্যাণে নিবেদন করে গেছেন। শরীরের উপর নিদারুণ অবহেলা ও অযত্নের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯৪৮ সালে কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ যাত্রায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন। তারপর আবার অসুখ বেড়ে যায়। চিকিৎসা করার মতো কোনো পয়সা তার কাছে ছিল না। তিনি যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। মুমূর্ষু অবস্থায় ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকার অর্থানুকূল্যে তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পড়ে যখন জ্ঞান ফিরে, তখন বুঝতে পারলেন তিনি হাসপাতালে শায়িত। মনে উদ্রেক হলো যে, চিকিৎসা করার মতো আমার কাছে কোনো টাকা নেই। তখন তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ গ্রন্থের স্রষ্টা ১৯৫১ সালের ১৬ই এপ্রিল নারকেল ডাঙ্গার ষষ্ঠীতলার বাড়িতে ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৭ বৎসর। এটা কোন পরিণত বয়স নয়। তিনি অপরিণত বয়সেই বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করে গেছেন। 
লেখক: অধ্যাপক, কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক












সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার অভিযোগ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২