টানা ৪০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে মারা গেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সাব্বির হোসেন (১৯)। গতকাল শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টার দিকে দেবিদ্বার ভিংলাবাড়ি এলাকার তার নানার বাড়িতে মৃত্যু হয়।
নিহত সাব্বির হোসেনের বাড়ি জেলার মুরাদনগর উপজেলার কাজিয়াতল এলাকার হলেও তিনি ছোটবেলা থেকেই নানাবাড়ি দেবিদ্বারের ভিংলাবাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। সাব্বির মরিচাকান্দা জিয়া স্মৃতি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরতে অটোরিক্সা চালাতেন। সাব্বিরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দেবিদ্বার থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিনুল ইসলাম।
শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সাব্বিরের নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সাব্বিারের মা রিনা বেগমের গগণ বিধারী কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে আকাশ বাতাস। তাকে শান্তনা দিতে এসে কান্না করছেন প্রতিবেশীরাও। রিনা বেগম গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে বলেন, আমার এতিম ছেলেডারে কেডায় গুলি করে মারল রে! আল্লা ও!, আমি এখন কারে নিয়ে বাঁচব, দুই বছর আগে তার বাপ মরল এখন ছেলেডা মরল, আল্লায় কি আমার দিকে দয়া ধরল না রে, ৫ তারিখে পুতে আন্দোলনে গিয়া শেষ হইয়া গেল রে। আমার কিচ্ছু লাগব না, কেউ আমার সাব্বিররে ফিরাই আইন্না দাও।
স্থানীয়রা জানান, গত ৫ আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন শেখ হাসিনা পালানোর পর বিজয় মিছিল বের করে ছাত্রজনতা। ওইদিন বিকেলে মিছিল করতে দেবিদ্বার থানার দিকে যান মিছিলকারীরা। এ সময় পুলিশ থানার ছাদে উঠে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকলে ১৫-১৬ জন মিছিলকারী গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে সাব্বিরের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি লাগে। অপরদিকে পুলিশ দাবি করছে, ওইদিন দেবিদ্বার নিউমার্কেট গোলচত্বর এলাকায় মিছিল করা অবস্থায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ মিছিলকারীদের ওপর হামলা করে গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয় সাব্বির। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসক তার মাথায় সিটিস্ক্যান করে মাথার ভেতরে গুলি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন। পরে অস্ত্রোপচার করে সাব্বিরের মাথার ভেতর থেকে গুলি বের করা হয়। পরে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে সাব্বির। কিছুদিন পর ঢাকা মেডিকেল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলে দেবিদ্বার ভিংলাবাড়ি ফিরে আসেন তার মা এবং তিনি। শনিবার সকালে হঠাৎ নিজের অস্বস্তি লাগছে বলে মাকে জানায় সাব্বির। পরে ঘরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন। তাকে দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সাব্বিরের নানা অসিউল মিয়া বলেন, সাব্বিরের তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। দুই বছর আগে তার বাবা স্টোক করে মারা গেছে।এরপর সাব্বির সংসারের হাল ধরতে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। তার মৃত্যুতে আমরা এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।
সাব্বিরের মামা নাজমুল হক বলেন, তাকে নিষেধ করছিলাম আন্দোলনে যেতে কিন্তু নিষেধ অমান্য করে আন্দোলনে গেছে। ৫ আগষ্ট সকালে নিউ মার্কেট চত্ত্বওে গেলে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা এলোপাতারি গুলি চালালে তার মাথায় দুটি গুলি লাগে। পরে আমরা তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কুমিল্লা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা ঢাকায় পাঠায়। গত তিনদিন আগে তাকে বাড়িতে আনা হয়। শনিবার সকালে আবার অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনায় আমি বাদি হয়ে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছি। আমি সরকারের কাছে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
দেবিদ্বার থানার পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুল ইসলাম বলেন, সাব্বিরের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আমরা তার নানার বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে তার মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু স্থানীয় লোকজন আমাদের বাঁধা সৃষ্টি করে বলেন-তারা ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ দাফন করবেন। পরে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সাব্বিরের মরদেহ দাফনের অনুমতি দিয়ে থানায় ফিরে আসি।