অস্ট্রেলিয়া আসার আগে শুনেছিলাম
তুই অসুস্থ হাসপতালে আছিস, তোকে দেখে আসতে পারিনি, ভেবেছিলাম তুই সেরে
উঠবি কারণ অসুস্থতা তোকে এত তাড়াতাড়ি আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাবে এটা ভাবতেও
পারি নি। তোর সুঠাম দেহ, পেটানো শরীর, ডাম্বেল বারবেল, যোগ ব্যায়াম করা
শরীর এত খারাপ হয়ে গেছে একেবারে চলেই যাবি তা ভাবতেও পারিনি। মনে পড়ে তোর
উৎসাহে ভিক্টোরিয়া কলেজ জিমনেসিয়ামে শুরু করেছিলাম ব্যায়াম করা, হাড্ডির
খাচায় চিমসানো শরীরটাতে একসময় ফুটে উঠেছিল অল্প বিস্তর পেশী, তা দিয়ে কম
দাপট দেখাইনি তখন। জানিনা পাড়ার অন্যসব ছেলেদের চেয়ে কেন জানি আমাকে
ভালবাসতি বেশী। আমিও দিনেদিনে তোর বন্ধুতে জড়িয়ে যাই। কত স্মৃতি তাজু ক'টি
বলবো। ৬৯ এ ইয়াহিয়া খানের স্টুডেন্ড ডান্ডি কার্ডের বদৌলতে মর্নিং শো দেখার
ধুম পড়ে গিয়েছিল আমাদের। আর তুইতো ছিলি মর্নিং শো এর পোকা, কারণ তোর
জীবনটা ছিল অনেকটা টেক্সাস সিনেমার হিরোদের মতো, আমি ছিলাম চার্লি
চ্যাপলিনের ভক্ত আর তুই ছিলি "ব্রুসলী"র মতো ক্ষিপ্তগতির ভক্ত। আমাদের
বন্ধুদের কোনদিন সিনেমা দেখতে ব্ল্যাকে টিকেট কাটতে হয়নি, সবাই মিলে আমরা
জোগার করতাম তোর টিকেটের পয়সা, আর তুই সিনেমা হলের সামনে গেলেই সেই যে
ল্যাংড়া টিকেট ব্ল্যাকার আগে ভাগেই আমাদের টিকেট দিয়ে দিত। নস্টালজিক
কথাগুলো লিখলাম।
বন্ধু বৎসল তুই, একবার ফুটবল নিয়ে ফারুকের সাথে
মনোহরপুরের ছেলেদের কি একটা গন্ডগোল হয়ে ছিল। ফারুককে ওরা লিবার্টি হলের
সমনে আটকে রেখেছিল, খবর পেয়ে তুই ছুটেগেলি সাথে আমি, সেদিন নতুন করে দেখলাম
তোর কুংফুর স্টাইল, একা অনেকগুলো ছেলের সাথে কি দারুন মারপিট করে ফারুকে
তুই উদ্ধার করেছিলি অথছ তার ক’দিন আগে ইউছুফ স্কুলের মাঠে ফারুকের সাথে
ফুটবল খেলানিয়ে গন্ডগোল হয়েছিল। আমি তোকে জিজ্ঞেস করলাম তুই না ফারুকের সাথ
গন্ডগোল করেছিস, তাকে বাঁচালি কেন ? তুই বলে ছিলি গন্ডগোল হয়েছে কি হয়েছে
তে আমার বন্ধুনা ? আমি থাকতে বজ্রপুরের পোলারে ধইরা রাখবো এত বড় সাহস
কার। এই ছিলি তুই বন্ধু বৎসল।
কলেজে ভর্তি হয়ে তোর সাহসে আমরা বজ্রপুরের ছেলেরা অন্যদের সাথে টক্কর দিতাম। কত ঘটনা, কটা বলবো
পার্কের
ধর্মসাগর পাড়ের জাম গাছের জাম সুমিষ্ট অনেক লম্বাগাছ ঝাঁপিয়ে জাম ধরতো,
একবার আমাদের নিয়ে তুই গেলি জাম পাড়তে মগডালে উঠে জাম পাড়ছিস, আমরা তা
কুড়িয়ে রাখছি, কথাছিল জাম দুই ভাগ হবে একভাগ তোর আরেক ভাগ আমাদের সবার,
হঠাৎকরে মড়মড় করে ডাল ভেঙ্গে হেলিকাপ্টরের মতো তুই নিচে পড়ে গেলি, আমরা
সবাই ভয়ে ভৌ দোঁড়, পিছন থেকে শুনি ঐ কই যাস তোরা আমার জাম দিয়া যা, আমরা
ভাবছিলাম তোর হাত পা ভেঙ্গে গেছে তুইদেখি ভাঙ্গা ডাল থেকে জাম তুলছিস। আমরা
বললাম তাজু তোর কিছু হয়নি, তুই বললি "ব্রুসলীর" কিছু হয়না। ইচ্ছে করলে তুই
আমাদের জাম নাও দিতে পারতি কিন্তু না আগের কথা মতো আমরা সবাই জাম ভাগ করে
নিলাম। এইছিল তোর এলাকার ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব। আমরা আড়ালে তোকে বোকা
বলতাম আসলে কি তুই বোকা ছিলি ? না এখন বুঝি তুই ছিলি সহজ সরল যে কারণে
অনেকে তোকে ব্যবহার করেছে।
ইন্টার স্কুল ফুটবল খেলার ঘটনাটা এখন
জ্বলজ্বল করে আমার হৃদয়ে, মানব প্রেম কাকে বলে আমি সেদিন শিখেছিলাম তোর কাছ
থেকে। সেবার ইন্টার স্কুল ফুটবল খেলা নুরপুর হাউজিংয়ের মাঠে, আমরা সবাই
হাজির। মাঠের পাশেই উঁচু পানির ট্যাঙ্ক। আমাদের কাজই ছিল ঐ পানির ট্যাঙ্কের
উপর উঠে সিগারেট খাওয়া। তুইসহ আমি, মুকুল আরো কেকে যেন উপরে উঠলাম সাথে
অচেনা কটি ছেলে হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি খেলায় গন্ডগোল লেগে গিয়েছে খেলা
ভন্ডুল। আমরাও নেমে আসলাম এমন সময় ট্যাংকির একধাপ নীচ থেকে চিৎকার করে
কান্নার শব্দ ভেসে আসলো। একটা অচেনা ছেলে ভয়ে আর নামতে পারছে না। অনেক লোক
জমে গেছে নিচে। সবাই আলোচনা করছে এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে হঠাৎ দেখি তুই
লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিস উপরে এবং প্রায় তোর বয়সী ছেলেটিকে কাঁধে নিয়ে
নেমে এলি। তোর মানবিকতা দেখে চোখটা শিরশির করে উঠেছিল আমি পোষা বিড়ালের
মতো তোকে জড়িয়ে ধরে বলছিলাম। তোর ভয় লাগেনি? তুই বললি কেন? আমি বললাম
ছেলেটিকে তুই চিনিস ? বললি না, তাহলে ? তুই বললি তাকে নামাতে হবে নইলে
পইড়া মইরা যাইবো। চলচল, হাইঞ্জ অইয়া গেছে বাসাত চল।
আরেকদিনের ঘটনা
ফুটবল ম্যাচ চলছে ইউসুফ স্কুলের মাঠে। একটা ছেলে দক্ষিণ দিকের ছাদে উঠে
খেলা দেখছে হঠাৎ করে তার হাত চলে যায় লাইট পোষ্টের তারে, তার সারা শরীর
ইলেক্ট্টি ফাইড, ছেলেটা বাঁকা হয়ে গিয়েছে হঠাৎ দেখি তাজু লাফদিয়ে ছাদে উঠে
একটা কাঠের টুকরা দিয়ে আঘাত করে ছেলেটাকে ইলেক্ট্রিক তার থেকে ছুটিয়ে দেয়,
ছেলেটা মাটিতে পড়ে যায়। তাজু তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায় ছেলেটার শরীর রক্ত
শুন্য হয়ে গিয়েছিল। জমে মানুষে টানাটানিতে ছেলেটা বেঁচে যায়। তাজু যদি
তাৎক্ষণিক ভাবে ছাদে না উঠতো তাহলে ছেলেটা সেখানেই মারা যেত।
তাজু, কত
মানুষ যে তোকে কত ভাবে ব্যবহার করেছে তার ঠিক নাই। আমরা বড় হলাম সংসার
সাজালাম তুই ও সংসারি হলি সন্তানরা মানুষ হয়েছে। তাজু, চলে যাওয়ার সময়
হয়েছে আমাদেরও তুই আগে গেলি, আমরাও আসছি, হাশরের ময়দানে দেখা হলে আবার কথা
হবে। তোর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। হে আল্লাহ আমার বন্ধুটিকে সকল দোষ
ত্রুটি ক্ষমা করে বেহেস্ত নসিব করো। আমিন