উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার
মান উঁচু রাখা জরুরী। তা নইলে উচ্চশিক্ষার মানে হয় না। এটা শুধু আদর্শের
কথা নয়। বাস্তব প্রয়োজনের কথা। উচ্চশিক্ষার ভিতর দিয়ে তৈরি হয় শিক্ষক,
চিকিৎসক, দক্ষ বিজ্ঞানী ও যন্ত্রবিজ্ঞানী। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
যদি বেরিয়ে আসে অপটু ইঞ্চিনিয়ার তবে তাতে সমাজের গুরুতর ক্ষতির আশংকা। যদি
তৈরি হয় অযোগ্য ডাক্তার তবে বিপদ নতুন প্রজন্মের, আগামী কালের মানুষের।
উচ্চশিক্ষার মান যদি উঁচু রাখা না যায় তবে তাতে বিপদ সারা সমাজের। বিপন্ন
আমাদের ভবিষ্যৎ।
এটাই তা হলে প্রথম শর্ত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার
মান উঁচু রেখে যত অধিক সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী নেওয়া আমাদের সাধ্যায়ত্ত ততটাই
নেওয়া উচিত, তার বেশি নয়। সব মানুষের স্বাভাবিক ঝোঁক একদিকে নয়। কারো
ঝোঁক যাকে বলে ‘থিওরি’ বা তাত্ত্বিক অনুসন্ধান সেই দিকে। কারো স্বাভাবিক
আগ্রহ এবং দক্ষতা শিল্পেসঙ্গীতে, কারো হাতের কাজে, কারো সমাজসেবায়, কারো বা
সাংগঠনিক কাজে। মনুষ্যত্বের বিকাশের বিচার এর কোনোটাকেই ছোট বলা যায় না,
সব পথেই তৈরি হয়েছে শ্রদ্ধেয় মানুষ। তৈরি হবার পথটা সকলের জন্য এক নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সীমাবদ্ধ। সব কাজে বিদ্যাবিদ্যালয়ের শিক্ষা সমান
সহায়ক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীকে বেশি মান্য করাটা কুসংস্কার। অনেক
কুসংস্কারের মতোই এটাও ক্ষতিকর হতে পারে, ডিগ্রী প্রার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়
উভয়ের পক্ষেই।
উচ্চশিক্ষার অনেকগুলি ধাপ আছে। উঁচু ধাপে
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক ঝোঁক গবেষণা ও তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের দিকে।
সেইদিকে যাদের আগ্রহ এবং সম্ভাবনা বেশি, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের ব্যাপারে
তাদেরই অগ্রাধিকার থাকা উচিত। তবে আরো দুটি কথা একই সঙ্গে বলে রাখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে অর্থাভাবে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয় সেদিকে বিশেষ
দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এদেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র, কিন্তু দরিদ্রের ঘরেও
যে উচ্চশিক্ষার যোগ্য বহু সন্তান জন্মগ্রহণ করে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
টাকার জোরে ছেলেমেয়েরা কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারছে আর অনেক
সম্ভাবনাপূর্ণ গরিব ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষার পথ বন্ধ। এটা যেমন অন্যায় তেমনি
সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।
এই সঙ্গে আসে একটা দ্বিতীয় কথা। শিক্ষার
বিস্তার এবং পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আয়োজন বাড়বে।
সেই উদ্দেশ্যে নতুন বহুমুখী সংগঠনের প্রয়োজন সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। আমাদের
কর্মী জনতার একটা বড় অংশ চলে যাবে কর্মক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ
লাভের আগেই। জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে আরো কয়েক বছর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর
কিন্তু অনেকের আগ্রহ জন্মাতে পারে উচ্চতর শিক্ষার জন্য। তখন যাতে
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশের পথ সেইসব মানুষের জন্য চিরকালের মতো বন্ধ না
হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে
পুনঃপ্রবেশের প্রশস্ত পথ চাই। সে কথা চিন্তা করেই উদ্ভাবিত হয়েছে মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা।
ইংরেজিতে একে বলা হয়েছে ‘ওপেন ইউনিভার্সিটি’।
সংসারের কর্মক্ষেত্রে একবার যিনি প্রবেশ করেছেন তাঁর পক্ষে সব কাজ ছেড়ে
একটানা দু’তিন বছরের জন্য ছাত্রবৃত্তি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। অতএব মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন এবং সংগঠন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথক। যাই
হোক, সংগঠনের বর্ণনা নয়, মূল উদ্দেশ্যটাই এখানে বিশেষভাবে লক্ষ করবার
বস্তু। বিদ্যালয়ে পাঠান্তে ছেলেমেয়েরা নির্বিচারে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে
প্রবেশ করলে দেখা দেয়া বৃত্তির সঙ্গে যোগ্যতার অনাবশ্যক অসামঞ্চস্য। অতএব
প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ নির্বাচন।
কিন্তু সংসারের নানা কর্মে ও বৃত্তিতে যাঁরা ছড়িয়ে পড়বেন জীবনের প্রথম
পর্যায়ে, তাঁরাও যাতে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন কোনো পরবর্তী
পর্বে, সেই পথ অবারিত করা সরকার ও শিক্ষা সংগঠনের সামনে একটা বড় কর্তব্য।
সরকারি
নানা শিক্ষানীতিতে জেলায় জেলায় ‘মডেল স্কুল’ বা আদর্শ বিদ্যায়তন স্থাপনের
প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন, বিরুদ্ধ সমালোচনা শোনা
গেছে অনেকের মুখে। বিরোধীদের প্রধান বক্তব্য এই যে, মডেল স্কুল মানেই
বিভিন্ন বিদ্যালয়ে মধ্যে একটা স্তরভেদ, কিছু স্কুল হবে প্রথম শ্রেণীর, কিছু
দ্বিতীয় শ্রেণীর।
সরকারি নীতি যাই হোক না কেন, সব স্কুল, সব কলেজ, সব
বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু একই মানের হয় না। কোনো দেশেই নয়। আমেরিকার সব
বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বা প্রিন্সটনের সমপর্যায়ের নয়, বিলেতে সব
অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজের মতো নয়, সোভিয়েত দেশে সব মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের
অথবা ফরাসি দেশে সরবনের সমান নয়। স্কুল কলেজের ক্ষেত্রেও একই কথা। এটাই
বাস্তব পরিস্থিতি। উন্নতমানের অধিকাংশ স্কুল এখন বড় বড় শহরে, রাজধানীতে
অথবা মহানগরীতে।
প্রশ্নটা তা হলে এই নয় যে, উন্নতমানের কিছু বিশেষ
স্কুল থাকবে কি না। প্রশ্নটা এই যে, মহানগরীর বাইরের জেলায় জেলায় কিছু
আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবার প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য কি না। সব
বিদ্যালয়কে একসঙ্গে আদর্শ বিদ্যালয় করে তোলা যাবে না। সেটা অবাস্তব কথা।
কিন্তু জেলায় জেলায় কিছু মডেল স্কুল ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।
সেটা হবে যুক্তিসঙ্গত কথা।
গ্রামাঞ্চলে অনেক উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে আছে। ভাল
স্কুলের সন্ধানে তাদের মহানগরীতে পাঠাতে হবে কেন? অনেক পরিবারের সেই
সামর্থ্য নেই। জেলার ভিতরই ভাল স্কুলের সন্ধান থাকা চাই। জেলা জেলায় কিছু
স্কুল তো আছে, পুরনো সরকারি জিলাস্কুলই হোক বা বেসরকারি বিদ্যালয় হোক,
যাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিলে এটা নতুন অভিজাতশ্রেণী গড়ে উঠেছে আমাদের
চোখের সামনেই। এসবের জন্য জেলায় জেলায় মডেল স্কুলের প্রয়োজন হয়নি। যাঁরা
বিত্তবান ক্ষমতাবান তাঁরা সুবিধা করে নিয়েছেন।
এখন যে নতুন প্রস্তাব
এসেছে তার বিচার করতে হবে খোলা মনে। এই প্রস্তাবে কিছু শর্ত আরোপ করবার কথা
হয়তো আমাদের ভাবতে হবে। কিছু সদিচ্ছাকে কার্যকর করবার উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে
সচেষ্ট হতে হবে। স্পষ্ট করে বলতে হবে যে, দরিদ্র পরিবারের প্রতিশ্রুতিময়
ছেলেমেয়েদের মডেল স্কুলে আকৃষ্ট করবার জন্য চাই বিশেষ ব্যবস্থা, আর্থিক এবং
অন্যান্য সহায়তা। সরকারি প্রস্তাবের কোনো ধারা এমনও থাকতে পারে যা
বর্জনীয়। কিন্তু মূল প্রস্তাবের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে গঠনমূলক,
রচনাত্মক।
স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছে
বিদ্যালয়ের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি। অনিবার্যভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ভিতর
মানের তারতম্যও বেড়ে গেছে। সব বিদ্যালয়েরই উন্নতি কাম্য। কিন্তু অল্প কিছু
বিদ্যালয়ই হতে পারে পথপ্রদর্শক। শুধু রাজধানীতে নয়, জেলায় জেলায় তৈরি হচ্ছে
একুশ শতকের নেতারা। তাদের জন্য ভালো স্কুল চাই। শিক্ষার প্রসার চাড়া পথ
নেই। কিন্তু শুধু সংখ্যাবৃদ্ধিতে সমস্যা বাড়ে। পথ দেখাবার জন্য কিছু বিশেষ
বিদ্যালয়েরও আবশ্যক আছে।
শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত রাখা
দরকার। কথাটা যদি সবাই স্বীকার করে নিতেন তবে এ নিয়ে বেশি আলোচনা প্রয়োজন
হত না। কিন্তু সবাই স্বীকার করছেন না।
গত চল্লিশ বছরে শিক্ষার ওপর দলীয়
রাজনীতির প্রভুত্ব ক্রমেই বেড়েছে। এটা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে শিক্ষার
সর্বস্তরে। শিক্ষানীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর দলীয় রাজনীতির প্রভাব আগে
ছিল না এমন নয়। ছিল; কিন্তু সদর্পে সেটা সমর্থন করা হত না। কিছুটা গোপন
এবং কুণ্ঠিত ছিল সেই হস্তক্ষেপ। বলা বাহুল্য, আমি স্বাধীনতার পরবর্তী যুগের
কথাই বলছি। দলীয়তার হাত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মুক্ত রাখাই ছিল স্বীকৃত
আদর্শ। এর ব্যতিক্রম ঘটলে বিরোধী দল তার সমালোচনা করেছে। যারা ক্ষমতায় আসীন
তারা অভিয়োগ অস্বীকার করেছে যথাসাধ্য। শিক্ষাকে দলীয়তার ঊর্ধ্বে রাখাই ছিল
তাদেরও গোষিত উদ্দেশ্য। আজ তা নয়।
আজ অন্য কথা শুনছি ক্ষমতাসীন দলের
পক্ষ থেকে। যুক্তিটা এইরকম। রাজনীতি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়
এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজেরই অংশ। অতএব রাজনীতিকে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের বাইরে রাখা সম্ভব নয়। প্রতিটি নাগরিকেরই অধিকার আছে
রাজনীতিতে। ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সকলেরই সেই অধিকার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের
বাইরে সেই অধিকার থাকবে আর ভিতরে থাকবে না, এটা একটা অবাস্তব প্রস্তাব।
রাজনীতি মানেই দলীয় রাজনীতি, ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই দলবিশেষের সমর্থক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতরেও একই কথা। সেখানেও ব্যক্তি তার দলীয় মতামত দিয়েই
চালিত হবে। এটাই অনিবার্য। যে দল ক্ষমতায় আসীন তার পিছনে আছে জনতার
অধিকাংশের সমর্থন। এই সমর্থন থেকেই আসে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের বিশেষ
অধিকার। সেই অধিকারের বলেই শাসক দল শিক্ষার ক্ষেত্রেও শাসন চালায়। স্কুলে
কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র সংখ্যাগরিষ্ট দলের কর্তৃত্ব গণতন্ত্রের
পূর্ণতার জন্যই প্রয়োজন। এই ধরনের কথা আমরা শুনছি।
গণতান্ত্রিক অধিকার
মূল্যবান, তার সুরক্ষা আবশ্যক। একথা স্বীকার্য। একই সঙ্গে মনে রাখা
প্রয়োজন, রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষানীতির আছে একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ। বিভিন্ন
দলের ভিতর ক্ষমতার লড়াই রাজনীতির প্রধান কথা। দলীয় হারজিতের ভাবনায় অস্থির
সেখানে চেতনা, সময়ের ছোট সীমায় আবদ্ধ সেই চিন্তা। শিক্ষানিিততে এই সব
প্রধান কতা নয়। বিচারকে প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক অন্য এক বাস্তবে, যেখানে
সময়ের দিগন্ত আরও বৃ¯তৃত, দলীয় দ্বন্দ্বের আরও ঊর্ধ্বে। রাজনীতির নানা
আক্ষেপ শিক্ষানীতিকে ক্রমাগত বিচলিত করে তুললে রাষ্ট্রনীতির তাতে শেষ অবধি
কোন সুবিধা হয় কি না বলা কঠিন, কিন্তু শিক্ষার যে তাতে ক্ষতি হয় একথা
নিঃসন্দেহে বলা যায়।
শিক্ষাকে তাই দলীয় রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করা
আবশ্যক। এ ব্যাপারে জনমতের একটা ভূমিকা আছে। দলীয় জবরদস্তির বিরুদ্ধে
ধিক্কারে সোচ্চার জনমত প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা সোজাসুজি
যুক্ত আছেন, বিশেষত যাঁরা শিক্ষক, তাঁদেরও এ বিষয়ে একটা বিশেষ দায়িত্ব
স্বীকার করে নিতে হবে।
শিক্ষার স্বধর্ম ও রাজনীতির ভিতর একটা বিরোধ
আছে। সমাজে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব চলছে। সে দ্বন্দ্ব কখনও জাতিতে, সম্প্রদায়ে,
কখনও শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর, এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর। রাজনীতি
সত্যকে দেখতে চায় এই দ্বন্দ্বের ভিতর থেকে। এরও জীবনে স্থান আছে। কিন্তু
এটাই যথেষ্ট নয়। এই খণ্ডিত সত্য মানুষকে একসঙ্গে ধরে রাখতে পারে না। সত্যের
এই খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত অভিব্যক্তির ঊর্ধ্বে আছে একটা বৃহত্তর সত্য, তাকেও
প্রয়োজন মানুষের মঙ্গলের জন্য। তারই ভিতর দিয়ে অন্য এক ঐশ্বর্যের সৃষ্টি হয়
যাকে বাদ দিলে কলহের সুরটাই অতিশয় প্রবল হয়ে ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
জন্য আমরা যে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকারের কথা বলি, শিক্ষকের স্বাধীনতাকে
মূল্যবান বলে জানি, তার মূলে আছে এই কথাটাই। শিক্ষা ও রাজনীতির ভিতর
সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু এ দুয়ের প্রকৃতি এবং আদর্শের ভিত একটা
অসামঞ্জস্য আছে। আর সেজন্যই শিক্ষাকে রাজনীতির অধীনতা থেকে মুক্তি দেওয়া
প্রয়োজন। শিক্ষক যদি শিক্ষায়তনের ভিতর দলীয় আজ্ঞা অনুযায়ী চলেন, দলের
স্বার্থকেই মহত্ত্ব দেন, তবে তিনিও হয়ে ওঠেন শিক্ষার স্বাধীনতার শত্রু।
যেখানে তিনি শিক্ষক সেখানে তাঁকে চলতে হবে শিক্ষার স্বধর্ম অনুসারে। এ যদি
হয় তবে শিক্ষার সমস্যার সমাধান কঠিন নয়; যদি না হয়, তবে কঠিন।
আমাদের
সমাজের কিছু কাজ উদ্দেশ্যে দলীয় রাজনীতির ভিতর দিয়ে সিদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু সব
কাজ সব উদ্দেশ্য নয়। অনেক কাজে দলীয়তা একটা বাধা, একটা বিঘ্ন। যুদ্ধের সময়
দেশ তার ঐক্যকে স্থাপন করে দলীয়তার ঊর্ধ্বে। যুদ্ধ অবশ্য একটা চরম
দৃষ্টান্ত। কিন্তু বিপরীত প্রান্তে আছে অন্য উদাহরণ। সমস্ত সুস্থ সমাজেই
এমন কিছু আনন্দের অনুষ্ঠান থাকে যখন সবাই বিভেদ ভুলে গিয়ে আলিঙ্গন করে,
আনন্দের ভিতর ঐক্যবদ্ধ হয়। অনুষ্ঠানের বাইরেও মানুষের ভিতর মিলনের একটা
স্বাভাবিক শক্তি আছে। পরিবারে হোক, পল্লীতে হোক অথবা বৃহত্তর সমাজে হোক, এই
শক্তি আছে বলেই মানুষের সমাজ নানা বিরোধের ভিতর আজও একেবারে ভেঙে পড়েনি,
জীবন সম্পূর্ণ শ্রীহীন হয়নি। শিল্পে এবং বিজ্ঞানে, মানুষের স্বাভাবিক
সহৃদয়তায় এবং শুভবুদ্ধিতে, আমরা শেষ অবধি ব্যক্তির সেই পরিচয়টি পাই যেখানে
সে শুধু দলবিশেষের নয়, সে মানুষ।
এই মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত রাখা
শিক্ষার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। যে রাজনীতির ভিত্তিতে আছে দলীয়তা তার সঙ্গেও
পরিচয় থাকা হয়তো দরকার। কিন্তু তা দিয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। রাজনীতির
সীমাহীন আধিপত্য শিক্ষা এবং মনুষ্যত্ব দুয়েরই বিপর্যয় ডেকে আনে। এদেশে
বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে গত কয়েক বছরের ইতিহাসের এটাই পরীক্ষিত সত্য।
মানুষের
সমাজে একটা অধ্যায় ছিল যখন সংগঠিত অসহিষ্ণু ধর্ম সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন
করতে উদ্যত হয়েছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে। সেই সর্বগ্রাসিতাকে মানুষ
দুর্ভাগ্যজনক বলেই জেনেছে। আজ যদি রাজনীতি হতে চায় এক নতুন অসহিষ্ণু ধর্ম
তবে তার সেই অসংযত দাবিকেও বলতে হবে সর্বনাশী।