সাধারণত:
আমাদের দেশে দুর্নীতি হচ্ছে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য সরকারি ক্ষমতার
অপব্যবহার। বৃহৎ সংজ্ঞায় না গিয়ে এক্ষুনি যা বাস্তবায়নের প্রয়োজন তার
নির্দেশিত সংজ্ঞা এটিই। সেই অর্থে দুর্নীতির আক্রমণ বেশি ছিল ২০২৩ সালে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অনুযায়ী, যেসব দেশে গণতন্ত্র নাই এবং যে সব
দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সে সব দেশের চেয়েও বাংলাদেশে দুর্নীতির
মাত্রা বেশি। জার্মানির বার্লিন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা
ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০২৩ সালের যে দুর্নীতি ধারনাসূচক বিবরণ
প্রকাশ করেছে সে ধারনা অনুযায়ী দূর্নীতির মাত্রা বিশে^র যেসব দেশে সবার
চেয়ে বেশি তার মধ্যে দশম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এর পূর্বে ২০২২ সালে
বাংলাদেশ ১২তম। পূর্ববর্তী সরকার অঙ্গীকার করেছিল দুর্নীতি কমিয়ে আনবে।
তারা কি শুধু বলার জন্য বলে নাকি সত্যিকার অর্থেই বলে সেটা বোধগম্য নয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সন্দেহ থেকে জাতিকে হতাশ না করে কথা রাখবে বলে
সবাই মনে করে। দুর্নীতি ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বললে পূর্বের সরকার
ষড়যন্ত্রের কথা বলত। সরকারের লোকজন এমনভাবে কথা বলত যেন সবাই তাঁদের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। অনেক তালবাহানা করে অনেক কাজই সম্পন্নকরেছে কিন্তু
দুর্নীতি কমানোর মনমানসিকতা নিয়ে তাঁরা কাজ করে নাই। ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এর সূচকে দুর্নীতির ধারনার মাত্রাকে ০ থেকে ১০০ এর
স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। “০” স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ
ক্ষতিগ্রস্ত এবং “১০০” স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা
সর্বোচ্চ সুশাসিত বলে ধরা হয়। টিআই বলেছে ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ
পেয়েছে ২৪। টিআই এর বিবরণ অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে শুধু
বাংলাদেশের অবস্থান খারাপ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে ভূটানের অবস্থান
৬৮, নেপালের ৩৫, ভারত ও মালদ্বীপের ৩৯, শ্রীলঙ্কা ৩৪, পাকিস্তানের ২৯।
সূচকে “১০০” স্কোরের মধ্যে ৯০ পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে
রয়েছে ডেনমার্ক ৮৭ পেয়ে, ২য় অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যাণ্ড। তৃতীয় অবস্থানে
নিউজিল্যাণ্ড, চতুর্থ স্থানে নরওয়ে। পঞ্চমে আছে সিঙ্গাপুর। ষষ্ঠ স্থানে
যৌথভাবে সুইজারল্যাণ্ড ও সুইডেন। অন্যদিকে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি
সোমালিয়ায়। তাদের স্কোর মাত্র ১১। দ্বিতীয় স্থানে আছে সাউথ সুদান,
ভেনেজুয়েলা ও সিরিয়া। টিআই বলছে “১০০” স্কোরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর
প্রাপ্তির ক্রমানুসারে বাংলাদেশে অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম। ২০০৮
সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। এরপর ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের
অবস্থান ১২ থেকে ১৭ এর মধ্যে। ২০২৩ এ তা ১০ এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ ধারনাসূচক
অনুযায়ী দেশে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেশী। অর্থাৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের
অঙ্গীকার বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়নি। আইনের প্রয়োগ ও কর্মসম্পাদনে আইনের
অপপ্রয়োগ এর ব্যাপারে বাংলাদেশের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। সরকারি খাতে
দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারি ক্রয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও
প্রকল্প চুক্তির ব্যাপারে বেশি দুর্নীতি লক্ষ্য করা যায়। অর্থ পাচারের
বিষয়ে কোন দৃষ্টি দেয়া হয়নি। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা
সংস্থাগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছিল। ঘুষ লেনদেন, সরকারি সম্পদ ও অর্থ
আত্মসাতের ঘটনা বেড়েছিল। ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার
বেড়েছিল। প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত
ক্ষমতাকে নিজের সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। পূর্বের
সরকারের উচ্চমহল থেকে বলা হয়, “দুর্নীতি, করাপশন ইজ ওয়ে অফ লাইফ এক্রস দা
ওয়ার্ল্ড নাও। এট বাংলাদেশের ব্যাপার নয়। সারা বিশে^ই কম বেশি আছে। কিন্তু
যেভাবে অপবাদটা বাংলাদেশ নিয়ে দেয়া হয়, এটা মোটেও সত্য নয়।” এক পর্যায়ে
টিআইবিকে বিএনপির দালাল বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ট্রান্সপারেন্সির দুর্নীতির
ধারনা সূচকের এ বিবরণটি “রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রনোদিত বলে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ
মহল থেকে বলা হয়। এর জবাবে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, “এটা রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার সুযোগ নাই। এটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি গবেষণা।
দুর্নীতির তুলনামূলক বিশ্লেষণেণর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ২ গ্রহণযোগ্য। একই দল যখন
ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন তারাই টিআইবির প্রতিবেদনকে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার
করে।” দুর্নীতির ধারনা সূচকের ১০০ স্কোরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে ৬৯,
চীন ৪২, রাশিয়া ২৬, উন্নত দেশেও দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এর কারণ
হচ্ছে বিশ^ব্যাপী গণতন্ত্র অবহেলিত, স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। ফলে
প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কমছে। বিচার ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে,
জবাবদিহিতা কমে যাচ্ছে। দুর্নীতি সক্রিয় হচ্ছে এবং যারা দুর্নীতি করছে তারা
বিচারহীনতায় ভোগছে। ঘুষ লেনদেন ও রাজনৈতিক প্রভাব বিচার প্রক্রিয়াকে যখন
নিয়ন্ত্রণ করে, তখনই বিচার প্রভাবিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়। দুর্নীতি ও অবিচার একে অপরের সাথী। দুর্নীতি অন্যায়ের
জন্ম দেয়। এ অন্যায় ও দুর্নীতির দুষ্টচক্রকে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সঠিক সময়।
যারা ঋণ খেলাপি তারাই বিগত সরকারের আমলে নির্ণয় করত দেশে ঋণ খেলাপের
নীতিমালা কি হবে, বৈশি^ক মানদণ্ডে অর্থ পাচারের দিক থেকে শীর্ষে অবস্থান
করত এ ঋণ খেলাপিরাই। উন্নয়ন হয়েছে বহুত এটা অস্বীকারের কোন উপায় নাই।
কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আরও অনেক উন্নতি হত এবং তা জনগণের জন্য
অর্থবহ হত। উন্নয়নের সুফল জনগণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা দুর্নীতি। তাই
দুর্নীতি বন্ধে বর্তমানে একটিই হবে জাতীয় স্লোগান “ব্যক্তিগত সুবিধা লাভে
কেউ যেন সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার না করি।”
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ