বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
২ মাঘ ১৪৩১
দেশপ্রেমই পারে দুর্নীতি কমাতে
অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন লিটন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:১৬ এএম |

 দেশপ্রেমই পারে দুর্নীতি কমাতে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যখন খুদা- দারিদ্র্যপীড়া থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই দেশের কয়েকজন বড় বড় আমলার দুর্নীতির খবর, বিসিএস পরীক্ষায় জালিয়তিনিউজ প্রকাশ্যে আসে। ৩০ লাখ শহিদের আত্মদানে অর্জিত এই সোনার ভূমিকে বারবার কিছু সুবিধাভোগী লোক  কলঙ্কের কালিমা লেপনই করছে।
বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলস্বরূপ সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, বাংলাদেশও তা থেকে মুক্ত নয়। বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকট, মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি ও ভঙ্গুর ব্যাংক ব্যবস্থা যখন দেশের অর্থনীতিতে এক অশনিসংকেত দিচ্ছে, ঠিক তখনই সংবাদপত্রগুলোতে সাবেক এক পুলিশ মহাপরিদর্শক ও রাজস্ব কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ায় দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রতি বছর দেশের  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশসেরা মেধাবীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করে প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনের বড় বড় পর্যায়ে যান। তার মধ্যে কিছু কিছু ব্যক্তি  ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে যেন তারা নীতি-নৈতিকতার পাঠ ভুলে যান। এ ব্যর্থতার দায়ভার আদতে কার? আমরা শিক্ষকরা তাহলে কি  ব্যর্থ একটি নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধপূর্ণ দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে?
যে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ গঠনের জন্য ৩০ লাখ শহিদ আত্মত্যাগ করলেন, তা ম্লান হতে চলেছে দুর্নীতির করাল গ্রাসের কারণে। দুর্নীতির ফলে যেমন দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ছে, জাতীয় আয়ে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ঠিক তেমনি আয় বৈষম্য আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। সমাজের মুষ্টিময় কিছু লোকের  মনোভাবের কারণে ধনী ক্রমশ ধনী হচ্ছে আর বেশির ভাগ দরিদ্র দরিদ্রই রয়ে যাচ্ছে। বিগত দেড় দশকে অবকাঠামোগত যে সব উন্নয়ন হয়েছে, তার সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ ভালোভাবে ভোগ করতে পারছে না, অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতির কারণে।
দেশের মাটি ও মানুষকে নিজের করে ভাবার নামই হলো দেশপ্রেম। স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্যই ছিল, দেশের আপামর জনসাধারণকে বৈষম্যমুক্ত সুন্দর অনাবিল জীবন উপহার দেওয়া। কিন্ত স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও, এখনো দেশের একটি জনগোষ্ঠী নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম। যাদের অন্তরে দেশপ্রেমর ধারণা উজ্জীবিত, তারা কখনো জনগণের সম্পদ নষ্ট করতে পারে না।
সৃষ্টিকর্তা পশুর মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক দেন নি, কিন্তু মানুষের মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক দান করেছেন। এর ফলে মানুষ জ্ঞানের আলোকে অন্যপ্রাণী অপেক্ষা জীব হিসেবে বহুগুণ শ্রেষ্ঠ। যেসব মানুষ নিজের কথা না ভেবে পরের মঙ্গলের জন্য বা দেশ ও দশের হিতার্থে আত্মোৎসর্গ করে তাকে মহৎ মানুষ বলা হয়। মহৎ মানুষের চিন্তা ও কর্ম সব সময় সমাজকেন্দ্রিক ও দেশ নিয়ে। তারা সব সময় দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। কীভাবে দেশের মঙ্গল হবে, কীভাবে দেশের মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে সে সম্পর্কে তারা সব সময় নিজেদের ব্যস্ত রাখেন।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষকে হতে হবে উদার ও মানবপ্রেমিক। দেশের মানুষকে ভালোবাসাই হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম মানুষের স্বভাবজাত গুণ। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধই হলো দেশপ্রেমের উৎস।
 মা, মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই দেশপ্রেমের মূল সত্য নিহিত। ফলে সে দেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশের সঙ্গে যেমন গড়ে উঠে তার শেকড় বন্ধন, তেমনি মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি সৃষ্টি গভীর ভালোবাসার আবেগময় প্রকাশই হচ্ছে দেশপ্রেম।
 চিন্তায়, কথায় ও কাজে দেশের জন্য যে ভালোবাসা প্রকাশ পায় সেটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। দেশ ও দশের প্রতি মানুষের যে বন্ধন ও আকর্ষণ তা থেকেই স্বদেশ প্রেমের জন্ম। দেশ যত ক্ষুদ্র বা যত দরিদ্রই হোক না কেন। প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার জন্মভূমি, তার দেশ, সবার সেরা, সব দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয়তাবোধ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান উৎস। লাখো বীরের আত্মবলিদানে তখন স্বদেশের মৃত্তিকা হয় রক্তে রাঙা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস তো স্বদেশপ্রীতিরই জ্বলন্ত স্বাক্ষর। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নির্দ্বিধায় জীবনকে উৎসর্গ করেন। যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে জীবন উৎসর্গ করার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছেন তিতুঁমীর, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন এরাই অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী নায়ক। তাদেরও সাহস ও আত্মত্যাগের তুলনা হয় না। ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের মর্মান্তিক মৃত্যু তাদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতা এ উপমহাদেশের মানুষকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শহিদ হয়েছেন, রফিক, বরকত, সালাম, জব্বাররা।
এছাড়াও দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত একাত্তরের শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বায়ান্নর ভাষা শহিদরা। দেশপ্রেমের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে রেখে গেছেন যা সত্যিই বিরল। দেশে দেশে যুগে যুগে দেশপ্রেমিক সংগ্রামী মানুষরা এভাবেই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। কেউ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, কেউ হয়েছেন গুলিবিদ্ধ, কেউ জীবন কাটিয়েছেন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তাদের এই আত্মত্যাগ ও জীবনদানের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। অর্জিত হয়েছে বিজয়। নিজেরা জীবন দিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
দেশপ্রেম ধারণ করার জন্য ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরির বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু থেকেই দেশপ্রেম জাগ্রত হয়, এমন বিষয়াবলি আরো বেশি করে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। দেশপ্রেমের আদর্শ মনেপ্রাণে ধারণ করে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা গেলে দুর্নীতির এই করাল গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করা সম্ভব। দেশের প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত  প্রচেষ্টা ব্যতীত সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টার জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্যের ভীত হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশপ্রেমই পারে দুর্নীতি কমাতে।
যে দেশ যত বেশি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, সে দেশ তত বেশি বিশ্বে প্রভাব রাখছে। এই অর্থনীতির মধ্যে এক বিষফোড়া হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি অর্থনীতিকে সচল রাখতে বাধা দেয়। দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে। দুর্নীতিগগ্রস্ত ব্যক্তিরা সম্পদের পাহাড় গড়ে, অথচ এই সম্পদের মধ্যে দেশের নিম্ন শ্রেণির মানুষেরও অংশ থাকে। এভাবেই গরিবদের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় কতিপয় বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। দুর্নীতির নেতিবাচক ফলাফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, অর্থ-সম্পদ গুটিকয়েক মানুষের হাতে চলে যাওয়া, অর্থ পাচার।
যে কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়। মোটকথা, দুর্নীতি উন্নয়নকে গ্রাস করে। এই দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজে কীভাবে এবং কেন আসে সে দিকটাও দেখা দরকার। দুর্নীতির প্রধানতম কারণ হলো সীমাহীন লোভ। মানুষ জন্মগতভাবে অনেকগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায় এর মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো লোভ। লোভে মানুষ হয়ে পড়ে নীতিহীন। সরকারের আইনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন থেকে দূরে থাকাও দুর্নীতির কারণ।
বিশেষ করে অনিয়মের কারণেও দুর্নীতি বেড়ে যায়। অনিয়মের আরেক নাম হলো দুর্নীতি। তাই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে পদায়ন করা। সততা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া।  এছাড়াও সুশাসন, আইনের শাসনই হলো দুর্নীতি দমনের চাবিকাঠি, এর পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে, দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করে দুর্নীতিমুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই পারে দুর্নীতির কালো হাত ভেঙে দিতে, টেকসই উন্নয়নে বাধা প্রদানকারী দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলার দরকার।
লেখক:  প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ , কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা। 














সর্বশেষ সংবাদ
পদত্যাগ করলেন টিউলিপ
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
দুটি পিস্তল ও ধারালো অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী আটক
কুমিল্লায় দুই নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
কুমিল্লা মেডিকেল ছেড়ে কোথায় গেলো শিশুটি?
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় তিন প্রতিষ্ঠানকে ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে পুলিশে সোপর্দ
প্লাস্টিক জমা দিন গাছের চারা নিন
কুমিল্লার দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’অন্যতম সদস্য মাইনুদ্দিন আটক
কুমিল্লায় ‘প্রেমিকের’ সাথে দেখা করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দুই নারী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২