কুমিল্লায়
হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনে ব্যাপক অব্যবস্থাপনার কারণে মারাত্মক
স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকাবাসী। এ
নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি সরেজমিনে তদন্ত করাকালে দেখা
যায়, মডার্ণ হাসপাতালের সামনে উন্মুক্ত স্থানে রক্ষিত ৪টি প্লাস্টিক ড্রাম
থেকে এ হাসপাতালের বর্জ্য সংগ্রহ করছে ২ জন শ্রমিক। তারা এখানে অপেক্ষমান
একটি খোলা ট্রাক্টরের উপর একে একে বর্জ্য সংরক্ষিত ড্রামগুলো সেফটি গ্লাভস
বিহীন হাতে উপুড় করে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। তখন বেলা সকাল ৭টা। রাস্তায় যান
চলাচল কিছুটা কম হলেও বর্জ্যরে দুগর্ন্ধে দাড়িয়ে থাকা দায়। অথচ শ্রমিকদ্বয়
নাকে-মুখে কোনো প্রকার মাস্ক ব্যবহার না করেই দিব্যি দুর্গন্ধময় বর্জ্য
সংগ্রহ করছে। এমন দৃশ্য প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে কুমিল্লার
বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে দেখা যায়।
ট্রাক্টর চালক আশরাফুল জানান,
কর্তৃপক্ষ তাদেরকে হ্যান্ড গ্লাভস, গাম বুট, মাস্ক দেয় নি। বেতন মাসিক ৮
হাজার টাকা, এ টাকা দিয়ে সংসার চালানো দায়। তিনি এক বছর যাবৎ এ কাজ করে
আসছেন। তিনি টমছম ব্রীজ, মনোহরপুর, চর্থা, মুরাদপুর এলাকায় হাসপাতাল ও
ক্লিনিকের বর্জ্য সংগ্রহ করে টিক্কারচর ও বালুতুপা ডাম্পিং স্থানে ফেলে
দেন। ট্রাক্টরের উপর কোনো ঢাকনার ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্যরে দুর্গন্ধ সারা
রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে, এজন্য অনেকসময় পথচারীদের গালাগালিও শুনতে হয়। মডার্ণ
হাসপাতালের নৈশ প্রহরী/সিকিউরিটি মোঃ জিলানী জানান, এ হাসপাতাল থেকে
প্রতিদিন ৭/৮ ড্রাম হাসপাতাল বর্জ্য ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এ
হাসপাতালে পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া দেখালেও বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে
কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গা দেখাতে পারেন নি। ট্রাক্টর চালক জানায়, কুমিল্লা
সিটি কর্পোরেশনে হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন কাজে মোট ৩টি ট্রাক্টর
ব্যবহার করা হয়। অন্য দুটি ট্রাক্টর চালক মোখলেছ ও মহসিন। তারা দীর্ঘদিন
যাবত এ কাজে নিয়োজিত। সম্পূর্ণ খোলা অবস্থায় হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহ ও
পরিবহনের পাশাপাশি আরও একটি দুঃসংবাদ হলো হাসপাতাল বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জ ও
স্যালাইন ব্যাগ খোলা বাজারে বিক্রির অভিযোগ। জানা যায়, হাসপাতালে কর্তব্যরত
নার্স, ওয়ার্ডবয় ও ট্রাক্টরের সাথে থাকা শ্রমিকগণের সম্মিলিত একটি চক্র
দীর্ঘদিন যাবত এ অনৈতিক কাজের সাথে লিপ্ত। এতে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
এলাকায় লোকজন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বসবাস করছেন।
কুমিল্লা
কর্পোরেশন এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সিভিল
সার্জন ডা. নাছিমা আকতার বলেন, পুরো সিস্টেমটিই কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের
তত্ত্বাবধানে সূর্যমুখী সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে করা হয়।
তারা নিয়ম না
মেনে এ কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা
অর্থাৎ সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহের ব্যাপারে
নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। ৪টি কনটেইনারে প্রকার ভেদে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়।
এদিকে
গতকাল কুমিল্লায় কোথায় হাসপাতালে ব্যবহৃত তথা পরিত্যক্ত স্যালাইন ব্যাগ,
নল, ও সুইসহ সিরিঞ্জ বিক্রি করা হয়- এ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুটি
ভাঙ্গারি দোকানের সন্ধান মিলে। দুটি দোকানের একটি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতাল রোডে রাস্তার দক্ষিণ পাশে কুচাইতলীতে জান্নাত এন্টারপ্রাইজ ও
আরেকটি নোয়াগাঁও চৌমুহনী সংলগ্ন রাস্তার পশ্চিম পাশে আবুল কালামের ভাঙ্গারি
দোকান। দোকান দু’টির ভেতরে-বাইরে খোলা আকাশের নিচে যত্রতত্র হাসপাতালে
ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ, ব্যাগের নলসহ বিভিন্ন উপকরণ পড়ে থাকতে
দেখা যায়। জান্নাত এন্টারপ্রাইজের মালিক বাবুল হোসেনের ছোট ভাই মোঃ আবুল
বাশার জানান, হাসপাতালের বর্জ্য ও পরিবহনকারী ট্রাক্টর থেকে তিনি
হাসপাতালের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের উপকরণ সংগ্রহ করেন ও বিক্রি করেন। তিনি ৩০
টাকা কেজি দরে ক্রয় করেন ও ৪০ টাকা দরে বিক্রি করেন। স্যালাইনের খালি ব্যাগ
কত দরে বিক্রি করেন? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তার কাছে স্যালাইনের ফ্রেশ
ব্যাগ নেই। ঢুলিপাড়া চৌমুহনীতে সুমন মিয়ার দোকানে ফ্রেশ ব্যাগ পাওয়া যায়।
সেগুলো হাসপাতালের নার্সরা সরাসরি বিক্রি করে। নোয়াপাড়া চৌমুহনীর দোকানদার
আবুল কালাম জানান, তিনি স্যালাইনের খালি ব্যাগ ও বোতল প্রতিটি ৫ টাকা
বিক্রি করেছেন। এখন ফ্রেশ বোতল বা ব্যাগ নিতে হলে প্রতিটি ৭ টাকা দরে নিতে
হবে। সিরিঞ্জ প্রকারভেদে প্রতি কেজি ৯০-৯৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। আর নল ৬০
টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। খোলা আকাশের নিচে হাসপাতালের বর্জ্য হিসেবে
চিহ্নিত এসব সুইসহ সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ, ব্যাগের নল বিক্রি করাতে
বাতাসে অনায়াসে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। জনস্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত ঝুঁকিপূর্ণ
হচ্ছে অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা নেই।
কুমিল্লা
বেসরকারি ক্লিনিক মালিক সমিতির সভাপতি রইস আবদুর রবের সাথে হাসপাতাল বর্জ্য
ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর সদুত্তর দিতে পারেন নি। শুধু বলেন,
সূর্যমুখী নামে একটি সংস্থা কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় হাসপাতাল
সমূহের বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে। এর বেশি তিনি আর কিছু জানেন না।
জানা
যায়, ইনোভেশন সেবা সংস্থা দীর্ঘ ১৪ বছর যাবত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
এলাকায় হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন কাজ করে আসছিল। হাসপাতাল বর্জ্য
ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ সংস্থা ঝাঁকুনি
পাড়ায় মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে জমি ক্রয় করেছে। এ কাজটি কুমিল্লা সিটি
কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই করেছে। আরফানুল
হক রিফাত যখন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সংসদ সদস্য আ ক ম
বাহাউদ্দিন বাহারের নির্দেশে চলমান প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেন। এমন কি
ইনোভেশন সেবা সংস্থাকে এ কাজ থেকে বিরত থাকায় নির্দেশ দেন। এ কাজের জন্য
সূর্যমুখী সামাজিক সংস্থাকে অনুমতি দেয়া হয়। এ সংস্থার
মালিক/স্বত্ত্বাধিকারী সোনালী ব্যাংকের সাবেক সি বি এ নেতা হাসান খসরু।
তিনি মোটা অংকের টাকায় বিনিময়ে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের কৃপাদৃষ্টি
আদায় করলেও এ কাজ তিনি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে করতে ব্যর্থ হন।
ইনোভেশন
সেবা সংস্থার সভাপতি মতিউর রহমান খান বলেন, ইনোভেশন সেবা সংস্থাকে কোনো
প্রকার শোকজ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ এ কাজ অন্য একটি
সংস্থাকে দেওয়ায় ইনোভেশন সেবা সংস্থা আর্থিকভাবে বিরাট ক্ষতির সম্মুখিন
হয়েছে। এ সংস্থার নিজস্ব তিনটি গাড়ি অব্যবহৃত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি গাড়ির
কিস্তি এখনও চলমান, একই সাথে কাজটি বন্ধ করায় সংস্থা প্রায় আশি লক্ষ টাকার
ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। এ সংস্থার ২০ জন শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন
যাপন করছে। মোঃ মতিউর রহমান খান বলেন, মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর সময় সুষ্ঠু ও
নিয়মানুযায়ী হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন করা হয়েছে। তিনি কাজটি
পুনরায় ইনোভেশন সেবা সংস্থাকে দেয়ার জন্য সদয় অনুমতি প্রার্থনা করে
ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করেছেন।
এদিকে হাসপাতাল
বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন নিয়ম মেনে করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি
জোর দাবি জানিয়েছেন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকার সচেতন নাগরিকগণ। তারা
বলেন, বর্তমানে নিয়ম না মেনে যেভাবে খোলা ট্রাক্টরে করে হাসপাতাল বর্জ্য
সংগ্রহ ও পরিবহনের কাজ চলছে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
শীঘ্রই এর সুষ্ঠু সমাধান করা প্রয়োজন।