যারা জীবনকে সঁেপ দিয়েছিল মৃত্যুর কাছে। এসব সন্তানেরা জীবনকে বাজি রেখে মৃত্যুকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা থেকে বিরত রেখেছিলেন। পাখির মতো করে দু’ডানা মেলে বুক পেতে দিয়ে পিচঢালা রাজপথে রক্ত ঢেলে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন জীবনকে ফাঁকি দিয়ে। এরা বিপ্লবী সর্দার ফজলুল করিম, মাস্টারদা সূর্যসেন এর মতো পরিণত বয়সের ছিল না। এরা অধিকার আদায়ে জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতও ছিলেন না। বিপ্লবের কঠিন মন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত না হয়েও অনভিপ্রেতভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন রাজ পথে। মুখরিত করে তুলেছিলেন স্লোগানে স্লোগানে। এইসব উত্তাল দৃশ্য দেশপ্রেমের জ¦লন্ত শিখা হয়ে জ¦ল জ¦ল করছে এই বাংলার মায়ায়ভরা মাটিতে। এরা-ই একদিন তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবের অংশীদার হয়ে ইতিহাসের স্বর্ণখচিত পাতায় পাতায় জ¦ল জ¦ল করে ঠাঁই হয়ে যাবেন। ঠাঁই হয়ে যাবে এ-মাটির মানচিত্রের বুকে-পিঠে।’’ জমা হয়ে থাকবে এই ভূ-খণ্ডের নরম পলিতে পলিতে। জমা হয়ে থাকবে দুঃখিনী মায়ের নীরব নিথর অপেক্ষার চোখে।
যে ধরনের ফ্যাসিবাদী নিষ্পেষণ দেশে চলতে ছিল এবং এই নিষ্পেষণ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছিল, তার শেষ যে একভাবে না একভাবে ঘটবে কিছু সুবিধীভোগী চাটুকার ছাড়া বাকীসব মানুষেরা বিশ^াস করেছিলেন। অসন্তোষ ও তীব্র ক্ষোভ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের ভেতরে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সরকার ক্রমাগতভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এই ফ্যাসিষ্ট সরকারের মুখপাত্ররা যেভাবে গলা উঁচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, তাতেই অনুমেয় তাদের ভেতরটা খালি হয়ে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তাঁরা মুখে যতই চিৎকার করে শব্দযন্ত্র কাঁপাচ্ছিলেন যে, তারা ভয় পাওয়ার পাত্র নয়, দেশ ছেড়ে পালাবেন এমন কাপুরুষ নন, ততই টের পাওয়া যাচ্ছিল তারা ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের চেহারায়, আভায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে- ‘থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়’। বাস্তবে সমস্ত কিছুই ফ্যাসিষ্ট সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছিল।
নতুন বাংলাদেশ প্রাপ্তির মূল প্রেক্ষাপট-টি ছিল চাকুরীর কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা নিয়ে। কোটা সংস্কারের মূল ও মৌলিক কারণ হচ্ছে বিসিএসের জন্য। উচ্চশিক্ষা শেষে তরুণ শিক্ষার্থীরা কেন পাগল বিসিএসের জন্য? কারণ- তারা জানেন এটা সবচেয়ে নিরাপদ চাকরি। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তাঁদের অর্থ-বিত্ত, প্রতিপত্তি এই সবেরই নিশ্চয়তা আছে। তাদের এই ভাবনা অযৌক্তিক নয়। কারণ চারপাশে যেসব উদাহরণ প্রকাশিত হচ্ছে, তাতেই এটা পরিষ্কার। তারা স্বপ্ন দেখেন সচিব হয়ে অবসরে গেলে সংসদীয় এলাকায় তথাকথিত উন্নয়ের নামে জনগণের টাকা খরচ করবেন। আরও স্বপ্ন দেখেন চাকুরী থেকে অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে। মস্তবড় মন্ত্রী হবেন, এমপি হবেন। অবসর নেওয়ার পর ভোট চাইবেন। ফলে তরুণদের ঝোঁক বিসিএসের দিকেই যাবে। সংগত কারণে অন্য কোনো চাকরি বা পেশায় আমাদের তরুণেরা তেমন উৎসাহবোধ করেন না। তারা মনে করেন বিসিএসের চাকরিতে-ই প্রাপ্তিযোগ অনেক বেশি।
আমাদের রাজনীতিবিদেরা তরুণদের নিয়ে খেলতে খেলতে এমন একজায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন- ‘হয় অভ্যূত্থান নয় মৃত্যু।’ যার ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলনটি সংগঠিত ও সুসমন্নিত করে রাষ্ট্র পরিচালনার জায়গাটা সমূলে উৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এটাকে গণ-অভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। গণ-অভ্যুত্থানটি বাংলাদেশ তথা গোটা ভারত বর্ষের ইতিহাসে অন্যতম গণ-অভ্যুত্থান হিসেবে ভবিষ্যতের গবেষকদের গবেষণায় আসবে। বিপ্লব হচ্ছে-বিগত শাসন ব্যবস্থাকে নিঃশেষ করে দেওয়া। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থান হচ্ছে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে জনগণের প্রত্যাশিত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে জুলাই-থেকে আগস্ট/২৪ এর রক্তক্ষয়ী আন্দোলনটি সফল হওয়ায় এটাকে গণঅভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে আর্ন্তজাতিক মহলে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আন্দোলনে-সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়া তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে কেহ-ই বিপ্লবী ছিলেন না।
আসলে বাংলার মাটি ও মানসপটে একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, সেটি হচ্ছে বাঙালি চিরকাল-ই বিদ্রোহী। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে-ইতিহাসের কোনো পর্বে কিংবা বাঁকে তাঁরা কোনো পরাধীনতাকে মেনে নেয় নি। অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই- বাঙালি সবসময় জীবনের উর্দ্ধে উঠে বিদ্রোহটাকে ধারাবাহিকভাবে বজায় রেখেছিল। বৃটিশ শাসন আমলেও আমরা ইতিহাসের বাঁকে বা পরতে পরতে দেখতে পাই-ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, তিতুমিরের বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, পাকিস্তান শাসন আমলে- বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, নকশাল আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বই এর গণ-অভ্যুত্থান এসব তাঁর দালিলিক প্রমাণ। এরা বৃটিশ শাসকদের শুধুমাত্র কলকাতা ছাড়া করনেনি। সর্বপরি ভারত ছাড়া করেছিল এই বাঙালিরা-ই।
বাঙালিদের মধ্যে চিরাচরিত বিদ্রোহী মনোভাবের যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। দৃশ্যত; বাহির থেকে বাঙালিকে যত নিরীহ আর শান্ত মনে হলেও বাঙালির ভিতরে রয়েছে বারুদের মতো তীব্র জ¦লিত স্কুলিঙ্গ। যা ইতিহাসের পরতে পরতে, পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় তারা তাঁর স্বাক্ষর রেখেছে। যার স্পষ্টত উদাহরণ হচ্ছে- কোনও স্বৈরশাসককেই ১০ বছরের বেশি সহ্য করতে পারেনি এদেশের সাধারণ জনগণ। আইয়ূব খাঁনকে ১০ বছরের বেশি সহ্য করেনি। এরশাদকে নয় বছরের মাথায় বিদায় করে দিয়েছিল সংগ্রামী জনতা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর নুরুল আমীনকে সাত বছরের মাথায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। সবশেষে ক্ষমতাশীন ফ্যাসিষ্ট সরকারকে ও শত শত শহীদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা থেকে পলায়ন করতে হয়েছে। সেদিন ছিল ০৫ আগস্ট/২০২৪। বিকাল তিনটায় সারা বাংলাদেশে গণ-মানুষের যে, আনন্দ-হিল্লোল দেখেছি যা আগামী প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের আন্দোলন-সংগ্রামের দিশারি হয়ে থাকবে। গণ-মানুষের কণ্ঠে একটি-ই কথা-মানুষের মুক্তি এসেছে। আনন্দের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে মানুষে মানুষে মিলন ঘটেছিল। সেই দৃশ্য সারাবিশ^ অবাক হয়ে দেখেছে এবং সমর্থন জানিয়েছে।
বাংলাদেশ নামে একটি অসীম সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর হয়ে গেল। রাষ্ট্রটির শাসনকল্পে ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তুলেছে। যেমনটি একটি আধুনিক রাষ্ট্রের সু-শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তুলে। আমাদের পুলিশ, বিজিবি, সেনা-নৌ ও বিমান বাহিনীর শক্তি অনেক। দীর্ঘদিন কর্তৃত্ববাদী শাসন বহাল তবিয়তে বিরাজমান থাকায় এদেরকে দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রে সু-শাসন নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে ব্যবহার না করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে দানবে পরিণত করে ফেলেছিল। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হয়েগিয়েছিল যা সর্বজন বিশ^াস করে। কিন্তু তাদের চেয়ে ও অধিকতর শক্তিমান একটা জিনিস থাকে আমাদের জাতীয় জীবনে। তাঁর স্বর্ণখঁচিত নাম এ-দেশের জনগণ। এদের চেয়ে শক্তিমান কেউ হতে পারে না। বিশেষ করে গোটা দুনিয়াকে যে দেশটি শক্তি ও সামর্থ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে, সে দেশটি প্রবল পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকার সেনাবাহিনী গোটা দুনিয়াকে ৯০০ বার ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু নিজের দেশে মার্শাল ‘ল’ দিতে পারে না। এই জন্য পারে না ওই জনগণের মধ্যে এমন কিছু শক্তি আছে, যা ওই সেনাবাহিনীর ক্ষমতার চেয়ে অধিকতর বেশি। কারণ ঐ দেশে গণতন্ত্র সমুন্নত আছে। শাসকেরা গণতন্ত্রের প্রতি প্রবল ও ক্রমাগতভাবে শ্রদ্ধাশীল। গণতেন্ত্রের একটা সৌন্দর্য আছে, যা আমাদের দেশে গভীরভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্র চিরকালই পরস্পরের সহযোগীতার, সৌহার্দ্যরে ভাব প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে। এ দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য একটাই যে, আমরা শাসকবর্গের অহমের দাসে ক্রমাগতভাবে পরিণত হচ্ছি। আমাদের জবানবন্দী, চোখবন্দি, জীবনবন্দি এক অদ্ভূত বন্দি শিবিরে। কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘‘কোনো রাজা যদি তার নাগারিকদের ভালোবাসে, তবে তিনি তাঁর নাগরিকদের সঙ্গে যে আচরণ করবেন, তা-ই হলো রাজোচিত আচরণ।’’ বিগত ১৫ বছরে সে আচরণ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করতে পারিনি। বরং শাসকদের অহমের-অবহেলার শিকার হয়েছে অধিকাংশ জনগণ। এমনকি ফ্যাসিষ্ট সরকারের মন্ত্রিসভার তৈলমর্দনকারী মন্ত্রীদের ঠাট্টা-মশকরার শিকার এ-দেশের নিরীহ জনগণ। রাজনীতির মাঠে তাদের কিছু মুখরোচক নোংড়া উক্তি যেমন-‘খেলা হবে’। এমন অনভিপ্রেত মন্তব্যে আমাদের গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। এতে পতিত সরকারের করুণ পরিণতি মিডিয়ার কল্যাণে বিশ^বাসী দেখেছে। শাহবাগ চত্তরে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ক্ষুব্দ হয়ে আওয়াজ উঠায়, ‘‘তুমি-কে আমি-কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার’’। কতটা নিষ্ঠুর তামাশা হলে ফ্যাসিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে বুকপেতে দিয়েছিল আমাদের আগামীর স্বপ্নের পথ যাত্রীরা।
নোবেলজয়ী উপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে লিখেছেন, ‘‘মানুষ পরাজয়ের জন্য সৃষ্টি হয়নি। তাঁকে হয়তো ধ্বংস করা যায়, কিন্তু হারানো যায় না’’ কথাটির সারমর্ম হচ্ছে- মানুষকে ধ্বংস করা যায়, তার প্রজাতিকে কেউ ধ্বংস করতে পারে না। ফ্যাসিষ্ট সরকার চেয়েছিল কীভাবে ক্ষমতাকে আরও দীর্ঘায়ীত করা যায়। সে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা ও তারা রচনা করে গিয়েছিলেন। না তারা তা পারেন নি। ওই যে, নোবেলজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা মানুষ পরাজয়ের জন্য সৃষ্টি হয়নি। সেই অদৃশ্য মনোবল দিয়ে-ই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিষ্ট সরকারের নিষ্ঠুর শাসনের যবনিকাপাত ঘটেছে।
‘কোটা’কে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনের যাত্রা হয়েছিল, আন্দোলনে সক্রিয় সংগ্রামী ছাত্রদের মনে একটি অদৃশ্য ভয় দৃশ্যমান হয়েছিল। কিন্তু তাদের চোখে-মুখে দেখতে পেয়েছি সাহসের অলীক ছায়া। ভয়-ডরহীন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল রাজপথের চেনা গলিগুলো। তাদের আন্দোলনের দাবী-দাওয়া থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, সেটি হচ্ছে- সত্য যে কখনো কখানো খুব অসহায় হয়-খুব অসহায়। নিষ্ঠুর শাসকদের মন্ত্রীবর্গ থেকে শুরু করে তাদের পোষা আমলা, দলীয় অনুগতরা তাদের চারপাশে দাঁড়িয়ে সবাই সত্যটাকে মিথ্যা বলছে, দমন-পীড়ন করছে, আর এখান থেকেই আন্দোলনের লেলিহান শিখার অগ্নুৎপাত ঘটে।
প্রশ্ন হলো- এই আধুনিক বাহিনীও ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত দলীয় ক্যাডারবাহিনীর বিরুদ্ধে কী মন্ত্র ধারণ করে এইসব দানবীয় ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দীক্ষা পেল? কোন ভাষায় তারা কথা বলছে? কেন বলছে? বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের আবু সাঈদের মতো মেধাবী ছাত্ররা বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার সাহস পেল কীভাবে? সেই সাথে আরও শত শত শিক্ষার্থী কী মন্ত্রের বলে দাঁড়িয়ে গেল রাজপথে। কীভাবেই বা রিকশা ওয়ালা থেকে সর্বস্তরের জনতাকে তাঁরা লড়াই-সংগ্রামে শামিল করতে পারল? কারণ একটা-ই, তাঁরা লড়াই-সংগ্রামে দাবী তুলেছে বাংলাদেশের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় থেকে। বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বাহিনীর কাহিনী জানেন। ফ্রান্সের সান ডমিঙ্গো উপনিবেশের কালো দাসদের কাছে প্রবল পরাক্রমশালী বাহিনীটির পরাজয় হয়েছিল। কালো দাসদের মূল মন্ত্র ছিল ‘হয় মৃত্যু, নয় স্বাধীনতা’। হ্যাঁ দাসেদের বিজয় হয়েছিল। দেশটির নাম দিয়েছিল ‘হাইতি’। বাংলাদেশের যুবসমাজ, শিক্ষার্থী, জনতা ও একই রকম অঙ্গীকারে রাজপথে নেমে ফ্যাসিষ্ট সরকারকে তাঁড়িয়েছে।
কিছু কিছু শহীদের উক্তি আন্দোলন কে আরও বেগবান করে তুলেছিল। শহীদ আবু সাঈদ স্মরণ করেছিলেন- শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে, শহীদ মুগ্ধ’র সেই মায়াবী কথা ‘‘পানি লাগবে ভাই পানি।’’ শহীদ মুগ্ধ তাঁর মাকে বলেছিল, ‘‘মা আমি যদি শহীদ হই, আমার লাশ রাজপথ থেকে ততক্ষণ সরাবে না। যতক্ষণ না বিজয় আসে।’’ পুলিশ সদস্যের নিজের ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তিনি বলেছিলেন- তার বড় কর্তাকে- ‘‘স্যার একটা বাচ্চা ছেলেকে খুন করতে কয়টা গুলির দরকার হয়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পুলিশ কর্তা বলেছিলেন, ‘‘গুলি করি মরে একটা বাকিডি যায় না, এইটাই ভয় স্যার।’ এত সাহস, এত বীরত্ব, এত আত্মত্যাগ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে কখনও দৃশ্যমাণ হয় নি। একমাত্র সন্তানকে পুলিশবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে, মা তাঁর সন্তানকে বুকে সাহস দিয়ে হাসি মুখে বলেছিল, ‘‘যা বাবা যা- সাবাস বাবা সাবাস।’’
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ এর প্রথম শহীদ আবু সাঈদের জন্মভিটে রংপুর জেলার পীরগঞ্জে। বৃহত্তর রংপুরে জন্ম নিয়েছিলেন কৃষক আন্দোলনের নেতা ‘নূরুলদীন’। তিনি ছিলেন কৃষক। ১৭৮২ সালে দীর্ঘদেহী নূরুলদীন কৃষকদের ডাক দিয়ে ভরাট কণ্ঠে রংপুরের স্থানীয় ভাষায় বলেছিলেন, ‘‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’’। শহীদ আবু সাঈদ ও ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা বর্গা চাষী। পরের জমিতে ফসল ফলিয়ে যে ভাগ জুটে তা দিয়েই কোনো রকমে জীবনটাকে টেনে নিতে নিতে হাস-ফাস হয়ে যায়। আবু সাঈদ-ই ছিল আটভাই-বোনের একমাত্র ভরসার জায়গা। তিনি ইংরেজী বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন, একটি সরকারি চাকুরী পাওয়ার স্বপ্ন যখন বুঝতে পারলেন লুট হয়ে যাচ্ছে। এসব বৈষম্য নিয়ে যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে কথা বলতে চান, আর তখন-ই পুলিশের নিষ্ঠুর বুলেট তাঁদের কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে দিতে চেয়েছিল। ১৭৮২’র নূরুলদীনের ২০২৪ এর শহীদ আবু সাঈদ তাঁর উত্তর প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ খোকা। নূরুলদীনের প্রতিবাদের আওয়াজ আজও বহে বেড়ায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের শিরা-উপশিরায়। শহীদ আবু সাঈদ পুলিশের নিষ্ঠুর গুলির সামনে বুক টান করে দু’হাত প্রসারিত করে সমস্ত কিছুর মোহ-মায়া ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন রাজপথের তপ্ত পিচের বুকে। শহীদ আবু সাঈদ হয়তো সে-যুগের নুরুল দীনের মতো তেমন কিছু বলতে পারেন নি। বাংলার ফুঁসে ওঠা ছাত্রসমাজ তাঁর বিদেহী কথা বুঝতে পেরেছিলেন। শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের মনে মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিস্কুলিঙ্গ জ¦লে উঠেছিল। আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। নুরুলদীনও বৃটিশ বাহিনীর হাতে শহীদ হন। যেন উত্তর প্রজন্মের সত্যিকারের পুনরাবৃৃত্তি।
৩৬ জুলাই মতান্তরে ৫ আগষ্ট এই মাটির মানচিত্রে যে অবর্ণনীয় ও অভাবনীয় অভ্যুত্থানটি ঘটে গেল যা ছিল কল্পনাতীত। সেদিন কোনো জ্যোতিষিও তাঁর ফলাফল অনুমান করতে পারেনি। যেখানে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ‘সংসদ’টি হয়ে গিয়েছিল ৩৫০ সদস্যের একটি মালিক সমিতি। তাঁদের কাছে দাসত্ব বরণ করেছিল একটা বিরাট জনগোষ্ঠি। আকষ্মিক ভূমিকম্পের মতো করে সংগঠিত হয়ে গেল একটা প্রচণ্ড গণ-বিদ্রোহ। কেউ কেউ বলেন এটা একটা বিপ্লব। আসলে বিপ্লব হলে অতীতের সঙ্গে একটা বড় রকমের ছেদ পড়ে। না, সেদিন বিপ্লব ঘটেনি। গোটা আন্দোলনটির মুভম্যান্ট ছিল গণ-অভ্যুত্থানের। সবচেয়ে পীড়াদেয় এই বিষয়টি যে, গুলিবিদ্ধ লাশ যখন পুলিশ ভ্যানে তুলে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে নিথর দেহগুলো নিশ্চিন্ন করে দেয়। এই নিষ্ঠুর দৃশ্য বাঙালির স্মৃতির মানসপটে কতটা বিগলিত করবে, কতটা ক্ষত সৃষ্টি করবে, তা ভবিষ্যৎ-ই বলে দিবে। এই নিষ্ঠুর শাসকের প্রতি কতটা ক্ষুদ্ধ হলে ৩৬ জুলাই এদেশের সারাটা বিকেল লক্ষ জনতার বাঁধভাঙা উল্লাস-ই তার যথেষ্ঠ প্রমাণ। পাশপাশি কমবেশি ৩০ হাজার ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে যন্ত্রনায় কাতরানোর দৃশ্য বাঙালি চিরকাল বিষণ্ন চিত্ত্বে ধারণ করবে। শহীদ আবু সাঈদ, শহীদ মুগ্ধ’র মতো সহস্রাধিক শহীদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত পিচঢালা রাজপথ পেড়িয়ে জনতার মুক্তির উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়েছিল গণ- ভবনের মাটিতে। মনে রাখা দরকার যারা নির্যাতনকারী, তারা কোনো মহৎ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। সকল মহৎ সংগ্রামের, মহৎ ঐতিহ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছেন নির্যাতিত-নিপীড়িত-সংগ্রামী মানুষেরা। ৩৬ জুলাই সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের ফসল একমাত্র উত্তরাধিকারী ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও নিপীড়িত সংগ্রামী মানুষেরা। তাই সুকান্তের কবিতার মতো করে বলি-
‘‘হয় ধান নয় প্রাণ’ এ শব্দে
সারা দেশ দিশাহারা
একবার মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর ভয় তারা।
সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়।’’
লেখক: অধ্যাপক, কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক