বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪
৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মহাকাল ও মহাবিশ্ব
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ১২:১৪ এএম আপডেট: ৩০.১০.২০২৪ ৬:৫৬ পিএম |

 মহাকাল ও মহাবিশ্ব এই বিশ্ব যে এক জ্যোতিসমুদ্র, তেজোময় তরঙ্গে গঠিত, এ নিয়ে তো কোনও সংশয় নেই। সংশয় দেখা দেয় অন্যত্র। সংসারী মানুষের অনিবার্য প্রশ্ন, এই সমুদ্রে কি কেবলই শতদল পদ্ম রাজে? সমুদ্রমন্থন থেকে কি উঠে আসে না হলাহল? জীবনের যে পানপাত্র আমরা ওষ্ঠে তুলি তাতে কি নেই তিক্ততার স্বাদ? মানুষের চেতনার পরতে পরতে কি জমে ওঠেনি ভয়, হিংসা, নির্দয়তা/ এই বহমান জীবন কি শুধুই এক মধুর খেলা? “নয় এ মধুর খেলা” এ ও তো কবিরই কথা। তাঁরই আপন কন্ঠের স্বীকৃতিঃ “কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি-/সংসারের এই ৃদোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা।” এরই মাঝকানে জীবন “ধন্য” হয়ে উঠবে কোন পথে? না কি অধরা মাধুরীর কল্পনা এক মিথ্যা ছলনা যা নিয়ে পথ চলতে হবে “যাবা দিন” অবধি? এ প্রশ্নের আপাতবিরোধী নানা উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের নিজেরই লেখাতে। একদিকে জীবনের মাধুর্য, বিশ্বের আনন্দময় স্পর্শ, তাঁর কাছে এক “নিত্য” সত্য, যে কথা নিতি এমনই অজস্রবার বলেছেন যে, উদাহরণ তুলে ধরা নি¯প্রযোজন। অন্য দিকে তিনিই আবার আমাদের ভাবিয়ে তোলেন বারে বারে, প্রশ্ন তোলেন, তাঁ এই জীবনদর্শন কি সত্য অথবা শুধুই আত্নপ্রবঞ্চনাঃ “ আজ ভাবি মনে মনে/মরীচিকা অন্বেষণে হায়/বুঝি তৃঞ্চার শেষ নেই।”
এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এই জটিল প্রশ্নের, রবীন্দ্রদর্শনে পরিস্ফুট এই দ্ব্যর্থকতার, একটি সহজ সরল উত্তর নিয়েই সন্তুষ্ট। এঁদের মতে কবি তাঁর মধ্য জীবনের বিশ্বাস শেষ জীবনে হারিয়ে ফেলছিলেন, আক্রান্ত হচ্ছিলেন নাস্তিক্যমুখী এক অবিশ্বাসে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার জগৎকে বুঝবার পক্ষে কিন্তু এই সরল দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়। এ কথা মেনে নিতে বাধা নেই যে, কবির চেতনার বর্ণে রূপে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে জীবনের এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে। কিন্তু তাঁর জীবনদর্শনে একটা দ্ব্যর্থবকতা থেকেই গেছে, তাঁর চেতনার মূলে যার অবস্থান। বার্ধক্যে পৌঁছবার পরও তিনি বলতে পেরেছেন, “এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি,” বলেছেন, “দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।” এক মুহূর্তে শুনি তাঁর সাবধানী বার্ণ, “ তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে/হে ছলনাময়ী।” পরের মুহূর্তেই পেয়ে যাই তঁর দৃঢ় উচ্চারণ, “বাহিরে কুঠিল হোক অন্তরে সে ঋজু,” আর এই সহজ বিশ্বাসকেই তিনি বলেছেন, “চিরসমুজ্জ্বল।”
এই যে উভয়বলতা, যা থেকে কবির চেতনা লাভ করেছে তার গতিময়তা, তাকে স্থূল দৃষ্টিতে অস্থিরতা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা ভ্রান্ত বিচার, যা থেকে প্রকট হয় আমাদেরই চিন্তার দৈন্য। আসলে জীবনের ও বিশ্বজগতের গভীরেই আছে মহৎ কাব্যের ও প্রেমের দ্ব্যর্থকতার ভিত্তি। বাইরের দৃষ্টিতে যাকে বলি অন্তর্বিরোধ, অন্তরের দৃষ্টিতে তাকেই চিনি সত্য বলে। চিন্তার নানা স্তরে দ্বান্দ্বিকতা দেখা দেয় নানা রূপে, একে উপেক্ষা করলে সত্যের সঙ্গে পরিচয় থেকে যায় অসম্পূর্ণ। এই কথাটাই আমাদের বুঝে নিতে হবে যথাসম্ভব সহজ ভাবে।
ব্যক্তিমানুষের জীবন, তার সব খেলার আরম্ভ ও অবসান, “ খন্ডকালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে।” কিন্তু বিশ্বজোড়া প্রাণের প্রবাহ সম্বন্ধে কী বলব? মহাভারতের কর্ণ যেমন সূর্যের পুত্র, বিশ্বমানব তেমনি প্রকৃতির সন্তান, সেই প্রকৃতি যাকে মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। প্রকৃতি তাই মানুষকে দিয়েছে একদিকে মৃত্যুর অনিবার্যতা, অন্যদিকে প্রবহমান চেতনার প্রতীক ও ধারক হিসেবে অন্তহীন জীবনের সম্ভাবনা। মানুষের স্বভাবে, তার স্বধর্মে, আছে এই মৌল বৈপরীত্য।
মানুষের স্বভাবে প্রকৃতি রোপণ করেছে ব্যক্তি জীবনেরই প্রয়োজনে কিছু আবেগ ও সহজ প্রবৃত্তি। ভয়, ক্রোধ, লোভ, এই সবের যোগ রয়েছে প্রাণরক্ষার সঙ্গে। অমরত্ব আশা করা যায় না এ সব থেকে, তবু খন্ডকালের সীমার ভিতর ব্যক্তির জীবনসংগ্রামে এরা সহায়ক। দয়া, মায়া, সহানুভূতিকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে সমাজসংহতি সম্ভব নয়। বিপরীত লিঙ্গের ভিতর পারস্পরিক আকর্ষণ প্রকৃতি দান করেছে বংশরক্ষা অর্থাৎ জীবনের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখবার তাগিদে। মৌল প্রবৃত্তির তালিকা দীর্ঘতর করা নি®প্রয়োজন।
যেসব আবেগ ও সহজপ্রবৃত্তি বিধানে প্রাণধারণে সহায়ক, সেই সবই আবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে বিপদ সৃষ্টি করে। খাদ্য বিশেষত সুখাদ্যের প্রতি সুস্থ শিশুর লোভ অথবা আকর্ষণ থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বেলাতেও কথাটা খাটে। কিন্তু অতিলোভে বিপদ ঘটে। মাত্রারক্ষাটা জরুরি। এইভাবে পাওয়া যায় নিতান্ত জৈব স্তরে দ্বান্দ্বিকতার সহজ পরিচয়। একটা মাত্রার ভিতর যেটা তারক, মাত্রার বাইরে সেটাই আবার মারক। অবস্থাবিশেষে ভয়ও আত্নরক্ষায় সহায়ক হয়। অথচ ভয় যেখানে প্রবল, মনোবল সেখানে দুর্বল। ভয়ে কবলিত মানুষ আত্নরক্ষার শক্তিও হারায়। ভীতি থেকে সৃষ্টি হয় একরকমের জড়তা। তামসিকতার এটাই প্রধান লক্ষণ।
জড়তাকে খন্ডন করে দেখা দেয় দ্বন্দ্বের অন্য এক প্রকাশ, জীবনের সচলতা। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রবৃত্তিসমূহকে, বিশেষত সমাজে তাদের বহিঃপ্রকাশকে, মানুষ ক্রমাগত রূপান্তরিত করে চলেছে। দেশে কালে লক্ষ করা যায় তাদের পরিবর্তনশীলতা। বিশ্বময় মানুষের মৌল প্রকৃতিতে যদিও মিল আছে তবু কোনও দুই দেশে অথবা দুই যুগে মানুষের জীবনযাত্রা অভিন্ন নয়। প্রকৃতির এই রূপান্তরকেই বলা চলে সংস্কৃতি। অভ্যস্ত সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনের যোগ কখনও এতই ঘনিষ্ঠ যে তাকেই তখন প্রকৃতি বলে বোধ হতে পারে, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি মিলে মিশে সেখানে একাকার। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। নারীপ্রকতি বলে সমাজে যাকে চিহ্নিত করা হয় তার কতটা প্রকৃতিপ্রদত্ত আর কতটা সংস্কৃতি দিয়ে গঠিত এ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। সংস্কৃতি যেখানে সংস্কারে অথবা কুসংস্কারে আবদ্ধ সেখানে তার পরিবর্তন ঘটানো কঠিন কাজ। তবুও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য তার সচলতায়। অন্যান্য জীব থেকে মানুষের অনন্যতা এখানে, সংস্কৃতির সে স্রষ্টা। এই সৃষ্টিকর্মের অনেকটা ঘটেছে প্রয়োজনের তাড়নায়। অনেকটাই আবার নিছক জৈব প্রয়োজনের সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে ভালয় মন্দেঃ এর কিছুটা দুর্ভাগ্যজনক, কিছুটা আশ্চর্য সুন্দর।
আবারও উদাহরণের আশ্রয় নেওয়া যাক। অনুমান করা যায় যে, ধরুন বিশ হাজার বছর আগে-মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে যেটাকে কিছুতেই খুব একটা দীর্ঘ কাল বলা যায় না-মানুষের কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হত কিছু অস্পষ্ট ধ্বনি, শব্দভান্ডার ছিল নিতান্ত সীমাবদ্ধ। ক্রমে শব্দের ওপর মানুষের অধিকার বি¯তৃত হল। বাক্যগঠনের কৌশল বৃদ্ধি পেল। প্রথম পর্বে প্রয়োজনীয় বার্তা বহন করা, বিপদের আভাস দেওয়া, কিছু দাবি অথবা আদেশ জানানো, এই সবই সম্ভবত প্রাধান্য পেয়েছে বাক্যের ব্যবহারে। সেই মানুষই ধীরে ধীরে বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে সৃষ্টি করেছে সাহিত্য, ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে  কাব্য। আশ্চর্য মানুষের এই সৃষ্টি। ধ্বনি ও চেতনার কোন গুণ থেকে আমরা পৌঁছে যাই কাব্যে, এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এই সবের সঙ্গে জৈবতার যোগ আছে, কিন্তু নিতান্ত জৈব প্রয়োজন দিয়ে কথা সম্পূর্ণ হয় না। কাব্যরস আমাদের নিয়ে যায় চেতনার অন্য এক স্তরে। এইখানে উদ্ঘাটিত হয় অন্য এক অন্তর্বিরোধ। ভাষার ব্যবহারে মানুষ পেয়েছে সকল জীবের ভিতর শ্রেষ্ঠত্ব। আবার ভাষারই অপব্যবহারে মানুষ দুর্নীতিতে অতুলনীয়। এই অপব্যবহারে সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ ইচ্ছাকতৃ ও দুরভিসন্দিজনিত মিথ্যাভাষণ। ভাষাকে আশ্রয় করে মানুষের সংস্কৃতি ও সৃষ্টিকর্মের যে প্রধান ক্ষেত্রটি চিহ্নিত হয়ে আছে এই ভাবে তারই সীমানার ভিতর আমরা পাশাপাশি পেয়ে যাচ্ছি শুভে অশুভে মিশ্রিত চেতনার নানা স্তরের সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। 
এরপর একটু বিস্তারিতভাবে আরও কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা যাকঃ যৌনতা, আহার, জীবনতৃঞ্চা। সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখলে এদের প্রত্যেকটিরই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং আলোচনার যোগ্য জটিলতা আছে।
যৌন আকর্ষণের মূলে প্রকৃতির উদ্দেশ্য বংশবৃদ্ধি। কোথাও কোথাও ব্যাপারটাকে নৈতিক অনুশাসনের অন্তর্গত করবার চেষ্টা হযেছেঃ বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্য ছাড়া যৌন সম্পর্ক বর্জনীয়। এই নিয়ম যত না পালন করা হয় তার চেয়ে লঙ্ঘন করা হয় অনেক বেশি। সন্তান উৎপাদন নিরোধ করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের নানা উপায় প্রচারিত ও প্রচলিত হয়েছে। এতে আইনের বারণ নেই, বরং সমর্থনই আছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। যৌনতা নিয়ে তবু স্বচ্ছন্দ ও পরিচ্ছন্ন আলোচনা আমাদের পরিচিত সমাজে বিরল। বিষয়টা যেন চলে গেছে যুক্তির ধরাছোঁওয়ার বাইরে। 
যৌনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটা বিষম পাপবোধ। ব্যাপারটা অবশ্য বোধগম্য, যদিও যুক্তি দিয়ে সমর্থনযোগ্র নয়। নরনারীর যৌন আকর্ষণের মধ্যে এমন একটা তীব্রতা আছে যে, সেটা সহজেই হয়ে ওঠে একটা অবাধ্য ও যন্ত্রণাদায়ক বন্ধনের দশা। প্রেমে ব্যর্থতার কারণে আত্নহত্যার ঘটনা থেকে এই বন্ধনের শক্তির খানিকটা পরিমাপ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আছে অকথ্য যৌন হিংস্রতা, পাপবোধ দিয়ে যাকে আটকানো যায়নি। এর পরের কথাগুলি সাজিয়ে নিচ্ছি পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, যদিও সামান্য অদলবদল করে নারীর দৃষ্টিভঙ্গিকেও এর সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব। নারীকে যখন “নরকের দ্বার” বলা হয় তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে ওটা পুরুষের উক্তি, সেই পুরুষ যার আত্নশক্তি দুর্বল, নারীর আকর্ষণে আবদ্ধ হয়ে পড়বার আশঙ্কা প্রবল। যৌনতার সঙ্গে পাপবোধের যোগের মূলে আছে একরকমের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয়। নারী ও নর উভয়ের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। নিরাপত্তার অভাবের বোধ। এ থেকে উৎপন্ন হয় হিংসা, সন্দেহপরায়ণতা, প্রেমের বিকৃত রূপ। 
পুরুষ দাবি করে এসেছে তার সঙ্গিনীর ওপর সম্পূর্ণ অধিকার। নারীকে হতে হবে অবিচলভাবে একনিষ্ঠ। এই দাবিতে একটা অসঙ্গতি আছে। পুরুষের আকাক্সক্ষা, তার স্ত্রী হবে এমনই মনোহারিণী অথচ সাধ্বী যে, সে বহু পুরুষের হৃদয় জয় করতে পারবে কিন্তু স্বামী ভিন্ন কোনও পুরুষকেই হৃদয় দান করবে না। প্রচলিত সংস্কৃতির বিচারে স্ত্রীর বহুগামিতা অমার্জনীয় অপরাধ, পুরুষের বহুগামিতা স্বাভাবিক ও মার্জনীয়। যতদিন স্ত্রীজাতির আর্থিক স্বাধীনতা ছিল না ততদিন এই ব্যবস্থাটা মোটামুটি চলছিল। এখন পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থার উপযোগী সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। আমাদের চোখের সামনেই বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। চোখের বাইরে, মৃত প্রেমকে আগলে ধরে বহু দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে সামাজিক অপবাদের ভয়ে। প্রেমের এই পরিণতি দুঃখজনক।
এটা বিশেষভাবে দুঃখজনক এই কারণে যে, নর নারীর সম্পর্কের মধ্যে আছে এক আশ্চর্য মাধুর্যের সম্ভাবনা যেটা পরম মূল্যবান। দুটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব তাদের স্বাতন্ত্র্যের সীমানা ছাড়িয়ে সাময়িকভাবে হলেও পুনঃ পুনঃ দেহে মনে অভেদের অনুভূতি লাভ করছে, খন্ডকালে সীমার ভিতর এ এক সীমাভাঙার অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। একে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন এর সহায়ক সংস্কৃতি, যেখানে নরনারীর প্রেমের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্পূর্ণ শুভেচ্ছা ও কিছুটা অনাসক্তির মিলন হয়ে উঠবে যৌনশিক্ষার অঙ্গ ও সাধনার বস্তু। প্রেমপূর্ণ অথচ নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়েই শিল্পী তাকাল প্রকৃতির দিকে, নারীদেহের সঙ্গে যার তুলনা স্বাভাবিক। স্বচ্ছ সেই দৃষ্টিতে নগ্নতাও নির্দোষ; বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে আছে লতা, দিবালোকে øাত, চেতনার মুকুরে প্রতিবিম্বিত কল্পনার øিগ্ধতায়। যৌনতার সঙ্গে পাপবোধকে যুক্ত করে আর যাই পাওয়া যাক না কেন, মাধুর্য অথবা মনের মুক্তি কোনওটাই লাভ করা যায় না। সমাজের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে এ কথাটা স্পষ্ট। ঈর্ষা ও আধিপত্যের অহংকার থেকে নরনারীর সম্পর্ককে মুক্ত করাটা জরুরি, কারণ এদেরই প্রভাবে ঘটৈ প্রেমের বিকৃতি ও অপমৃত্যু। এটা সহজ কাজ নয়, তবু রক্ষণশীলতার সমস্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও এটাই সুস্থ সংস্কৃতির যোগ্য লক্ষ্য। পাপবোধ নয়, সহজ øিগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকাতে শেখাটাই কাম্য। 
প্রকৃতির বিধানে বংশরক্ষার জন্য যেমন প্রয়োজন যৌনতা, জীবনরক্ষার জন্য তেমনি আহার। এখানেও মানুষ প্রকৃতির ন্যূনতম প্রয়োজনকে অতিক্রম করে গড়ে তুলেছে তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। কারণ মানুষ জীবনরক্ষা করেই সন্তুষ্ট নয়। সে আরও চায়, সুখ, তারপর সুখকে অতিক্রম করে হয়তো পায় আনন্দ। “আমি যখন ছিলেন অন্দ/সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাইনি তো আনন্দ।” খেলাটা অবশ্য জীবন নিয়ে। আহার এখানে উদাহরণ মাত্র। প্রশ্নটা তবু থেকেই গেল, সুখ থেকে আনন্দে উত্তরণ বলতে কবি কী বোঝাতে চাইছেন? দ্বন্দ্বটা কোথায়? প্রশ্নটা তোলা রইল। উত্তর খোঁজা যাবে পরে। তার আগে আহার নিয়ে আলোচনাটা আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।
এই উপমহাদেশে অনেক মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য পায় না দারিদ্রের পীড়নে। এরই মাঝখানে স্থান লাভ করেছে রন্ধনের রকমারি কৌশল, সমৃদ্ধ সমাজে তার বিশেষ কদর। যেমন বাঙালি সমাজে পিঠে পায়েস ও মাছের নানা রকমের রান্নার উল্লেখ করতে হয়। সারা বাংলাদেশেই রান্নার খ্যাতি আছে। কিছু বিদেশি রান্নাও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, যেমন চীনে রান্না। রন্ধননৈপুণ্য একটা শিল্প বটে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে আছে এর বিশেষ স্থান। সেই সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু বিশেষ সমস্যাও, যাদের উপেক্ষা করা চলে না। 
এ দেশের মানুষ অতিথিপরায়ণ। এটা সদ্গুণ, বিশেষত দরিদ্র গ্রামবাসীর কুটিরেও যখন এই গুণটি মান্য হয়। কিন্তু হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই স্বল্প সমৃদ্ধ পরিবারেও দেখা যায় উৎসবে অনুষ্ঠানে, এমন কী সাধারণ সামাজিক নিমন্ত্রণে, আহারের যে আতিশয্য, খাদ্যের যে অপরিমিত অপচয়, জনকল্যাণের দৃষ্টিতে তাকে কোনও প্রকারেই সমর্থন করা যায় না। নবাবি ও জমিদারি আভিজাত্যের প্রভাবেই সম্ভবত বাঙালি সমাজে এবং অন্যান্য কোনও কোনও অঞ্চলে সংস্কৃতির এই বিকৃতি অত্যন্ত প্রকট। দারিদ্র্যের মাঝখানে অসাম্য ও অপচয়ের এই অপসংস্কৃতি ধিক্কারযোগ্য।
মনে রাখা ভাল, ভোজনবিলাসের আতিশয্য দেহের ও মনের স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। পুষ্টিকর অথচ লঘুপাক আহারই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। সাধারণ সুস্থ মানুষের থাকে সরল শুদ্ধ আহারে তৃপ্তিলাভ করবার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা। ভোজনবিলাসে অভ্যস্ত, মানুষ সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের পক্ষেই রাজসিকতার এই প্রভাব ক্ষতিকর। দারিদ্র নয়, কিন্তু সরল জীবনেই আনন্দ বেশি, সমাজ সংহতি রক্ষা করবার শক্তিও বেশি।
আনন্দ কাকে বলে? অবশেষে আমাদের যেতে হচ্ছে কবির গভীরতর বার্তায়। সুখের অস্থায়ী চাঞ্চল্যে ব্যর্থতা আছে। আনন্দ আমাদের উদ্ধার করে সেই ব্যর্থতাবোধ থেকে। সুখ আত্নকেন্দ্রিক, জীবনতৃঞ্চার মতোই সুখের আকাঙক্ষা দুর্জয়। আনন্দের মূলে আছে আমাদের ক্ষুদ্র সত্তাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর ভাবের সঙ্গে যোগের উপলদ্ধি। ব্যক্তিত্বের লোপ নয়, ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বের যোগে সমৃদ্ধ এই উপলব্ধি। যে শুদ্ধ তেজ এই বিশ্বপ্রকৃতিকে ব্যাপ্ত করে আছে, তারই এক আশ্চর্য বিকাশ ঘটেছে মানুষের চেতনায়। মহাজাগতিক এই উপলব্ধিতে জীবনতৃঞ্চার রূপান্তর ঘ্েট, প্রশস্ত প্রাণপ্রবাহের প্রতি মমতায় ও বিস্ময়বোধে। ব্যক্তিবিশেষের জন্মান্তর নেই। কিন্তু অনন্ত জীবনধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে, হয় তো বা গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। বাইরের দৃষ্টিতে যাকে বলি জড় প্রকৃতি, তার সঙ্গে চেতনার আছে নাড়ির যোগ। “ গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি” কথাটার অর্থ কী? তেজোময় ভুবনের তরঙ্গের সঙ্গে যখন ব্যক্তিচেতনার অন্তর্লীন তরঙ্গের যোগ ঘটে তখনই সৃষ্টি হয় সঙ্গীত, লব্ধ হয় ভয় থেকে অভয়ে, সীমা থেকে অসীমে, মুুক্তি। ব্যক্তির জীবনে আছে ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয় ক্ষতি, কবি যাকে বলেছেন “নিমেষের কুশাঙ্কুর।” আছে মৃত্যুভয়, খন্ডকালের আর্তনাদ। কিন্তু যে জ্যেতিসমুদ্র থেকে চেতনার উদ্ভব তার শেষ কোথায়? এই মহাবৈশ্বিক বোধের সঙ্গে জীবন ও সমাজের সুরকে যথাসম্ভব মিলাবার প্রয়াসেই মানুষের গৌরব। এই তো “সত্যের আনন্দরূপ”।
অবশ্য শব্দের ব্যবহার নিয়ে কিছু নিষ্ফল কলহ আছে। সে সব দূরে ঠেলে রেখে কথাটা এবার অন্যভাবে বলা যাক। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের সম্পর্কের প্রকারভেদ রয়েছে। দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এখানে বিশেষভাবে বিবেচনার যোগ্য। এক ধরনের দৃষ্টিতে প্রয়োগের অর্থাৎ লৌকিক প্রয়োজন সাধনের প্রশ্নটা প্রধান। একে বলব প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষ কোনও অবস্থায় আমাদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কোন কৌশল অথবা পদ্ধতি উপযুক্ত হবে, এই চিন্তারই সেখানে আধিপত্য। ব্যবসায় ও রাজনীতিতে, অর্থ এবং ক্ষমতা যেখানে মূল আকাক্সক্ষার বস্তু, এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট। সংসারের ছোট বড় অন্যান্য কাজেও এই ঝোঁকটা প্রবল। একে ঘিরে থাকে নানা স্বার্থ ও আবেগের আচ্ছন্নতা। 
এরই পাশে আছে অন্য এক দৃষ্টিকোণ যেখানে বিশ্বকে আমরা দেখি প্রয়োজনের সীমানা ছাড়িয়ে। আকাশের রামধনুর দিকে তাকাই ওই দৃষ্টিতে। শিশুর জগতে, পৃথিবী যখন নবীন, চেতনার এই দিকটা সহজ ও সবল। সেই চেতনায় জগৎ ধরা দেয় এক বিশেষ উজ্জ্বলতায় আবৃত হয়ে। এটা ঘটে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর উপলব্ধিতেও, সেই শিল্পী যিনি তাঁর উজ্জ্বল চেতনার একখন্ডকে ধরে রাখতে চান চিত্রে কিংবা কাব্যে, রেখায় ছন্দে কিংবা দেহের কোনও ভাবময় ভঙ্গিতে। মনে হয় আদিম মানুষের ভিতরেও ছিল এই শিল্পবোধ। তা নইলে সেই বর্বর পরিবেশে আশ্চর্য গুহচিত্র অঙ্কনের প্রেরণা এল কোথা থেকে? চৈতন্যের এই স্তরে নেই অন্য কোনও প্রত্যাশার আধিপত্য, আছে একটি সরল উচ্চরণ, “বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে!” আমরা লাভ করি এইভাবে অস্তিত্বের গভীরতর মূল্যবোধ।
এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির একটিকে যদি বলি প্রায়োগিক, অন্যটিকে বলা যেতে পারে দিব্য অর্থাৎ জ্যেতির্ময়। এদের কোনওটিকেই কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। কিছু দার্শনিকের স্থির সিদ্ধান্ত, জড়বাদ ও ভাববাদ এই দুয়ের ভিতর একটিকে আমাদের বেছে নিতে হবে। এটাই না কি যুক্তির দাবি। এই দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এই মহাবিশ্ব যে উপাদানে গঠিত তার মৌল বৈশিষ্ট্য এই যে, জড় ও চেতন সত্তা উভয়ের সঙ্গেই তার নিশ্চিত সঙ্গতি আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাম দেওয়া সম্ভব নিরপেক্ষ অভেদবাদ। নামকরণ নিয়ে দার্শনিক বিতর্ক এখানে নি®প্রয়োজন। মানুষের স্বাভাবিক বোধ কখনও কখনও দার্শনিকদের তর্ক অপেক্ষা সহজে সত্যের অনুভবে পৌঁছে যায়। চেতনার স্তর অনুযায়ী জ্ঞানেরও প্রকারভেদ আছে, লৌকিক জ্ঞান ও দিব্য জ্ঞান। এই দয়ের কোনওটিই মিথ্যা নয়। এদের মিলন লক্ষ করা যায় লোকসঙ্গীতে, সাধারণ গ্রামবাসীর চেতনাতেও। শত বঞ্চনা সত্ত্বেও সংসারের মোহিনীমায়া মানুষকে মুগ্ধ করে আবার সত্তার দিব্যতাও তাকে স্পর্শ করে যায়। খন্ডকালের সীমার মধ্যে বিধৃত মহাবিশ্বের যে-প্রতিচ্ছবি, তাতেই নিহিত এই দ্বান্দ্বিকতা। একে অমান্য করে গঠন করা যাবে না লোকমান্য কোনও মানবতাবাদ। রবীন্দ্রভাবনায় যে দ্বন্দ্ব আমরা লক্ষ করেছি সে তো সত্যেরই স্বীকৃতি। চেতনার দুই মেরুর ভিতর অনায়াস যাতায়াত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে দিয়েছে তার অতুলনীয় স্বকীয়তা। করুণায় ও অনাসক্তিতে আশ্রিত মহৎ সাহিত্যের দৃষ্টি নিয়ে তাকালে মানুষের এই দ্বন্দ্বময় সংসারও হয়ে ওঠে মহাকাব্যের তুল্য। এই মহত্ত্ববোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে লাভ করা যায় না মানুষের সভ্যতাকে রক্ষা করবার যথার্থ কোনও প্রেরণা।












সর্বশেষ সংবাদ
রংপুরে ভূমিকম্প অনুভূত
ড. ইউনূসের ৬ মামলা বাতিল
ব্যারিস্টার সুমন ২ দিনের রিমান্ডে
কমলাপুর থেকে ছাড়ছে না কোনো ট্রেন, যাত্রীদের ভোগান্তি
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা টাউন হলের সকল কমিটি বাতিল
কুমিল্লায় চার জনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক
২৪ সেনার দেহাবশেষ সরিয়ে নিচ্ছে জাপান
ইপিজেডের বর্জ্য শোধনাগার কার্যক্রমের বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়
বাখরাবাদ গ্যাসের কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি বশির আহমেদ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২