আমি যেন একটা
ইচ্ছাপত্র লিখতে বসেছি। ইচ্ছার অন্ত নেই, বিষয়ের শেষ নেই। যে কথাটাই বলতে
চাই, একটা পালটা কথা পথ রুখে দাড়াঁয়। যে ইচ্ছাই মনে আসে, দেখি তার
বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা কঠিন নয়। আমার প্রিয় বন্ধু প্রয়াত মিনার মাহমুদের
একটি কবিতার নাম শেষ খুঁটিগুলো। কবিতার প্রথম লাইন, শেষ খুঁটিগুলো খুব শক্ত
করে ধরে রাখতে চাই। আজকের দিনে চারদিকের মানুষগুলো যাকে খুঁটির জোর বলে
থাকেন, মিনার নিশ্চিতভাবেই সেই খুঁটির কথা বলছেন না এখানে। তিনি বলছেন আরও
গভীর কোনো সত্যের কথা, বিশ^াসের কথা, যার উপর নির্ভর করে বাঁচা যায় এবং মরা
যায়। আমাদের মন চায় সেই রকমের কিছু খুঁটি, সহজে যা লভ্য নয়, তবু নানা
আপত্তি ও সংশয়কে অতিক্রম করে যাকে হয়তো খুঁজে পাওওয়া সম্ভব। নয়তো সবই কেমন
অর্থহীন হয়ে পড়ে। সার্বিক অর্থহীনতার দর্শনে আমাদের মন সায় দিতে চায় না,
মানুষের চেতনার গভীরে এমন কিছু আছে। অথচ সংশয়েরও স্থান আছে জীবনে, তা নইলে
মানুষ বাধা পড়ে যায় অন্ধ বিশ^াসের মিথ্যা ছলনায়, যেখানে স্থান নেই যুক্তির ও
শুভবুদ্ধির। সংশয়কে সঙ্গী করেই মানুষের অনন্ত অনুসন্ধান। সেই প্রত্যয়ই
নির্ভরযোগ্য, সংশয়ের অস্থিরতা ও বেদনার সঙ্গে যার পরিচয় আছে। সেই ইচ্ছাই
সদিচ্ছা, অতি ইচ্ছার সংকট থেকে যে মুক্তি পেয়েছে।
কিছুু আদর্শকে আমরা
শ্রদ্ধার চোখে দেখি। সত্য। সাম্য। প্রেম। আদর্শ হিসেবে অনন্ত প্রথম
দৃষ্টিতে, এদের প্রতিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। প্রশ্নের ঊর্ধ্বে স্থাপিত হলে এই সব
আদর্শও কিন্তু শব্দমাত্র হয়ে ওঠে। প্রশ্নের স্পর্শেই এরা অর্থ লাভ করে, মৃত
শব্দে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হয়। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক :
সত্য। সদা
সত্য কথা কহিবে। এই রকমের একটা নীতিবাক্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত। কোনো কোনো
পরিস্থিতিতে সত্যকথন যে বিপজ্জনক হতে পারে এ কথাও আমরা জানি। কিন্তু আরও
মৌল একটা প্রশ্ন প্রায়ই অনুচ্চারিত থাকে। সত্য সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ হব
কী করে? কী সত্য, তাই যদি আমরা না জানি, তবে সদা সত্য কথা বলবার পরামর্শটা
মেনে চলব কী করে?
এই আপত্তিটা সহজে কাটাবার কৌশল হিসেবে বাক্যটা অবশ্য
অন্যভাবে সাজানো যায়; যা সত্য বলে বিশ^াস করবেন তাই বলবেন। কিন্তু এইভাবে
রাখলেও কি কথাটা সম্পূর্ণ দাঁড়ায়? যে স্বামী স্ত্রীকে সর্বদা সন্দেহ করে
চলেন (অথবা স্ত্রী স্বামীকে) তিনি জোরের সঙ্গে যেটা তিক্তভাবে বিশ^াস করেন
সেটা বলে চললেই কি সুনীতি ও সত্য রক্ষিত হয়? আরেকটা জটিল কথা আছে বিপরীত
ধরনের সেটাও উল্লেখের যোগ্য। সংস্কৃত একটি শ্লোক বাংলা অনুবাদে এইরকম
দাঁড়ায়– সত্য বলবে প্রিয় বলবে। অপ্রিয় সত্য বলবে না। এটা কি তবে প্রিয়
মিথ্যা ভাষণের পরামর্শ? তা তো হতে পারে না। তবে কী? সত্যবাদিতার মূল্য
অস্বীকার করা ভুল।
এবার আসা যাক সাম্যের কথায় বলা হয়েছে, সব মানুষই
সমান, জন্মসূত্রেই সমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এমন বাক্য বলা
আছে। একই ধরনের উক্তি আর নানা জায়গায় পাওয়া যাবে। ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু
করে বিশ শতকের কত কপট সাম্যবাদী ঘোষণর কথা মনে পড়ে। ঘোষিত আদর্শের সঙ্গে
প্রত্যক্ষ বাস্তবের অসামঞ্জস্য সর্বত্র প্রকট।
অসাম্যের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ শ্রদ্ধেয়, বিশেষত সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে সামাজিক বিধানের দ্বারা
আর ক্ষমতার দাপটে অসাম্য মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো বিশেষ জাতি
অথবা বৃহৎ গোষ্ঠী অন্য কোনো জাতি অথবা গোষ্ঠীর তুলনা উৎকৃষ্ট অথবা নিকৃষ্ট
এই ধরনের চিন্তায় আমার আস্থা নেই। কিছু মানবিক অধিকারের কথা সমর্থনযোগ্য।
সব মানুষেরই নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী আত্মোন্নতির সুযোগ থাকা উচিত। আর যেহেতু
অনেকেরই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাসমূহ প্রথম থেকেই সুস্পষ্ট নয় বরং আবিষ্কারের
অপেক্ষা রাখে, সেই কারণে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণভাবে নিজের জীবন
নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কিছুটা মানবিক স্বাধীনতা যে সমাজ মেনে নেয়,
তাকেই উন্নত সমাজ বলা যায়। পরিবেশের প্রতিকূলতা কাটিয়ে মানুষ যাতে বিকশিত
হয়ে উঠতে পারে সেই দিকেই সামজের সতর্ক দৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়। মানুষের
বিচিত্র সম্ভাবনার কথা মেনে নেওয়ার পরও কিন্তু এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছনো
যায় না যে, অন্তর্নিহিত যোগ্যতার বিচারে সব মানুষই সমান। পরিবেশ অনুকূল
হলেই কি সব মানুষের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ অথবা আইনস্টাইন বা ওইরকম কিছুু একটা
চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা সম্ভব? এমন কোনো চিন্তাকে সাম্যের ধারণার
অংশ করে নিতে গেলে সেটা হয়ে ওঠে একটা অবাস্তব কল্পনা, সত্যের সঙ্গে তাকে
মেলানো যায় না। আমাদের সন্ধান করে নিতে হবে এমন কোনো সম্যাদর্শন যাতে সত্য
রক্ষা পায়।
সাম্যের আলোচনায় ফিরে আসা যাক।
এর একটা আছে বাইরের দিক।
যেমন গণতান্ত্রিক সমাজে সমস্ত সাবালক নাগরিকের ভোটদানের সমান অধিকার। অথবা
আইনের চোখে সবাই সমান। প্রত্যেকটি ভোটের সমান মূল্য এ কথার অর্থ কিন্তু এই
নয় যে, ভোটদাতারা বুদ্ধি বিচারে শিক্ষাদীক্ষায় সবাই সমান। তেমনি আইনের
দৃষ্টিতে সবাই সমান বলতে এমন কথা ধরে নেওয়া হচ্ছে না যে, সততায় বা সাধুতায়,
সব মানুষই সমান মাপের। এইটুকুই শুধু ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, কে সাধু আর কে
নয়, এ বিষয়ে কোনো পূর্ব কল্পনা থেকে বিচার শুরু করা উচিত হবে না। যেমন কেউ
ব্রাহ্মণ এই কারণেই তিনি সাধু এমন পূর্ব কল্পনা গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রাহ্য
নয়। কিছু মানুষ অপেক্ষাকৃত সৎ, কিছুু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত, এই বাহ্য
ব্যাপারটা স্বীকৃত, তবু আইনের চোখে সবাই সমান। সাম্যভাবনা এটা বাইরের দিক।
আরেকটা
আছে অন্তরের দিক। সেটা সাম্যবোধের আন্তরিক ভিত্তি। মায়ের পাঁচটি সন্তান
এরা বিদ্যাবুদ্ধিতে, রূপে-গুণে সমান নয়। একই পরিবেশে বড়ো হয়েছে, তবু
কৃতিত্বে সমান নয়। মায়ের ভালোবাসা কিন্তু চলে না গুণাগুণের হিসেব ধরে।
বাইরের বিচারে অসমান সন্তানেরাও মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা পেতে পারে সমানভাবে।
যে সন্তানটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয় তো সেটিই মায়ের হৃদয় জুড়ে আছে বেশি করে।
মায়ের
স্নেহ-ভালোবাসা প্রায়ই রক্তের সম্পর্কের গণ্ডিতে আবদ্ধ। মাতৃভাব কিন্তু
সেই সীমাকে অতিক্রম করে যেতে পরে। কেউ কেউ হয়ে ওঠেন লোকমাতা। রক্তের
সম্পর্ক দিয়ে তখন নির্ধারিত হয় না হৃদয়ের পরিধি। আফ্রিকার এক দরিদ্র গ্রামে
গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এক শে^তাঙ্গ পুরুষ। ডাক্তারের পরামর্শে প্রধান
পথ্য হিসেবে নির্দিষ্ট হলো দুধ। সেই গ্রামে তখন দুগ্ধ দুষ্প্রাপ্য। গ্রামের
দুগ্ধবতী মায়েরা সেই বিদেশি মানুষটিকে সেদিন দান করেছিলেন নিজের স্তন্য।
হৃদয় মানেনি জাতপাতের সীমা– বর্ণভেদের বিধান। কথাটা এবার আরও সাধারণভাবে
বলা যাক। মানুষের স্বভাবে একদিকে যেমন আছে স্বার্থবুদ্ধি এমনকি নিষ্ঠুরতা,
অন্যদিকে তেমনি আছে স্নেহ-সহানুভূতি ও শুভবুদ্ধি। স্নেহ-ভালোবাসা যখন থাকে
কোনো নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতর আবদ্ধ তখন তার অধঃপতনের সম্ভবনা প্রবল।
স্বদেশ অথবা স্বজাতির প্রতি প্রীতি থেকে অতি সহজে জন্ম লাভ করে বিদেশির
প্রতি বিদ্বেষ। সেই শুভেচ্ছাই এই আত্মখণ্ডন থেকে মুক্ত যার আছে সীমা ভেঙে
ছড়িয়ে পড়ার শক্তি। আইন ও সংবিধান তো বাইরের জিনিস, যদিও মূল্যবান। সাম্যের
আন্তরিক ভিত্তি সেই হৈতুকী প্রীতি, সেই শুভেচ্ছা, সীমা ভাঙাতেই যার আনন্দ।
এর স্পর্শে বিবেক হয়ে ওঠে প্রাণবান; এর অভাবে আইন, বাহ্যত যদি বা
ন্যায়সংগত, তবু থেকে যায় দুর্বল অক্ষম। যে প্রেম একান্তভাবে সীমাবদ্ধ তারও
আছে জৈব উদ্দেশ্য আর প্রতিষ্ঠিত সমাজে ও সম্পত্তির অধিকারে বিশেষ স্থান।
তবে তা থেকে এতই সহজে সঞ্জাত হয় ঈর্ষা, ভয় ও ভেদবুদ্ধি যে, তাকে মানুষের
মহত্তম আদর্শের সঙ্গে মেলানো কঠিন। আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে যে সহজ
প্রীতি তা থেকে লাভ করা যায় অন্য এক মুক্তির স্বাদ, সদা প্রবাহিত জীবনের
স্রোতের সঙ্গে যোগ অতএব মৃত্যুভয় থেকেও মুক্তি, সংকীর্ণ বিষয়াসক্তি থেকে
মুক্তি তো বটেই। জৈব প্রেম আর অলৌকিকী প্রীতি উভয়েরই সন্ধান পাওয়া যায়
মানুষের চেতনায়। আকাক্সক্ষা ও উপলব্ধির এই দুই স্তরের ভিতর প্রভেদ গুণগত।
প্রথমটি স্পষ্টতই ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত, প্রতিতুলনায় দ্বিতীয়টিকে
আধ্যাত্মিক বলা হয়ে থাকে। ঈশ^রে বিশ^াস নিয়ে তর্ক ভিন্ন জিনিস। আমার
চিন্তার কেন্দ্রে সেটা কখনো স্থান পায়নি কিন্তু উপলব্ধির সেই স্তরের সঙ্গে
আমাদের অনেকের কিছুটা পরিচয় আছে যাকে আধ্যাত্মিকতা নামে চিহ্নিত করা সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের গানে যখন আমি তার সন্ধান পাই তখন তাকে কেবল কল্পনা নয়, সত্য
বলেই মানি।
শব্দ আমাদের প্রত্যারণা করে, সেই সম্ভাবনা তুচ্ছ নয়। তবু
শব্দের সহায়তা নিতেই হয়, নয়তো আমরা অসহায়। শব্দ অথবা নাম নিয়ে কলহ প্রায়শ
নিরর্থক, কী অর্থে কোনো শব্দ অথবা নাম কোথায় প্রযুক্ত হচ্ছে সেটা বুঝে
নেওয়াটাই বেশি জরুরি। আধ্যাত্মিকতাও ওইরকমই একটি শব্দ যেটি শোনা মাত্রই কেউ
কেউ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, আবার কেউ কেউ গদগদ। যারা অসহিষ্ণু তাদের ধারণা
আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে প্রকৃতির বাইরের কোনো বস্তু অতএব কাল্পনিক, অবাস্তব। এ
নিয়ে আরও একটু গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু পল্লিসংগঠনের কথা
বলেছিলেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, অধিকাংশ ব্যাপারেই আমরা হয়ে পড়েছি বড়ো বেশি
রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, এতে রাষ্ট্রের হাতে
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বাড়িয়ে তোলা হয়। রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ক্ষমতা
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে শেষ পর্যন্ত সহায়ক নয়, বরং নিশ্চিতভাবেই বিঘ্ন।
সমাজ সংগঠনের কাজ শুরু করতে হবে মুখ্যত তলার মানুষকে নিয়ে, সমাজের তলা
থেকে। এজন্য কিন্তু প্রয়োজন একটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক বিপ্লব,
জাতপাত সাম্প্রাদায়িক ভেদবুদ্ধি ভেঙে এক নবচেতনার আন্দোলন। এই আন্দোলন কোনো
একটি দল অথবা ধর্ম ও রাজনীতিতে আবদ্ধ থাকলে এর উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
এখানে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য এবং লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথকে আমরা
পাব পাশাপাশি। রাজনীতির সংগঠনে জোর পড়বে গ্রাম বাংলার ওপর। আর্থিক সংগঠনে
বিশেষ মূল্য দেওয়া হবে যথাসম্ভব গ্রামীণ স্বয়ম্ভরতাকে, তবু পল্লির সঙ্গে
বিশে^র যোগ ছিন্ন হবে না, বরং হয়তো আরও গভীর হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষ ও
প্রকৃতির যোগ রক্ষা করে, প্রতিবেশ ও প্রতিবেশীকে মান্য করেই গড়তে হবে নতুন
সমাজের সংগঠন।
মনুষ্যত্বের বিকাশ ও ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের প্রসার ঘটে
যোগের ভিতর দিয়ে। সেই আন্দোলনে স্থান আছে প্রতিবাদেরও। যোগ বলতে তো আধিপত্য
বোঝায় না, বোঝায় মিলনের চেতনা আর সেই পথে মানুষের মুক্তি। নবচেতনার
আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে দেশের ও বিশে^র নানা প্রান্তে। আমাদের প্রত্যেকের
জন্য অপেক্ষা করছে এক নতুন আহ্বান। আমরা এতে কতটা সাড়া দেব সেই প্রমাণটাই
এখন জরুরি। প্রয়োজন শুধু কিছু সাহস, শুভবুদ্ধি ও মুক্ত সমাজের জন্য আন্তরিক
আকাক্সক্ষা।