বাংলাদেশে
মোট জনসংখ্যার এক- তৃতীয়াংশই তরুণ, যারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। কিন্তু
অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্প্রসারণ হলেও কর্মসংস্থান সেই অনুসারে বাড়ানো
যাচ্ছে না। চাকরি না পেয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে টিউশনি,
পাঠাও-উবারে ডেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মীসহ নানা ধরনের কাজ করে জীবন ধারণ
করছেন।
এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্যও স্নাতকোত্তর
ডিগ্রিধারীরা আবেদন করছেন বিবিএসের হিসাব অনুসারে দেশের উচ্চ শিক্ষিত মোট
বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এ ছাড়াও প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে ৩-৪ লক্ষ
উচ্চ শিক্ষিত বেকার। বেকারদের ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। গড়
বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৭ শতাংশ হলেও তরুণ শ্রমশক্তির মধ্যে বেকারের হার ৮
শতাংশ। একজন কাজ প্রত্যাশী তরুণকে গড়ে এক মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে
বেকার থাকতে হয়।
দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার
প্রবণতা তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ বেড়েছে। দুই বছর ধরে প্রতিবছর ১০ লাখের
বেশি নারী-পুরুষ বিভিন্ন দেশে গেছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ
ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে বিদেশে গেছেন রেকর্ড পরিমাণ-১৩ লাখের বেশি
কর্মী। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে যান ১১ লাখ ৩৫ হাজারের
বেশি কর্মী। ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ৩ লাখ ২২ হাজার
২০৭ জন কাজের জন্য বিদেশে গেছেন।
বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড়
মাধ্যম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এসব প্রতিষ্ঠান শতকরা ৯৫ ভাগ কর্মসংস্থান করে,
এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করছে পোশাকশিল্প, এ খাতে প্রায়
৪০ লাখ লোক কাজ করছে।
বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কর্মের সঙ্গে সংযোগ
স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা। এজন্য শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের
চাপ বাড়ছে বিশেষ করে, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
ফলে সম্ভাবনাময় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে হতাশা।
দেশের শিক্ষা
কর্মের বাজারের চাহিদা উপযোগী কম। যে কারনে শিক্ষার হার বাড়ছে, সাথে
শিক্ষিত বেকারও বাড়ছে। এজন্য শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করা দরকার। এছাড়া
প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করতে হবে। যারা শিক্ষা গ্রহণ করছেন,
তারা তো ব্যক্তিগতভাবে অনেক খরচ করছেন। আবার তাদের পেছনে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ
আছে। যখন এসব শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন, তখন উভয় বিনিয়োগেরই অপচয় হচ্ছে।
দেশের
শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা এ দেশে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেগুলো
বাস্তবতা কিংবা কর্মের সঙ্গে সংযোগ নেই। শিক্ষিত বেকার সংখ্যার মধ্যে জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার চার বছর পরও শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ
বেকার থাকছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেকার বেশি থাকার কারণ হলো,
কারিকুলামে দক্ষতার অভাব, ইংরেজির ঘাটতি ইত্যাদি। যারা শিক্ষা শেষ করেও
পাঁচ, ছয়, সাত বছর চাকরি বা কোনো কাজ পাবেন না, তারা কী করবেন? নারী হলে
বিয়ে দিয়ে অন্যের আয়ের ওপর চলতে পারেন। কিন্তু পুরুষের জন্য এটা খারাপ
অবস্থা। পাশাপাশি হতাশায় ডুবে অনেক সময় নেশায় আসক্তি হচ্ছে, বিয়ের সময় পার
হচ্ছে এরকম নানান সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
কারিকুলাম পরিবর্তনে নিবিড়ভাবে কাজ করা প্রয়োজন। সেখানে অনার্স-মাস্টার্সের
পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কমপিউটার কাজে স্কিল ডেভেলপমেন্ট,
ডিজিটাল মার্কেটিং, ফ্রিল্যাসিং এবং অনলাইন কাজ শিখা যায় এরকম সাবজেক্ট
পড়ার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া ইংরেজিতে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ
নেওয়া এখন সময়ের দাবী।
মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নের অন্যতম শর্ত।
এজন্য শুধু কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়ন নয়, সরকারের কাছে অংশীদারত্বমূলক
সংস্কার কমিটি তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার
ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ও জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড.
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে সার্বিক
উন্নয়ন সম্ভব নয়। আবার শিক্ষা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নও যথাযথ ভূমিকা
রাখতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষাকে মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে
পারে। কেননা বর্তমানের গৎবাঁধা শিক্ষা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্মে
নিয়োজিত জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ বেসরকারি বা যৌথ
উদ্যোগের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেসরকারি
প্রতিষ্ঠানে, ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ খানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত। শুধু ৫
দশমিক ৫ শতাংশ কর্মচারী সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।
শিক্ষিত তরুণরা
বেকার থাকার ফলে তার পরিবার বিপদে পারছে। এছাড়া শিক্ষিত তরুণ বেকাররা
সামাজিকভাবে ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র জানায়,
২০২১ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১
হাজার ৭১৭ জন। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থী কমে গেছে। তবে শুধু সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করছেন প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী। এর
মধ্যে ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যয়ন করছেন ১ লাখ ২৯ হাজার
শিক্ষার্থী।
এসব সরকারি-বেসরকারি, অধিভুক্ত, অঙ্গীভূত বিশ্ববিদ্যালয়,
কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে বের
হন। কিন্তু তাদের সেই শিক্ষা কতটা বাস্তব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তা নিয়ে
অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ কারণে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট
বের হচ্ছেন, সেই তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন
করে ভাবার সময় এসেছে। বর্তমান সরকার তাদের সংস্কার কর্মসূচিতে উচ্চশিক্ষিত
বেকারত্ব হ্রাসের বিষয়টি অগ্রাধিকার রাখা দরকার।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।