বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪
৩০ কার্তিক ১৪৩১
স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণ
জুবাইদা নূর খান
প্রকাশ: বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪, ১১:৫৬ পিএম |

স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণ
আজ ফেইসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে একটা ভিডিওতে চোখ আটকে গেল। একজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি তার জীবনের স্বপ্নের কথা বলছেন। তাহলো, পানিতে নেমে টাটকা পানি ফল সংগ্রহ করে খাওয়া। ভিডিওতে দেখলাম তিনি একটি জলাশয়ে কোমর সমান পানিতে নেমে একটি পানিফল সংগ্রহ করলেন এবং মুখে পুরলেন। তার চোখে মুখে ছিল উচ্ছ্বাস, স্বপ্ন পূরণের উল্লাস। কত রকম মানুষ! আর কত রকম স্বপ্ন, কত রকম আকাঙ্ক্ষা তাদের!
আমার মা যখন প্রথমবার সন্তানসম্ভবা হলেন তখন এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন যে একটি লাউ গাছের মাচা এবং জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলো সেই লাউয়ের মাচার ভেতর দিয়ে গলে গলে মাটিতে পড়ছে। তিনি নিশ্চিত ভাবলেন যে, তার প্রথম সন্তানটি হবে ছেলে সন্তান এবং স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষায় তিনি প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন অসীম ধৈর্যের সাথে। কিন্তু প্রতিবারই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো এবং চার চারটি কন্যা সন্তানের জন্ম  দিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখায় ইস্তফা দিলেন।
আজ আমার বাসার গৃহপরিচারিকা আমার কাছে কাজ শেষে বিশেষভাবে দোয়া চাইলো কারণ আগামীকাল তার স্বামীর পায়ে অপারেশন হবে। হাঁটতে অসুবিধা বিধায়  তার স্বামী এখন কোন কাজ করতে পারে না। গৃহপরিচারিকা নিজে বাসায় বাসায় কাজ করে সংসার চালায়। তার স্বপ্ন -তার স্বামী অস্ত্রোপচারের পর আবার আগের মত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, রুজি রোজগার করবে। সে যখন দোয়া চাইছিল তার দু'চোখ থেকে স্বপ্ন যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল। সে বলছিল, "দোয়া করবেন যাতে করে আমি পেটটা ভরে ভাত খেয়ে যেতে পারি।" পেট ভরে খেতে পারার স্বপ্ন আমার আপনার কাছে নিশ্চয়ই অদ্ভুত, তাই না?
বারান্দার পাশে  দুটো বড় বড় মেহগনি গাছ ছিল। ওই গাছগুলোতে সব সময় কাঠবিড়ালি ছুটোছুটি করতো। হরেক রকমের পাখি মেহগনির ডালে বসে ডাকাডাকি করতো। মাঝে মাঝে বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসতাম আর কাঠবিড়ালি গুলোর খুনসুটি উপভোগ করতাম। ভাবতাম- ওরা কত সুখী! ওদের কোন চিন্তা নেই! কোন ভাবনা নেই! কোন শঙ্কা নেই! কোন স্বপ্ন নেই! কোন স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি নেই! কোন স্বপ্নভঙ্গের কাতরতা নেই! ওরা কতই না সুখী! একদিন হঠাৎ শুনতে পেলাম গাছ দুটো  কাটা হবে। ওখানে বহুতল ভবন তৈরি হবে।
গাছ থাকবে না, হবে দালান। কাঠবিড়ালি নয়,থাকবে মানুষ। এক সকালে কাঠুরে তার দলবল এবং সরঞ্জাম নিয়ে উপস্থিত হল। সারাদিন ধরে গাছগুলো কাটা হলো। কাঠবিড়ালিগুলো অন্য কোথাও চলে গেছে নিশ্চয়ই। তাদেরও কি মন খারাপ হয়েছে? আমার তো বটেই। কারণ গাঢ় সবুজ পাতাগুলো, সবুজাভ সোনালী রঙের মেহগনি ফুল আর কাঠবিড়ালির ছুটোছুটি এগুলো ছিল আমার মনের খোরাক। এদের সাথে আমি ভাব বিনিময় করতাম; আমার বেদনা কাতর মনে বিশুদ্ধ অনুভূতির প্রলেপ মেখে দিত গাছের ছায়া আর বাতাসের স্নিগ্ধ মায়া।
বারান্দার একটা ঘুলঘুলিতে চড়ুই দম্পতি খড়কুটো জড়ো করে করে বাসা বানিয়েছিলো। এবার তারা মা- বাবা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। রাতের আঁধার না কাটতেই দুটো পাখির কিচিরমিচির আর ডানা ঝাপটানিতে বাসার সবাই বিরক্ত কারণ সাত সকালেই ঘুমের মাঝে এই কিচিরমিচির, এই হট্টগোল- এই শোরগোল কারই বা ভালো লাগে? তাছাড়া বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিলে সেখানে এই পাখিদের ময়লা আবর্জনা কাপড় নষ্ট করে ফেলছে। এগুলো তো উটকো ঝামেলাই!  ইতোমধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হল। সারাদিন বাবা আর মা পাখিটা উড়োউড়ি করে ;বাচ্চা দুটোর মুখে খাবার তুলে দেয় ;কি অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য। বাচ্চা দুটো কবে বড় হবে ;কবে উড়তে শিখবে ; নিজের মতো করে আরেকটি বাসা বুনবে-  এই বুঝি মা পাখি আর বাবাটার স্বপ্ন?  অবাক হয়ে ভাবি কত অদ্ভুত পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসের চিন্তা চেতন! কত সক্রিয় সকলে; কত নাটকীয় তাদের জীবনাচরন। একদিন সত্যি সত্যি ভোরবেলা পাখির আওয়াজ আর পেলাম না। হয়তো বাচ্চা পাখি দুটোর পাখনা শক্ত হয়ে গেছে। তারা উড়তে শিখে গেছে; এখন থেকে তারা নিজের মত করে জীবন যাপন করবে; বাবা মা কে তাদের আর প্রয়োজন নেই।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিয়োগান্তক নাটক কিং লিয়ার। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই গল্পটির সাথে পরিচিত। রাজা কিং লিয়ার বড়ই মায়া করেন তার তিন সন্তানকে। তিনজনই তার কন্যা সন্তান। বড় দুই সন্তান বাবার দুর্বলতার কথা জানতেন; তাইতো তোষামোদ করে বাবাকে তারা ভুলিয়েছে। অলীক মায়ায় বাবাকে বেঁধে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাবার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে রাজ্যের লোভনীয় অংশ। কিং লিয়ার প্রতি পদে পদে করেছে ভুল ;রাজা হয়েও প্রকৃত মানুষ চিনতে হয়েছে ব্যর্থ  আর তাইতো তাকে দিতে হয়েছে জীবনের চরম মূল্য ।ছোট কন্যা- রাজার স্নেহধন্যা কর্ডেলিয়া তোষামোদ বিদ্যা শিখেনি। বাবাকে ভালোবেসেছে একজন কন্যা হিসেবে যতটুকু ভালোবাসা দরকার ঠিক ততটুকু। পিতা এবং কন্যার মধ্যে  শ্রদ্ধা এবং স্নেহের  সম্পর্ক যতটুকু থাকা প্রয়োজন ঠিক  ততটুকুই সে ধারণ করেছে নিজের মধ্যে। বড় দুই বোনের মত অন্তরে লোভের খনি লুকিয়ে রেখে বাবাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভ্রান্ত করেনি কনিষ্ঠ কন্যা।  বড় দুই কন্যাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজা তা ভঙ্গ হতে খুব বেশি সময় কিন্তু  লাগেনি। আসলে স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে যে আকাশ পাতাল ফারাক - তা রাজা ভুলতে বসেছিলেন। আর তাই তো, তাকে দিতে হয়েছে জীবনের চরম মূল্য।
টিউশনি করে নিজের খরচ মেটায় এলাকার হতদরিদ্র মেধাবী ছেলেটি। সেখান থেকেই বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। মাস শেষে টাকা পাঠালে বাবা চাল কিনেন; মা ভাত রাঁধেন। ছোট বোন দুটো টাকার অভাবে বই খাতা কিনতে পারেনা; স্কুলে যাবে কি করে? এমনই দরিদ্র জীবনে স্বপ্ন ছিল মেধাবী ভাইটি পড়া শেষ করবে ;চাকুরী পাবে ; ছন দেয়া ঘরে টিনের নতুন চাল হবে; বৃষ্টির পানি চালের ফুটো দিয়ে পড়ে লেপ তোশক ভিজিয়ে দেবেনা, ছোট্ট এক টুকরো জমি কিনবে তারা, বোন দুটোর বিয়ে হবে, লাল বেনারসি শাড়ি পরে লাজুক বোন দুটো শ্বশুর বাড়ি যাবে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। মেধাবী ছেলেটি ঐ পরিবারে আজ আর নেই অর্থাৎ বেঁচে নেই। সে ইতিহাস আবার অন্যরকম। তবে, পরিবারটির অতি সাধারণ স্বপ্নগুলো একটু একটু করে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে - কেমন করে সে বর্ণনা এখানে মুখ্য নয়।
ছগির মিয়া রিকশা চালায়। সকাল থেকে রাত অবধি রিকশা টানে। মাঝে অবশ্য ভাত খেতে আসে। শহরতলির কোনো এক বস্তিতে তার ছোট্ট এক কামরার ঘর। সেখানে থাকে তার তিন বাচ্চা। মাথার ওপর এক চালা টিনের ঘরটি গরমের সময় জাহান্নামের মতো তপ্ত হয়ে থাকে  আর শীতের সময় ঠান্ডায় শরীর জমে যেতে চায় । জীবন এমন কেন? এক এক মানুষ এক এক রকম কষ্ট নিয়ে থাকে। কেউ বিলাসী জীবনযাপন করেও বুকে কষ্টের পাহাড় বয়ে বেড়ায়; কেউবা আবার গাছ তলায় থেকেও গভীর ঘুমে হাসে। আজ অনেকদিন যাবত একটু মাংস খাবে বলে বায়না ধরেছে ছগির মিয়ার ছোট অবুঝ মেয়ে। অক্ষম ছগির মিয়ার নুন আনতেই পান্তা ফুরায়; মাংস আনবে কোত্থেকে? তাছাড়া হাঁপানি রোগটাও আজকাল বড্ড জ্বালাতন করছে। টানা ক'দিন  রিক্সা টানলে শরীর বিদ্রোহ ঘোষণা করে। একটু বিশ্রাম চায়। বিশ্রাম নিলে কি আর চলে? ছগির মিয়ার প্রতিদিনের যৎসামান্য আয় দিয়েই যে সংসার চলে। সেখানে ভালো একটু খাবার ; ভালো একটু রান্না - সে যে স্বপ্নের মত। গত বছর কোরবানির সময় এলাকার ধনী ব্যাবসায়ী যে কেজি খানিক  মাংস দিয়েছিল সেটাই তাদের শেষবারের মতো মাংস খাওয়া। বছর ঘুরে গেল। ছগির মিয়া মেয়ের দিকে তাকায়। কষ্টে তার বুক ফেটে যায়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। "জীবন এমন কেন? এ কেমন অক্ষম বাবা আমি! নিজের সন্তানকে একটু ভালো মন্দ খাওয়াতে পারিনা!" কষ্টের দলা গলা চেপে নিঃশ্বাস রোধ করতে চায় ছগির মিয়ার।  বড় সন্তান দুটো ছোটবেলা অনেক আবদার করত। এখন তারা বুঝে গেছে  তাদের মত অভাবীদের জন্য শখ কিংবা বাড়তি কিছু চাওয়া অন্যায়। তাইতো সময়ের সাথে সাথে অনেকটাই নিশ্চুপ আর বয়সের চাইতেও যেনো আরও বয়স্ক তারা।
ছগির মিয়া আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। আজকে রিকশা টেনে যে টাকা পেয়েছে তা দিয়ে সে কয়েক টুকরো মাংস কিনতে পেরেছে।  আগে তো এক কেজির নিচে মাংস কেনা অসম্ভব ছিল।  নতুন কী এক অফার চলছে। ছগির মিয়ার মতো দরিদ্র, দিন এনে দিন খাওয়ার মতো মানুষের উনুনেও এখন মাংস রাঁধা হবে, হোক না সেটা পরিমানে স্বল্প কিংবা কদাচিৎ।
অবুঝ ছোট্ট মেয়েটার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখে ছগির মিয়ার মনটা কেমন করে উঠে। পিতৃত্বের টান একেই বুঝি বলে। মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে বলে বুকটা তার পদ্মার জোয়ারের মতো ফুলে ফেঁপে উঠে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ














সর্বশেষ সংবাদ
মনোহরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের রুকন সম্মেলন
মনোহরগঞ্জে লক্ষণপুর ইউনিয়ন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের যৌথ কর্মীসভা অনুষ্ঠিত
ডায়াবেটিসের রোগীদের হাতের এবং পায়ের যত্ন জরুরী........ডা. মজিবুর রহমান
তিতাসে কিশোর গ্যাংকে চাঁদা না দেয়ায় গণপিটুনি
সাবেক আইজিপি শহিদুল হকসহ ৩ জন ফের দুই দিনের রিমান্ডে
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
তিতাসে কিশোর গ্যাংকে চাঁদা না দেয়ায় গণপিটুনি
সেলিনা হায়াৎ আইভীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
কুমিল্লায় হাতি দিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে হাতিসহ দুইজন আটক
একা ঘরে অজ্ঞান করার চেষ্টা, অভিযোগ অভিনেত্রীর
ডায়াবেটিসের রোগীদের হাতের এবং পায়ের যত্ন জরুরী........ডা. মজিবুর রহমান
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২