বস্তুত অতিমুনাফার
লোভে দীর্ঘদিন ধরে যেসব হিতচর্চা বা গুড প্র্যাকটিস ধুলোবালি ও কালির নিচে
চাপা পড়েছে, সেগুলোকে তার মূল সংজ্ঞায় ফিরিয়ে আনতে হলে যে পদক্ষেপ নিতে হবে
তাকে সংস্কার বলার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বলা
যায়। এর মধ্যে গাড়িচালকদের লাইসেন্স এবং যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট
আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্য। যাদের ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি ও মোটরবাইক
রয়েছে, তারা সাধারণত অবস্থাপন্ন ও উচ্চ শ্রেণির সংগতিসম্পন্ন মানুষ।
একটি
অনুন্নত দেশ হওয়ার ফলে এই শ্রেণির মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যা দেশের ১৯ কোটি
মানুষের তুলনায় একান্ত মুষ্টিমেয়। তাই মোটরবাইকের সংখ্যা ৮ লাখের কাছাকাছি
এবং ব্যক্তিগত মোটরকারের সংখ্যা ৩ লাখের নিচে। অপরদিকে গণপরিবহন, অর্থাৎ
বাস, মিনিবাস ও ট্রাক ইত্যাদির সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে
রয়েছে সিএনজিচালিত স্কুটার, টেম্পো এবং ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান। সড়ক
দুর্ঘটনার প্রধান সংগঠক বাস, মিনিবাস, মালবাহী ট্রাক, ব্যাটারিচালিত
ত্রিচক্র যান এবং সামান্য ক্ষেত্রে সিএনজিচালিত স্কুটার।
বিশেষ করে বাস
ও মিনিবাসে পরিবাহিত যাত্রীসংখ্যা যথাক্রমে ৬০ ও ৪০। অপরদিকে নিম্নবিত্ত
যাত্রীরা মালবাহী ট্রাকের ওপর বেআইনিভাবে যাত্রী হয়ে দেশের দীর্ঘ দূরত্বের
স্থানগুলোতে যাতায়াত করেন। এ ক্ষেত্রে একেকটি যানবাহন যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটায়
তাতে নিহত যাত্রীর সংখ্যা গড়ে ২০ জন এবং তার পরদিন এখান থেকে আহত আরও
অন্তত ১০ থেকে ১২ জন প্রাণ হারান। বিশেষ করে ঈদ এবং অন্যান্য জাতীয় ছুটির
মৌসুমে সংবাদপত্রে সাধারণ শিরোনাম হয় ‘সড়কে ঝরে গেল ২৩০টি বা ৩১০টি প্রাণ’।
এই প্রাণহানি কি অব্যাহত থাকবে? এই দুর্ঘটনার মূল কারণ চারটি।
১.
যানবাহনগুলোর যান্ত্রিক ফিটনেস গ্রহণ না করে চলাচল করা। ২. পরিবহন করার
সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে যাত্রী ও মালামাল বহন করা। ৩. সংশ্লিষ্ট চালকরা
ড্রাইভিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে, অর্থাৎ চালনার অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও
যানবাহন চালান। ৪. সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের ও অপর্যাপ্ত নির্মাণসামগ্রী
ব্যবহার করা এবং ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজনের গাড়ি চালিয়ে সড়কগুলো
ক্ষতবিক্ষত করা।
কথায় কথায় ঘুণে ধরা এবং উপনিবেশিক বলে গালি দিয়ে
ব্রিটিশ ব্যবস্থাকে স্বাধীন দেশের উপযোগী নয় বলে সেমিনারে বক্তারা উল্লেখ
করেন। অথচ ওপরে বর্ণিত সব বিষয়ে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রিটিশ
আইনই আমাদের মৌলিক আইন। কিন্তু অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের উদগ্র লোভে
নির্দিষ্ট সময়ে যানবাহনের যান্ত্রিক ফিটনেস মালিকরা গ্রহণ করছেন না। করলে
যানবাহনের যন্ত্রপাতি, চাকা, ব্রেক এবং সিট ও বডি যে মানের মধ্যে সংরক্ষিত
করতে হতো, তাতে একটি অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়ে মালিকদের মুনাফা কমত। ফলে উৎকোচ
দিয়ে ফিটনেস পরীক্ষায় হাজির না হয়ে দেশে এই শ্রেণির প্রায় ৮ লাখ যানবাহন
চলাচল করছে। আবার সমসংখ্যক যানবাহনচালক লাইসেন্স গ্রহণের কোনো রকম পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ না হয়ে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে জাল লাইসেন্স গ্রহণ করে যানবাহন
চালাচ্ছেন। এখানেও সেই অতি মুনাফা। অথচ যানবাহন আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে,
কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে কী কী পরীক্ষার
মাধ্যমে গাড়ি চালনোর লাইসেন্স দেওয়া যাবে।
আবার কোন ধরনের যানবাহনে
সর্বোচ্চ কতসংখ্যক যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করা যাবে এবং কোন সড়কে কত
গতিতে সেগুলো চলবে, সেটাও সেই মূল ব্রিটিশ আইনে উল্লেখ আছে। আরও উল্লেখ আছে
কোনো যানবাহনই মালিকের নিজস্ব মালিকানাধীন বা ভাড়াকৃত গ্যারেজ ছাড়া
রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাবে না। কারণ, তা না হলে অন্য মানুষের কিংবা
গণসম্পত্তি তথা রাস্তা, ফুটপাত, পার্ক এবং যেকোনো সরকারি স্থানে এই
যানবাহনগুলো পার্কিং করে রাখায় রাস্তা সংকুচিত হয়ে যাত্রী সাধারণ এবং
পথচারীদের অসুবিধা সৃষ্টি করবে।
উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে এই গ্যারেজের
সত্যতা যাচাই না করে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়ার ফলে প্রতিটি মহানগর ও
জেলা শহরে হাজার হাজার যানবাহন রাস্তা ও ফুটপাতে পার্কিং করে লাখ লাখ
মানুষের চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করছে। মহাখালী, নাবিস্কো, হোটেল সোনারগাঁও,
আগারাগাঁও, মিরপুর, গাবতলী এবং আবদুল্লাহপুরেও এই অবৈধ পার্কিংয়ের ফলে গাড়ি
চলাচল এবং মানুষের চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে গেছে।
গণপরিবহনে শৃঙ্খলা
ফেরাতে সরকার যে বাসরুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পে ভরসা করছে, সেটি নতুন বোতলে
পুরোনো মদ সরবরাহের মতো অবস্থা। একদিকে বলা হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে
দুর্বৃত্তায়ন চলমান, আরেক দিকে তা সমাধানের জন্য আইনের মূল সূত্রে না গিয়ে
বলা হচ্ছে, যানজট নিরসনের জন্য এই প্রকল্পে ফিরে যাওয়া দরকার। মোদ্দা কথা
এই যে, ঢাকার মধ্যে ৪২টি রুটকে বিভিন্ন রঙের গুচ্ছ বা ক্লাস্টারে বিভক্ত
করে বাসগুলো পরিচালনা করতে হবে। এর আগে সবুজ রঙের তিনটি রুটে
পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা নগর পরিবহনের বাস পরিচালনা করা হয়। এখানে নির্দিষ্ট
রুটে এই বাস নামানোর পরও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর বাস পরিচালনার সুযোগ
উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল।
ফলে তাদের দক্ষতার সঙ্গে সরকারি বিআরটিসির বাস
এবং এই নির্দিষ্ট রঙের বাস প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। ৩৮৫টি রুটকে সমন্বয়
করে এখন আবার ৪২টি রুটে পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে। তাতে চলবে ৯টি ভিন্ন
ভিন্ন রঙের বাস। বলা হয়েছে, র্যাপিড পাসের মাধ্যমে যাত্রীরা এসব বাসে
দ্রুত যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু ওই সব রুটে বিভিন্ন গতির অন্যান্য
যানবাহনও চলমান আছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। ফলে বাসে রং দিলেও তা এসব
যানবাহনের ভিড়ের কারণে নির্দিষ্ট গতিতে চলতে এবং গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে
পারবে না। এতে আরও বলা হয়েছে, পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং আমলাতন্ত্রের
সমীকরণের কথা। অথচ প্রতিদিন ঢাকা শহরে ৬ হাজার নতুন যাত্রীর প্রবেশ, ৭ লাখ
৭৫ হাজার মোটরবাইকের সঙ্গে প্রতিদিন অন্তত ২০০ নতুন বাইক যোগ হওয়ায় চলমান
যানজট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
এ ছাড়া আছে রাস্তার মানের বিষয়। ঢাকনাহীন
ম্যানহোল, উঁচু ঢাকনাসম্পন্ন ম্যানহোল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং
আবাসিক এলাকার ভেতর ও সামনে অতি উচ্চতার স্পিড ব্রেকারের ক্রমবর্ধমান
নির্মাণ, রাস্তায় উপচে পড়া পথচারী এবং ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালাদের ভিড় ইত্যাদি
উপাদান এই রেশনালাইজেশন প্রকল্পকে দিনে দিনে অধিকতর বাধাগ্রস্ত করছে।
কাজেই এসব সংস্কারের জন্য কোনো নতুন আইন বা সুপারিশের প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশ
আমলে প্রণীত আইনগুলো অনুসরণ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার কেন্দ্র এবং
যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার কেন্দ্র বৃদ্ধি করে এবং সড়কের যেকোনো স্থানে
নমুনা হিসেবে গাড়ির ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষার ব্যবস্থা
সম্প্রসারিত করতে হবে। ওই আইনগুলোতে যানবাহনের যন্ত্র, জানালা, সিটের মাপ ও
সংখ্যা, জানালার কাচের মান, কালো ধোঁয়া নির্গমনের মান, বায়ু
চলাচলব্যবস্থা এবং যাত্রী, চালক ও পরিবহনশ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা,
চালকের চোখের দৃষ্টিশক্তি, প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞান, হাতের ও পায়ের ক্ষিপ্রতা
ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত আছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল