সরকার কথায়
কথায় ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি চালু করে
কিন্তু সেটা সঠিকভাবে পালিত হয় কি না, তা দেখার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
এ জন্য বছরব্যাপী দেশের সব জায়গায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে
সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার চালাতে হবে। একটি স্বাস্থ্যবান জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে
ওষুধ-প্রতিরোধী অণুজীব যেন সৃষ্টি হতে না পারে তার জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা
নিতে হবে। যদি তা একেবারেই ঠেকানো না যায়, তাহলে অন্ততপক্ষে তা যেন
নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ সমস্যাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসা দরকার।...
১৮
থেকে ২৪ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী অণুজীববিরোধী ওষুধের প্রতিরোধ (অ্যান্টি
মাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স) সম্পর্কে সচেতনতা সপ্তাহ পালিত হচ্ছে।
প্রতিবছর এ সময়ে এটি পালন করা হয়। অণুজীববিরোধী ওষুধের মধ্যে রয়েছে
অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিপ্যারাসাইট। এই
চার ধরনের ওষুধকে একত্রে বোঝানোর জন্য আমি লেখার শিরোনামে
‘অ্যান্টিবায়োটিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।
চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া
নিজে খাব না- এর সঙ্গে ‘খাওয়াব না’ কথাটি ব্যবহার করেছি শুধু অন্য কোনো
মানুষকে খাওয়ানোর বিষয়ে নয়, কোনো প্রাণীকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো কিংবা
কৃষি খামারে ও বাগানে অ্যান্টিবায়োটিক ছড়ানো-ছিটানোকে বুঝিয়েছি।
প্রাণিচিকিৎসক কিংবা কৃষি পেশাজীবীর পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খামারের
প্রাণী বা কৃষিকাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সেটি না করা হলে শুধু মানুষের
ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করলেই কাজে দেবে না, প্রাণীকে
অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে বা শাকসবজি, ফলফলাদিতে কিংবা
মাটি-পানি-বাতাসে অ্যান্টিবায়োটিক/জীবাণুনাশক ছিটালে সেটা খাবারের মাধ্যমে
ও পরিবেশের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকবে।
পানি-মাটি-বাতাসে
অ্যান্টিবায়োটিক ছড়ালে সেখানকার ব্যাকটেরিয়া/অণুজীব প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন
করে। সেটা কীভাবে হতে পারে? ওষুধ কারখানা, কৃষিজাত খাবারের কারখানা,
চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের তরল/কঠিন/বায়বীয় বর্জ্য যদি সরাসরি নদী-নালা,
খাল-বিল, মাটি, বাতাসে ফেলে দেওয়া হয়, সেখান থেকে মানুষ সরাসরি শরীরে,
নিশ্বাসের মাধ্যমে, খাবার-পানীয়ের মাধ্যমে ওষুধ-প্রতিরোধী অণুজীব দ্বারা
আক্রান্ত হতে পারে। একইভাবে এসব বর্জ্যের অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা
পরিবেশদূষণের কারণে প্রাণী, মাছ, শস্য, শাকসবজি ওষুধপ্রতিরোধী অণুজীব
দ্বারা আক্রান্ত হয়ে খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকতে পারে।
পরিবেশদূষণের
কারণে মানুষ ওষুধ-প্রতিরোধী অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। পানিদূষণ,
খাবারে দূষণ, দূষিত বাতাস থেকে নিশ্বাস ও অন্য মাধ্যমে ওষুধ-প্রতিরোধী
ফাঙ্গাসের ক্ষুদ্র বীজ মানুষ/প্রাণীর দেহে ঢুকে তা ওষুধ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে
পারে। এগুলোকে অনেকে ‘সুপার বাগ’ বলে থাকেন। এটা কোনো সীমানা মানে না।
সবার জন্য সবখানে এ বিপদ ছড়িয়ে পড়ে।
অণুজীববিরোধী ওষুধের প্রতিরোধ তৈরি
হলে কী হবে? যখন কারও অসুস্থতার সময় চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক/
অ্যান্টিভাইরাল/অ্যান্টিফাঙ্গাল/অ্যান্টিপ্যারাসাইট খাবার দরকার হবে, তখন
দেখা যাবে যে, সে ওষুধে কাজ হচ্ছে না। ফলে মানবশরীরে অণুজীবের সংক্রমণ বন্ধ
করা যাবে না। আমরা প্রতিনিয়ত নানা সংক্রমণে ভুগছি। অথচ কার্যকর
অ্যান্টিবায়োটিক না থাকার কারণে আমাদের চিকিৎসা ঠিকমতো করতে পারছি না।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, এর কারণে মূত্রনালির সংক্রমণ, ওপরের শ্বাসনালির
সংক্রমণ, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি রোগের চিকিৎসা দিন দিন কঠিন হয়ে
উঠছে। এর ফলে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকতে হতে পারে, অচল হয়ে পড়ে থাকতে হতে পারে,
এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। প্রতিবছর সরাসরি এ কারণে ১২ লাখ মানুষ মারা যায়।
পরোক্ষভাবে আরও ৫০ লাখ মানুষ পৃথিবীব্যাপী এ কারণে মারা যায়।
তাই
অণুজিববিরোধী ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যেন মানুষে, প্রাণীতে, শস্যে,
পরিবেশে তৈরি না হয়, এ জন্য মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীর স্বাস্থ্য, কৃষির
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষায় একযোগে কাজ করতে হবে। এটাকেই বলা হয়
‘এক স্বাস্থ্য’ বা ‘ওয়ান হেলথ’ দৃষ্টিভঙ্গি।
এর অর্থনৈতিক ক্ষতির
পরিমাণটা অনেক বড়। মৃত্যু এবং অচল হয়ে পড়ার ক্ষতিটা না হয় বাদই দিলাম।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে বা বাড়িতে শয্যাশায়ী থাকায় চিকিৎসার খরচ হিসাব করুন।
চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি যিনি অসুস্থ তিনি কোনো রোজগার করতে পারছেন না।
পরিবারের অন্য সদস্যদেরও খরচ করতে হয় এবং তাদের রোজগারেও বাধার সৃষ্টি করে এ
দীর্ঘস্থায়ী রোগ। আর যেসব দেশে সরকার রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়, সেখানে
সরকারি খরচটা এর সঙ্গে যুক্ত হবে। অথচ এর চেয়ে অনেক কম খরচে আমরা
ওষুধ-প্রতিরোধী অণুজীব সৃষ্টি হওয়া থেকে রেহাই পেতে পারি, নিদেনপক্ষে তার
প্রকোপ কমাতে পারি।
আমরা এটা ঠেকাতে কী করতে পারি? প্রতিদিনই এ বিষয়ে
আমাদের কিছু করার আছে। সরকার এবং এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও অনেক কিছু
করার আছে। কোনো নির্দিষ্ট
অ্যান্টিবায়োটিক/অ্যান্টিভাইরাল/অ্যান্টিফাঙ্গাল/অ্যান্টিপ্যারাসাইটের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধী অণুজীব তৈরি হলো কি না, তা জানতে নিয়মিত রোগতাত্ত্বিক
নজরদারি (অ্যাপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভিলেন্স) ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে
এটা শুরু হয়েছে। একে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ নজরদারি থেকে আমরা কী
জানতে পারি? আমরা জানতে পারি, কোন ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী অণুজীব তৈরি
হয়েছে। তাহলে মানুষের যখন অণুজীব সংক্রমণ চিকিৎসার জন্য ওষুধ দরকার হবে,
তখন বাছাই করে যেটা এখনো অণুজীব ধ্বংস করতে সক্ষম, সে ওষুধ খাবার পরামর্শ
দেবেন চিকিৎসক। বাংলাদেশে আইইডিসিআরে নজরদারি ব্যবস্থা পরিচালনা করে আসছে।
প্রতিবছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর সচেতনতা সপ্তাহে তারা প্রকাশ করে কোন কোন
অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে, কোনগুলো কার্যক্ষম আছে।
সরকার
কথায় কথায় ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি চালু করে
কিন্তু সেটা সঠিকভাবে পালিত হয় কি না, তা দেখার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়
না। এ জন্য বছরব্যাপী দেশের সব জায়গায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে
সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার চালাতে হবে, মানুষকে সম্পৃক্ত করে এ বিষয়ে
কার্যক্রম চালাতে হবে। আমরা মুখে খাওয়ার স্যালাইন বিষয়ে প্রচারণা ও
জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড করে ডায়রিয়া/কলেরায় মৃত্যু প্রায় শূন্যের ঘরে নামিয়ে
আনতে পেরেছি। এটাতেও সফল হব নিশ্চয়ই।
সংক্রমণ হতে না দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে
কার্যকর উপায়। নিয়মিত সাবান দিয়ে দুই হাত ধোয়ার অভ্যাস মানুষকে খাদ্য ও
পানিবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা
নিশ্চিত করলে অনেক সংক্রমণ বন্ধ করা যায়। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চললে
শ্বাসতন্ত্রবাহিত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে টিকার
ব্যবহার ওষুধ ব্যবহারের চাইতে অনেক নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।
একটি স্বাস্থ্যবান
জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে ওষুধ-প্রতিরোধী অণুজীব যেন সৃষ্টি হতে না পারে, তার
জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা নিতে হবে। যদি তা একেবারেই ঠেকানো না যায়, তাহলে
অন্ততপক্ষে তা যেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ সমস্যাকে
জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সরকারের নীতিনির্ধারকদের
এগিয়ে আসা দরকার। জনগণকে প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও সংস্থাকেও নিজ উদ্যোগে এ
নীরব মহামারিকে ঠেকাতে এখনই সর্বাত্মক সক্রিয় হতে হবে।
লেখক: সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)