একাদশ পর্ব
প্রথাটা
পুরানো। তখন এবং এখন অর্থহীনও বটে। পাশের নাপিত বাড়ির নবীন শীলের তৃতীয়
ছেলে মুরারি শীল, কিন্তু নিজে উচ্চারণ করে মুরালি শীল। পাত্রীপক্ষ এসেছে
বিয়ের কথা বলতে, পাত্র মুরারিকে দেখতে। মুরারি শীল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
পাত্রীপক্ষের একজন জিজ্ঞেস করছে- তোমার নাম কি ? মুরারি বলছে- ‘শ্রীযুক্ত
বাবু’ মুরালি শীল। পড়াশোনা করেছ ? ‘করেছি, তবে কোনো কামে লাগবে না।’ পাত্র
দেখা শেষ।
ভাবছি-মুরারি শীল নামের আগে ‘শ্রীযুক্ত বাবু’ বলল কেন ? নামকে সুন্দর করার জন্য, না নিজেকে বিকশিত করার জন্য ?
জন্মের
পর বাবা-মা আদর করে সন্তানের নাম রাখেন। এ নামেই সারাজীবন সে পরিচিত। অনেক
সময় আদর বা ব্যঙ্গার্থে ডাকনাম রাখা হয়। এমনও দেখা গেছে কোনো এক সময় আসল
নাম হারিয়ে গেছে, ডাকনামেই পরিচিত। আমাদের পাড়ায় নবদ্বীপ দাস, তাকে
‘বেঙ্গা’ বলে সকলে চিনি-জানি। আসল নাম বললে কেউ চিনে না। ফলে ভোটার লিস্টে
বেঙ্গাই লেখা হয়। সন্তোষ শীল ডাকনাম ‘কেড়াইল্যা’, সচীন্দ্রের ডাক নাম
আউব্বা। মনে হয় একসময় নিজেরাও নিজের নাম ভুলে গেছে বা যায়। অন্য এলাকার লোক
হরগোবিন্দকে খুঁজছে। পাড়ার কেউ তাকে চিনে না। যখন বলা হয় সুকুমারের বাপ
‘ধেন্দা গোবিন্দ’ (কানে কম শুন) তখন সকলেই চিনে।
এ ধারায় নামের আগে
বিশেষণ ব্যবহারেরও চল বা রীতি লক্ষ্য করা যায়। রমনীপন্ডিত। অর্থাৎ
ব্যক্তিটি স্কুলে সংস্কৃতের শিক্ষক। পন্ডিত শব্দের অর্থ অনেকেই জানে না।
‘পন্ডা’ অর্থাৎ জ্ঞানবান ব্যক্তিকে পন্ডিত বলা হয়। যিনি স্কুলে সংস্কৃত
পড়ালে যে পন্ডা বা জ্ঞানবান হবেন তার কোনো যুক্তি নেই। অথচ একটি মূল্যবান
শব্দ অধিকার করে বসে আছেন পাশের গ্রামের সালামত নিজের নামের আগে সব সময়
বলে- মৌলবী সালামত। টেলিফোনে অনেকেই নিজের নাম বলতে গিয়ে বলে- ‘আমি
রমেশবাবু বলছি।’
এ নিয়ে গভীরভাবে কোনোদিন ভাবীনি। যে যেভাবে আনন্দ পায়
বলুক। কিন্তু লেখাপড়া জানা লোক যখন সচেতনভাবে আত্মগৌরবের ডালাটি ফুল দিয়ে
সাজাতে চায়, তখন কোথায় যেন হোঁচট খেতে হয়। ইদানিং দেখি- পেশাজীবীরা পরিচয়
দিতে গিয়ে নামের আগে প্রফেসর-প্রিন্সিপাল-প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-ডাক্তার এবং
লেখালেখি করলে গবেষক-ইতিহাসবিদ, পরিবেশবিদ ইত্যাদি নানা বিশেষণ নামের আগে
বসিয়ে পরিচয় দেন। বাবা-মার নামটিকে অলংকারিত করার প্রয়াস খুবই চমকপ্রদ।
দেখা যায়- কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকে সম্বোধন করে- প্রফেসর সাব, কেমন আছেন।
ডাক্তার সাব ভালো আছেন তো ? কী খবর ইঞ্জিনিয়ার ? একসময় হয়তো এরূপ পাশ করা
ডিগ্রিধারী লোকের সংখ্যা কম ছিল। সেজন্য পুরো বা আসল নাম না বললেও
ডিগ্রিধারী ব্যক্তিটিকে চিনতে ভুল হতো না। এখন তো নানা ডিগ্রিধারীর সংখ্যা
বন্যার জলের মতো উপচে পড়ছে। সেজন্য যে ডিগ্রি নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক
হওয়া যায়, এ ডিগ্রি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকও হতে হয়। শুনেছি, এখন
চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী, যার যোগ্যতা এসএসসি বা এইচএসসি হলেই চলে অথবা
বিজ্ঞাপনে তাই উল্লেখ আছে, কিন্তু দেখা যায়- উচ্চতর অর্থাৎ স্নাতকোত্তর
ডিগ্রিধারীরাও সেখানে প্রার্থী হিসেবে আবেদন করে। এ ধারা ভিন্ন।
ইদানিং
নিজেকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার জন্য অদ্ভুত সব বিশেষণ নামের আগে জুড়িয়ে
দেয়া হচ্ছে। যেমন- কবিরা লিখছেন-জাতিসত্তার কবি, শুদ্ধাচার কবি, বিজ্ঞান
কবি, নগরকবি ইত্যাদি। আমরা রবীন্দ্রনাথকে বিশ^কবি বা কবিগুরু বলে থাকি। তার
যথার্থ প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ^ রবীন্দ্রনাথকে
কবি হিসেবে জেনেছেন। এই স্বীকৃতি তাঁকে বিশ^নন্দিত উপাধিতে বিশেষিত করেছে।
কবিগুরু হিসেবে পরিচিতি দু’ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব
বিবেচনায় তাঁকে ‘কবিগুরু’ অথবা ‘কবিদের গুরু’ অর্থাৎ কাব্যচর্চা বিবেচনায়-
বাংলা সাহিত্যে তাবৎ কবিকুলের মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এখনও আমরা মেনে
নিয়েছি। আশা করি, এ অবস্থান রবীন্দ্রমানের কবিসত্তা বিশ্লেষণে শাশ^ত হয়েই
থাকবে।
কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যাত করে থাকি।
তা কোনো আবেগের আতিশর্য নয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করার পর বাঙালি সারস্বত
সমাজ তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেছেন। কিন্তু নজরুলের সামগ্রিক কাব্য রচনায়
কেবল বিদ্রোহী সত্তাই এককভাবে প্রাধান্য পায়নি, তাঁর কবিতায় বহুমাত্রিকতা
এতটাই প্রবল, যার ফলে আমরা আলোচনার আলোকে বহু বিশেষণে ভূষিত করি এবং তা
যথার্থও বটে। তাঁকে সাম্যের কবি, যৌবনের কবি, প্রেমের কবি, মানুষের কবি
ইত্যাদিতে ভূষিত করে থাকি। তাঁর সৃষ্টিশীলতাই পাঠকসমাজ এ বিশেষণগুলো কবির
নামের আগে ব্যবহার করে থাকেন।
কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি- যখন
কারো নামের আগে গবেষক, ইতহাসবিদ, পরিবেশবিদ, পন্ডিত প্রবর ইত্যাদি ব্যবহার
করেন, আসলে সে ব্যক্তিটির এরূপ যোগ্যতা আছে কীনা তা বিবেচনা করা হয় না।
গুণবাচক বিশেষণ কোনো ব্যক্তির নামের আগে বসাতে হলে অবশ্যই তার যথার্থতা
থাকা বাঞ্ছনীয়। পিতৃ-মাতৃ দত্ত নামের আগে বিশেষণ বলতে হলে অবশ্যই চিন্তা
ভাবনায় প্রাসঙ্গিকতা থাকতে হয়। যখন কানা খোকন, ধেন্দা বাদল, গাছি
সুরেন্দ্র, লুচ্চা সতীশ, লেংরা দুলাল ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত নামটি উচ্চারণ
করা হয়, তখন সহজেই বুঝা যায়- ব্যক্তিটির নামের আগে বিশেষণটি প্রাসঙ্গিকতা
রয়েছে। কিন্তু যোগ্যতা অর্জন না করে অথবা নিজের নামটিকে অলংকারিত করার জন্য
গুণবাচক বিশেষণ ব্যবহার করলে ব্যক্তিটি বিকশিত হন না। বরং বিশেষণটিকে ছোট
অযোগ্য করে তোলা হয়।
বিষয়টা যে অনৈতিক তা অন্যজন যেমন বুঝে,
ব্যবহারকারীও বুঝে। তারপরও এ পরিক্রমা থেমে নেই। যেমন- ‘ইতিহাসবিদ’ শব্দটি
অভিধানে নেই। আছে-ইতিহাসজ্ঞ (ইতিহাস বিষয়ে অভিজ্ঞ বা পুরাতত্ত্ববিদ,
‘ইতিহাসবিদ’)। ‘পরিবেশবিদ’ শব্দটিও অভিধানে নেই। এভাবে আমরা নিজেরা অনেক
শব্দ তৈরি করে নিই। তাতে শব্দ সংখ্যা বাড়ল, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে
যথার্থ হলো কীনা তা বিবেচনা করি না। উপর্যুক্ত শব্দগুলো ধারণ করতে হলে যে
যোগ্যতা, জ্ঞানগরিমা এবং পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় বা অর্জন করতে হয় তার ধারে
কাছেও অবস্থান না করে শুধুমাত্র নিজেকে বিকশিত করার প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ
শব্দটিকে হাস্যপদ করে তোলা হয়। যারা এ কাজটি করেন, তারা অজ্ঞ অথবা মূর্খ।
শিশু
জন্ম গ্রহণের পর পিতামাতা যে নামটি সন্তানের জন্য আদর করে উচ্চরণ করেন,
ব্যবহারিক জীবনে হয়ত নামের সাথে জীবনাচরণের মিল থাকে না। তারপরও উল্লিখিত
নামটিই ব্যক্তিটিকে আজীবন পরিচিতির ঝান্ডা হিসেবে, শিরে শোভা-সুন্দর হিসেবে
থেকে যায়। কোনো ব্যক্তির নামের অর্থ এতটাই উজ্জ্বল কিন্তু কর্মকাণ্ডের
জন্য নামটি ঘৃণিতও হয়ে যায়। যেমন- মীর জাফর, খন্দকার মোস্তাক ইত্যাদি। যে
কথা বলতে চাচ্ছি- তাহলো নিজের নামটিকে ঐতিহাসিক বা গুরুত্বপূর্ণ করতে চাইলে
নিজের কৃতকর্ম দিয়েই তার মান উন্নত করে তুলতে হবে। ধার করে বিশেষণ যোগ করে
নামকে উজ্জ্বলতর করার মধ্যে গৌরব নেই। ব্যক্তিটি বিখ্যাত বা খ্যাতিমান হলে
তার গায়ের ছেঁড়া জামাটিও ইতিহাসের মর্যাদা পায়। নামের ক্ষেত্রেও তা-ই।