‘সুনীল
অর্থনীতি’ ধারণাটি খুব নতুন না হলেও এর গুরুত্ব ও প্রয়োগের বিষয়টি
সাম্প্রতিককালে বেশী জোরালোভাবে বিবেচিত হচ্ছে। ‘সুনীল অর্থনীতি’ ধারণার
কোন সর্বজন গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে মোটা দাগে ‘সুনীল
অর্থনীতি হচ্ছে- সমুদ্র নির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ করে
নিজস্ব অর্থনীতিতে যুক্ত করে এর কার্যকরী প্রয়োগের মাধ্যমে সার্বিক
অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটানোর বিষয়টি ‘সুনীল অর্থনীতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৯৪ সালে গুন্টার পাওলি নামক একজন বেলজিয়াম অর্থনীতিবিদ ‘সুনীল অর্থনীতি’র
ধারণাটির প্রবর্তন করেন।
কোন একটি দেশ যখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়,
সেই দেশকে তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল সম্পদ তথা সম্ভাবনাকে ব্যবহারের
পরিকল্পনা হাতে নিতে হয়। স্থলভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সম্পদ কাজে লাগানোর
পাশাপাশি সমুদ্রে কিংবা অবারিত আকাশের সম্পদও তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
পড়ে। নদীমাতৃক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এ দেশের একদিকে রয়েছে
সুজলা-সুফলা শস্য শ্যমলা উর্বর ভূমি; অন্যদিকে বহু নদী বা সমুদ্রের বিশাল
জলরাশি। এ দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৯০৭টির মতো নদী রয়েছে, আর আছে
বিস্তৃর্ণ নীলাভ জলরাশির বঙ্গোপসাগর। একথা অনস্বীকার্য যে সমুদ্র হলো
পৃথিবীর অন্যতম এবং অবারিত সম্পদের ভান্ডার।
‘সুনীল অর্থনীতি’ ধারণার
যথোপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে সামৃদ্রিক সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহারের যথেষ্ট
সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে যাদের সামুদ্রিক
সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে সেসব দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে,
কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণে ‘সুনীল
অর্থনীতি’ একটি নতুন সম্ভাবনার সোপান হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। ‘সুনীল
অর্থনীতি’ ধারণাটি জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র (এসডিজি) ১৭টি
লক্ষমাত্রার মধ্যে ১৪ নং লক্ষ্যমাত্রা (জলজজীবন) এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত
এবং এর পাশাপাশি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-২ (ক্ষুধা মুক্তি), এসডিজি
লক্ষ্যমাত্রা-৮ (শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা
-১৬ ( শান্তি ন্যায় বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান) এর সাথে বহুলাংশে
সম্পৃক্ত।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির অবদান বহুবিধ এবং বেশ
আকর্ষনীয়। সমুদ্রকে ঘিরে বছরে গড়ে ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক
লেনদেন বা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বের ১০-১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ
বা পরোক্ষভাবে সমুদ্র নির্ভর কাজে থেকে জীবিকা নির্বাহ করে এবং এই
কর্মসংস্থানের সুযোগের ৯০% তৈরী হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্বের
অর্ধেকের মতো মানুষের প্রয়োজনীয় আমিষের প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ যোগান দিচ্ছে
সামুদ্রিক মাছ, প্রাণি ও উদ্ভিদ। সমুদ্র তলবর্তী গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে
পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর প্রায় ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানী তেল। ধারণা করা হচ্ছে
২০২৫ সাল নাগাদ অষ্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে সুনীল অর্থনীতির অবদান বর্তমানের
৪৭.২ বিলিয়ন অষ্ট্রেলিয়ান ডলার হতে বেড়ে ১০০ বিলিয়ন অষ্ট্রেলিয়ান ডলারে
দাঁড়াবে। চীনের ক্ষেত্রে ২০৩৫ সাল নাগাদ সেদেশের জিডিপি’র ১৫ শতাংশ আসবে
মেরিন সেক্টর হতে (যার পরিমান বর্তমান জিডিপি’র পরিমাণ ১০ শতাংশ)। ইউরোপীয়
ইউনিয়নে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে বার্ষিক সংযোজিত মূল্যমানের ৫০০ মিলিয়ন ইউরো
এবং এ খাতে ৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে (সূত্রঃ বাংলাদেশ
ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রকাশনা)।
‘সুনীল অর্থনীতি’র
প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি খুবই প্রতিশ্রুতিশীল দেশ। এক্ষেত্রে
আমরা শুধুমাত্র মৎস্য সম্পদ আহরণ, জাহাজ চলাচল ও সমুদ্র পর্যটন এ তিন ধরণের
গতানুগতিক ধারনায় ‘সুনীল অর্থনীতি’র বিস্তৃত বিষয়টিকে কাজে লাগিয়েছি। এর
বাইরেও আরো নতুন নতুন ধরণের খাত যেমন- সমুদ্র দূরবর্তী জ্বালানী সংগ্রহ,
লবণ উৎপাদন, সমুদ্র তীরবর্তী নবায়নযোগ্য জ্বালানী, খনিজ আহরণ, গভীর সমুদ্র
বন্দরের সুবিধাদি কাজে লাগানো, গভীর সমুদ্রে মাছ ও শৈবাল সংগ্রহ ইত্যাদি
বর্তমানে যুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে যে কার্যক্রম চলছে এবং নতুন নতুন যে
খাতগুলো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে এর সবগুলো সম্মিলিতভাবে দেশের কাংখিত
প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সম্প্রতি
এক সেমিনারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুনীল অর্থনীতির অবদান ৬.২ বিলিয়ন
মার্কিন ডলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে- যা জিডিপি’র প্রায় ৩ শতাংশ। একই সাথে
উল্লেখ করা হয়েছে সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে ২০৩৫
সালের মধ্যে সুনীল অর্থনীতির অবদান ২৫.৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশের
মূল ভূখন্ডের প্রায় সমান এলাকা ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে
এর সমূদ্র এলাকা গঠিত। অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল। এ
সমুদ্র এলাকায় বিরাজমান অবারিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সার্বিক
অর্থনীতির প্রভূত উন্নয়ন ঘটানোর পাশাপাশি নিশ্চিত করা যাবে জ্বালানী
নিরাপত্তা ও এর মাধ্যমে প্রানিজ আমিষের ঘাটতি মেটানো যেতে পারে। সামুদ্রিক
খনিজ, আকরিক এর অর্থনৈতিক ব্যবহার, সামুদ্রিক জীব থেকে ঔষধ প্রস্তুত,
পর্যটন শিল্পের বিকাশ, সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে
বাংলাদেশ সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা ও সুযোগকে কাজে লাগাতে যেতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়
বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, শামুক-ঝিনুক, কচ্ছপ, লবস্টার, চিংড়ি,
তিমি, ডলফিন এবং সামুদ্রিক ঘাস রয়েছে। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও
খনিজজাতীয় সম্পদ যেমন- তেল, গ্যাস, চুনাপাথর, খনিজ বালি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের পাওয়া যায় এমন সি-উইডে প্রচুর প্রোটিন আছে। তাছাড়া কসমেটিকে
ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত উপাদান সদৃশ সি-উইডও অনেক পাওয়া গেছে।
সুনীল
অর্থনীতির সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আশা
করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এ খাতের অবদান বাংলাদেশের জিডিপি’তে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখবে। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে, ব্লু ইকোনমির চারটি ক্ষেত্রে (তেল ও
গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য আহরণ, বন্দর সম্প্রসারণ এবং পর্যটন) প্রয়োজনীয়
কার্যক্রম গ্রহণ করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা
রয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য এ বিষয়গুলো
বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশে বহুবিধ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে । এগুলো হলো
শিপিং, উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্রবন্দর, ফেরির মাধ্যমে যাত্রীসেবা, অভ্যন্তরীণ
জলপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্প, মৎস্য, সামুদ্রিক
জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, সমুদ্রের লবণ উৎপাদন,
মহাসাগরের নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্লু-এনার্জি, খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক জেনেটিক
সম্পদ, উপকূলীয় পর্যটন, বিনোদনমূলক জলজ ক্রীড়া, ইয়টিং ও মেরিনস, ক্রুজ
পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা, কৃত্রিম দ্বীপ, সবুজ উপকূলীয় বেল্ট বা ডেল্টা
পরিকল্পনা, মানবসম্পদ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও নজরদারি এবং সামুদ্রিক সমষ্টি
স্থানিক পরিকল্পনা । এ বিষয়ে গবেষণার জন্য ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরীর
লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও মেরিটাইম ইউনিভারসিটি
প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগে ‘ব্লু-ইকোনমি সেল’ গঠন করা
হয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে প্রতিবেশী দেশের সাথে কাজ করার লক্ষ্যে
সমঝতা চুক্তি করা হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক
অঞ্চলে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগর
তীরে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাই উপকূলে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের বাস
করে। এ বিপুল জনগোষ্ঠির আর্থসামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে সুনীল অর্থনীতির
অবারিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার ভালো
সুযোগ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা ও সম্পদ চিহ্নিতকরণ, পরিমাণ ও
জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথভাবে ব্যবহারসহ সমুদ্রনির্ভর সুনীল অর্থনীতির
বদৌলতে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে
এবং দারিদ্র দূরিকরণের কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়া যাবে। এ লক্ষ্যে এ মূহুর্তে
প্রয়োজন হলো দেশী ও বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে পর্যায়ক্রমে সহযোগিতা ও
গবেষণা পরিচালনা করা ও গবেষণার আলোকে ‘সুনীল অর্থনীতি’ এর বিভিন্ন বিষয়ে
গাইডলাইন ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে জোর
কদমে কাজ এগিয়ে নেয়া।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।