প্লাষ্টিক
বর্জ্য সারা বিশ্বে উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ কোটি টন। প্রায় ৪০০ বছর পর্যন্ত
প্লাষ্টিক বর্জ্য পরিবেশের উপর খারাপ প্রভাব রাখতে সক্ষম। প্লাস্টিক
দূষণকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। সাগরের তলদেশে থেকে
এভারেষ্টের চূড়া পর্যন্ত প্লাষ্টিক দূষণ বিস্তৃত। প্রতি মিনিটে বিশে^র
প্রায় ৫ লক্ষ প্লাষ্টিক বোতল বিক্রি হয়। প্রায় ৮০ লাখ টন গোটা বিশে^ সাগরে
গিয়ে মেশে। এক গবেষণায় দেখা যায়, দোকানে ব্যবহৃত প্লাষ্টিক প্রায় ২০ বছর
পর্যন্ত টিকে থাকে। কোমল পানীয়ের বোতল প্রায ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর
বোতল হিসাবে ব্যবহৃত প্লাষ্টিক ৪৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। বাংলাদেশে
প্রতিদিন ৩ হাজার টন প্লাষ্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। বিশ^ ব্যাংকের তথ্য মতে
ঢাকায় প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাষ্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ঢাকায় প্রায় ৩৭.২
শতাংশ প্লাষ্টিক পুনঃব্যবহার করা হয়। দেশে মোট উৎপাদিত প্লাষ্টিকের ৬০
শতাংশ মেশে রাস্তাঘাট ও নদীতে। এক তথ্যে দেখা যায়, আমাদের দেশে প্রতিবছর ৮
লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাষ্টিক বর্জ্য জমা হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ
পুনঃব্যবহার করা হয়। আর বাকী অংশ পরিবেশেই থেকে যায়। একটি গবেষণামতে, সারা
পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ কলের পানিতে মাইক্রপ্লাষ্টিক রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিমাসে
২১ গ্রাম এবং বছরে ২৫০ গ্রাম প্লাষ্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে গুরুতর
ক্ষতিসাধন করে। বিসফোনন, ফথেলেটস, অর্গানোটিনস, বিসফেনল পার ও পরি
ফ্লোবেএলকাইল প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান প্লাষ্টিকে থাকে, যা স্থূলতা,
গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস, বিভিন্ন স্নায়ূরোগ ঘটাতে পারে। প্লাষ্টিক শুধু
জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়। এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক
প্রভাব সৃষ্টি করে। পলিথিন, বিশেষ করে রঙ্গিন পলিথিনে থাকে শিশা ও
ক্যাডমিয়াম, যা চর্মরোগের জন্য দায়ী। অথচ এ পলিথিন ছাড়া আমরা যেন অচল। ঢাকা
শহরে একেকটি পরিবারে দিনে চারটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। শুধু ঢাকা
শহরেই প্রতিদিন ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়।
পলিথিন মোড়ানো সকল
খাবারই খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। মাছ-মাংস পলিথিন ছাড়া আমরা রাখি না।
কিন্তু পলিথিনে মাছ-মাংস প্যাকিং করলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়।
প্লাষ্টিকের বর্জ্য মাইক্রো ও ন্যানো কণা রূপে মানুষের শরীরে ঢুকে
হরমোনজনিত নানাহ রোগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। শুক্রানু ও ডিম্বানু উৎপাদন
ব্যাহত করছে। ক্যান্সারসহ নানাহ ত্বক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। পলিথিনের
স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক। চোখ জ¦ালা করা, শ^াসকষ্ট, ক্যান্সার, লিভারের
সমস্যা, চর্মরোগ থেকে শুরু করে অনেক মারাত্মক রোগের জন্য পলিথিন দায়ী। আমরা
বাজারে গেলে পলিথিনে করেই সবকিছু নিয়ে আসি।
বাংলাদেশই বিশে^ প্রথম
প্লাষ্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ২০০২ সালে। ২০১০ সালে প্লাষ্টিকের
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় থ্রিআর (৩জ) নীতি চালু করে। থ্রিআর অর্থ হল রিডিউস,
রিইউস ও রিসাইকেল। প্লাষ্টিকের ব্যবহার বন্ধে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার জুট
প্যাকেইজিং আইন পাশ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১ লা অক্টোবর থেকে সুপার
মার্কেট এবং ১ লা নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজার থেকে পলিথিন ও পলিপ্রোপিলিন
ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। কিন্তু খেয়াল রাখতে
হবে বাজারে যেন এসব ব্যাগের বিকল্প থাকে। সরকার বলছে এর বিকল্প হিসাবে
কাপড়, পাট ও কাগজের ব্যাগের সরবরাহ থাকবে। শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই কাজ
হবে না। পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেই এ ব্যবস্থা সফল
হবে। দোকানী বা ব্যবহারকারীদেরই এ ক্ষেত্রে নজরে আনলে চলবে না। পলিথিন
উৎপাদনকারীদের ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশে প্লাষ্টিক
দ্রব্যাদির বাজার এক বিলিয়ন ডলারের। প্লাষ্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের
সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ঢাকায় প্রতিদিন এক কোটি ২০ লক্ষ পলিব্যাগের বর্জ্য
ফেলা হয়। প্লাষ্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছেই। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে এর
বার্ষিক মাথাপিছু ব্যবহার ছিল তিন কেজি। এটি বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে নয় কেজি।
অর্থাৎ ১৫ বছরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাষ্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণ।
সরকারের এসব প্লাষ্টিক বর্জ্য সংগ্রহের আলাদা কৌশল রাখতে হবে। যেমন শুধু
প্লাষ্টিকের জন্য আলাদা কন্টেইনার রাখা যেতে পারে। রিসাইক্লিং করার
পরিকল্পনা থাকতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি, যারা প্লাষ্টিক পণ্য বিক্রি
করে, তাদের প্লাষ্টিক ব্যবহার করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা
থাকা একান্ত জরুরী।
ব্যবহার্য টিউব, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, মিনি প্যাক,
টি ব্যাগ, প্লাষ্টিকে ওয়ান টাইম ইউজড চামচ, বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট,
গ্লাস, প্লেট, কাপ, স্ট্রসহ বিভিন্ন প্লাষ্টিক সামগ্রী বছরের পর বছর টিকে
থাকতে পারে। এসব প্লাষ্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করে ফেলা হয়
আশেপাশের ড্রেনে, রাস্তার পাশের্^র গার্বেজ বা ভাগাড়ে বা জলাশয়ে। এর ফলে
পানি, মাটি ও বায়ুর মত পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহে
মারাত্মকরূপে দূষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ