পড়লাম বেগম
রোকেয়ার জীবনী। অন্যান্য কথার মধ্যে ভালো লাগল তার দুরন্ত অভিজ্ঞতার কথা।
বিদ্রুপবাণে জর্জরিত হয়ে সহকর্মীকে বলছেন, “যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে
গায়ের চামড়াকে এত খানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা গ্লানি উপেক্ষা,
অপমান কিছুই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে
হইবে যেন ঝড় ঝঞ্জা বজ্র বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।”
অভিজ্ঞতার
কথায় বলছেন, ‘মুসলমান সমাজটা নিতান্তই অভিশপ্ত। আর যে ব্যক্তি তার কল্যাণ
কামনা করবে সে হতভাগ্য। বড় বড় লোকরাই শত্রুতা সাধন করেছেন বেশি।’
সমাজসেবার
কথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “খ্যাতির আশা করিও না, কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে
বাধা ও অবিশ্বাস স্বীকার করিতে হইবে। কেবল ধৈর্য এবং প্রেম, নিভৃত
তপস্যা।” বলছেন আরো-
নিঃশেষে প্রাণ করিবে যে দান
ক্ষয় নাই ওরে ক্ষয় নাই।
এবার
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেছি-বইতে পারব, সইতে পারব দুর্গম পথের এত ঝড়-
ঝঞ্ঝা? সংকল্পে অটল থেকে চিন্তার স্রোত ফিরিয়ে দিলাম। কর্তব্য করে যাব,
বাধা আসে আসুক, সব সইব। মনে পড়েছে দুই কবির দুটা লাইন-
ইকবাল বলেছেন-
প্রশংসা করি সেই পথচারীর
যে ঘৃণা করে পদক্ষেপ করতে গতানুগতিক পথে
যে পথে নাই নদী, পর্বত, মরুভূমি।
নজরুল বলেছেন-
সত্য যদি হয় ধ্রুব তোর
কর্মে যদি না রয় ছল
ধর্ম দুগ্ধে না রয় জল
সত্যের জয় হবেই হবে
আজ নয় কাল মিলবে ফল।
প্রতিদানের
প্রশ্নে মনে হয়েছে সমাজ চিরদিন অন্ধ থাকবে না। সমাজ ও জাতি না হয় থাকলই।
সেবা করব সমস্ত অন্তর দিয়ে, চরম সততা দিয়ে। পরিণামে জয় আসবেই, চেষ্টা
সার্থক হবেই। কোনো চেষ্টাই ব্যর্থ হয় না। রবিঠাকুরের ভাষায়-
যে ফুল না ফুটিতে ঝরছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারাল ধারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা ॥
দূর
দৃষ্টিতে দেখেছি অমূর্ত স্বপ্ন মূর্তরূপ নিচ্ছে। স্কুলটি ধাপে ধাপে
পরিপূর্ণ রূপে ফুটে উঠছে। তখন মানুষ হয়তো হবে অকৃতজ্ঞ, সমাজ হয়তো করবে
বিশ্বাসঘাতকতা, সহকর্মীরা হয়তো ঈর্ষাবশে হানবে আঘাত। কিন্তু স্কুলের মাটি,
প্রাণহীন ইটপাটকেলের ঘর, চারিদিককার প্রকৃতি ওরা তো কোনো দিন অকৃতজ্ঞ হতে
পারে না। এরাই রইবে কালের সাক্ষী। হাশরে কৃতকর্মের সাক্ষী বহন করবে ওরাই।
মনে
পড়েছে এরিস্টোটলের কথা-এথেন্সে লাইকুয়ামে বারো বছরের অক্লান্ত সাধনায়
সক্রেটিস প্লেটোর বাণীর রূপ দিতে স্থাপন করলেন বিখ্যাত বিদ্যালয়টি। তার
খ্যাতি ও প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত এথেন্সবাসী চক্রজাল বিস্তার করে অপমানিত
করল এরিস্টোটলকে। প্রাণের ভয়ে তিনি ত্যাগ করলেন এথেন্স। এই তো ইতিহাসের
সাক্ষ্য। ক্ষতি হয়নি এরিস্টোটলের, হারিয়েছে তারা সাধককে। রাখতে পারেনি
প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, বৈশিষ্ট্য। আর আমার ভাগ্যেও তেমনটি ঘটতে পারে কারণ
বাঙালিরা ঈর্ষাকাতর। বাঙালি জাতির ঈর্ষার কথাটি বড়লাট হার্ডিঞ্জ এমনিভাবে
বলেছেন, ‘বাঙালির মতো এমন ঈর্ষাপরায়ণ জাতি দুনিয়াতে আর নাই।’
(ক্রমশ:)