জীবন
স্বপ্ন-একটা আদর্শ প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা। ধূলির ধরায় নিষ্পাপ শিশুদের
জন্য একটা গুলবাগিচা সৃষ্টি। লক্ষ্য-পরীক্ষণ ক্রমে আদর্শ মানুষ তৈরির ভিত
মজবুত করা। সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ। কারণ স্কুল আছে, শিক্ষকও আছে, নেই আদর্শ,
সংকল্প, সাধনা। শিশুদের আদর্শ জীবনদান। পেস্তালজ্জীর কথাটাই মনে করার।
বলেছেন- ‘(শিক্ষক) তুমি কি কৃষক যেমন করে তার গরুকে যত্ন করে, তেমনি তাকে
(শিশুকে) যত্ন করছ’? আমি আজীবন শিক্ষক। সুন্দর শিশুকে সুন্দরতম করে সৃষ্টিই
লক্ষ্য ।
তিন.
পরিকল্পনার প্রথম খসড়া (জুন ১৯৫৯)
দশ-এগারো বছর
বয়সীমার ছেলেমেয়েদের জন্য জাতীয় আদর্শ, আশা-আকাক্সক্ষা ও জনগণের মননশীলতা
অনুযায়ী উন্নতমানের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য কুমিল্লায় একটি
প্রাইমারি স্কুল স্থাপন। ছাত্রসংখ্যা থাকবে প্রথমে ১৫০, পরে নেয়া হবে ৩০০।
আবাসিক একটা ছাত্রাবাস থাকবে। প্রথম বছর নেয়া হবে ১০-১৫ জন ছাত্র। পরে
সংখ্যা বাড়িয়ে করা হবে ৫০-৬০ জন। ধাপে ধাপে ছাত্রাবাসের কাজটা এগিয়ে চলবে।
সঙ্গে থাকবে একটা কিন্ডারগার্টেন। ছাত্র থাকবে ২৫ জন। শিক্ষক সব সময়ের জন্য
একজন।
নাম
আপাতত প্রতিষ্ঠানটির নাম দেয়া যেতে পারে ‘শিশু নিকেতন’ বা
‘চিল্ডরেনস হোম’। পরে কার্য নির্বাহক কমিটি নাম ঠিক করবে। আর যদি কেউ জমি
দান করতে পারে, যদি স্কুল ঘর নির্মাণের দায়িত্ব নেয়, তবে তার নামেও স্কুলটি
হতে পারে।
কেন একটা প্রাইমারি স্কুলের প্রয়োজন
আমাদের অনেকেরই
নিজেদের শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপর কোনো আস্থা নেই। উন্নতমানের
বিদ্যালয়ের একান্ত অভাব এ স্বীকার্য সত্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের
শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদেশি ধর্মপ্রচারক মিশনারি-বিশেষত খ্রিস্টান মিশনারিদের
দ্বারা পরিচালিত স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠান। ঐসব স্কুল প্রতিষ্ঠান কোনো ক্রমেই
স্বাধীন জাতির উন্নতি ও প্রগতির জন্য আদর্শ নয়। আমাদের প্রয়োজন এমন স্কুল
যার ভিত্তি হবে জাতীয় কৃষ্টি, সভ্যতা ও ধর্মের উপর। মিশনারি পরিচালিত
স্কুলগুলো বাইরের থেকে যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন, পরিচালন ব্যবস্থা সুষ্ঠু
হোক না-তাতে আমাদের আদর্শের চিহ্নমাত্রও নেই। মিশনারিরাও যে কেবল মানবতার
সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুল করেছে তা নয় । এর পশ্চাতে একগূঢ় রহস্যও রয়েছে।
মুখ্যত এরা চায় এদের ধর্মের ব্যাপ্তি। তাদের আদর্শের প্রচার।
স্কুলের বৈশিষ্ট্য কী হবে
বিভাগীয় শিক্ষা পাঠ্যসূচি ব্যতীত চেষ্টা চলবে-
০ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক অর্থাৎ শিশুদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশসাধন।
০ কচিকাঁচাদের মনে জাতীয় আদর্শের প্রেরণাদান।
০ স্বাধীন দেশের নাগরিকের চেতনাবোধ জাগানো।
০ স্কুলকে সামাজিক জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে সংযোজন।
০ স্কুলটি মুখ্যত হবে একটি পরীক্ষণ বিদ্যালয়। শিশু শিক্ষায় চলবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
পরিচালন ব্যবস্থা
প্রাথমিক
কাজের জন্য একটা কমিটি গঠন করতে হবে। সভাপতি থাকবেন জেলা প্রশাসক। আর মোট
সদস্য সংখ্যা থাকবে ১২ জন। কাজ হবে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালন। পরে স্কুল
পরিচালনের জন্য একটা স্বাধীন কমিটি এ কাজের ভার গ্রহণ করবে।
স্কুলের কয়েকটি শর্ত
০ স্কুলে সবাই বেতন দিয়ে পড়বে। মাসিক বেতন কত হবে তা কমিটি ঠিক করবে। দেখতে হবে যেন শিক্ষকের মাহিয়ানা তা দিয়ে চলে যায়।
০ সাধারণত প্রতি ৩০ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক থাকবে।
০ হোস্টেলের প্রতি ছাত্রের খোরাকি বাবদ দিতে হবে ৪০-৫০ টাকা। তাতে চলবে দু’বেলা খাওয়া ও টিফিন।
০ হোস্টেলের ভার ন্যস্ত থাকবে একজন সুপারিনটেনডেন্টের উপর।
পরিকল্পনা
করা সহজ, বাস্তবায়ন কঠিন। অমূর্তকে মূর্তরূপ দেয়ার পথে রয়েছে তুঙ্গ পর্বত,
উত্তাল সমুদ্র। এ যে দুর্গম পথযাত্রা। গন্তব্যে পৌঁছা কেবল দৃঢ়
প্রত্যয়শীল অধ্যবসায়ী সাধকের পক্ষেই সম্ভব। সাধনা কোনোদিনই ব্যর্থ হয় না।
অকৃত্রিম সাধনায় পরিণামে সিদ্ধি আসে। এটা স্বতঃসিদ্ধ।
(ক্রমশ:)