শান্তি ও উন্নয়নের জন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। আর যেহেতু তিন দিকে সীমান্ত থাকা ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রধান প্রতিবেশী, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আরো বেশি জরুরি। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ঘটে চলা ঘটনাগুলো দুই দেশের সম্পর্ককে এক বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে হয়। গত সোমবার ভারতের আগরতলার কুঞ্জবনে অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এ সময় দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। একই দিন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে যোগ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন তিনি।
ভারতের বেশ কিছু অনলাইন মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে যে ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে, তার ফল যে ভালো হয়নি, সেটা গত সোমবারের ঘটনায়ই স্পষ্ট।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক তিক্ততার বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সবেধন নীলমণি হিসেবে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী যে দেশটির সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উষ্ণ ছিল, সেটি বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনে প্রতিবেশী দেশ দুটির মাঝেও এখন দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান অনেক দেয়াল রচিত হয়ে গেছে।’
এই ‘দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দেয়াল’ সরাতে গত সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। কূটনীতিক ব্রিফিং শেষে তিনি জানিয়েছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড বরদাশত করবে না।’ ব্রিফিংয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের কথা এসেছে। প্রধানত ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার। উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ উভয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী।
‘ভারতের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি থাকলে তা দূর হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)। তার মতে, ‘এ দেশের মানুষ ভারতবিরোধী নয়। যতটুকু ভুল-বোঝাবুঝি আছে, এটা দূর হবে।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দুই দেশের মানুষে মানুষে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সে কারণেই বারবার হোঁচট খেলেও এই বন্ধন কখনো ছিন্ন হয় না। দুই দেশই অভিন্ন ঐতিহ্যের অধিকারী। আমরা চাই, পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকুক। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সব ধরনের যোগাযোগ ও সহযোগিতা ক্রমশ জোরদার হোক। সেই লক্ষ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে উভয় দেশকেই আরো বেশি আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে। গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে এক আলোচনাসভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ইতিবাচক ও গঠনমূলক থাকবে।’
বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী দেশ। এই দুই দেশের রয়েছে অভিন্ন ইতিহাস। সবার ওপরে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশের মানুষের মধ্যে রক্তের যে বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগ। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ও ভারতের এই সম্পর্ক উত্তরোত্তর আরো শক্তিশালী হবে এবং উভয় দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে।