জন্ম হলো স্কুলের
এলো
শুভ দিন, আনন্দের দিন, শুকরিয়ার দিন, স্কুলের জন্মদিন। ১৯৬১ সালের পহেলা
জুলাই। জেলা স্কুলের তদানীন্তন হেড মাস্টার রশীদ সাহেবের বদৌলতে স্থান
পাওয়া গেল। তার বাসাসংলগ্ন স্কুলের কমনরুম ও লামবার রুমে। তারই দেয়া
টুল-বেঞ্চি দিয়ে স্কুলের কাজ শুরু হয়। স্কুলের নাম হলো ‘চিল্ডরেনস হোম’,
প্রাইমারি স্কুল। সঙ্গে একটি কিন্ডারগার্টেন। বহু আকাক্সিক্ষত স্কুলটির
জন্ম হলো। লালন-পালনভার একান্তই নিজস্ব। চেষ্টা চলে আদর্শ মোতাবেক স্কুলটি
গড়ে ওঠানোর। নিয়ম-কানুন তৈরি, শিক্ষদের তালিম দেয়া-সবই।
যে আদর্শ
স্থাপনের জন্য এ প্রচেষ্টা তা হঠাৎ করে কোনোদিনই সম্ভব নয়। কারণ আদর্শ আর
বাস্তবের মধ্যে ব্যবধান অনেক। আদর্শ কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে বহু
পরীক্ষণ-নিরীক্ষণের দরকার। তাতে দরকার অসীম ধৈর্যের। আর পরীক্ষণ কাজের ক্রম
অভিজ্ঞতার ফলে সময় ও ক্রমগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অনেক কিছুর পরিবর্তনও
প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই কতকগুলো সুচিন্তিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্মুখে
রেখে কাজ শুরু করা হয়েছে, যা যে কোনো পরীক্ষণ কাজের জন্য অপরিহার্য।
স্কুলের স্থান
পরিকল্পনা
প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের স্থান নির্বাচনের দিকে নজর রাখা হয়। দান
হিসেবে শহরের বুকে কোনো স্থান পাওয়া গেল না। জমি একোয়ার করা ছাড়া গত্যন্তর
ছিল না। জমি হতে হবে কমসেকম দু-তিন একর। প্রাইমারি স্কুলের জন্য এত জমি!
সবাই অবাক, অনেকে বিদ্রূপ করেছেন। বিরূপ সমালোচনাও করেছেন। লোকটার মাথা
খারাপ। মাথায় ছিট আছে। আরো কত কথা, আমার কানে কিন্তু তুলো।
প্রথমে স্থান
নির্বাচন করলাম বাগিচাগাঁয়ে জজ সাহেবের বাড়ির উত্তরে, রানীর বাজার-পুলিশ
লাইনের রাস্তার পশ্চিম পাশে। বেশ ভালো জায়গা। কিছুটা নিচু জমিসহ একুইজিশনের
প্রস্তাব হলো। শেষ পর্যন্ত হলো না। অফিসের কিছু লোক কিছু অংশ কিনে নিল।
অফিস তাদের পক্ষে। আমার আপত্তি টিকেনি। তারপর ছোটাছুটির অন্ত নাই। শহরের
আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে আপনমনে দেখেছি আর ভেবেছি-স্থানটা রাস্তার পাশে হতে
হবে। শহরের কেন্দ্রস্থলে। কিন্তু কোথায়? ডিসি কাজী মুহম্মদ মোশারফ হোসেন
সাহেবকে নিয়ে শেষবারের মতো বেরুলাম। সঙ্গে এসডিও ওয়াহেদ সাহেব। কয়েকটা
স্থান দেখলাম। আমার জোর আবেদন বর্তমানে যেখানে স্কুলটি সে স্থানটির জন্য।
ডিসি সাহেবকে পরিকল্পনার ম্যাপ করে দেখালাম। তিনি আমার স্বপ্ন- স্বাধটা
দেখে রাজি হলেন।
ক্ষেত্রীদের জায়গা বেশিরভাগ। তাদের বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি
করলাম বহুবার, দান চাইলাম, নাম দিতে চাইলাম। কিছুতেই রাজি নয়, বরং বহু
কটাক্ষ করেছেন কথাচ্ছলে। নীরবে সয়েছি। ভিক্ষুক আমি।
আবার সংকট।
রিকুইজেশন অফিসে দরখাস্ত পেশ করে জানলাম এ স্থানে সরকারি অফিসারদের বাসার
কলোনি করার প্রস্তাব চলে গেছে চাটগাঁ কমিশনার অফিসে। অনেক চেষ্টার পর আমার
পরিকল্পনার পক্ষে ডিসি সাহেব ফিরিয়ে আনলেন তা। অফিস দারুণ ক্ষেপা। তার পর
চলল লেখালেখি, তদ্বির, রিকুইজেশন অফিসে ছোটাছুটি। অফিসারদের বাসায়ও।
কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি। ছোট বড় সকলের কাছে মিনতি। সেও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
আট বছর গিয়েছে এ স্থান একুইজিশনে। পার্শ্বের বাসিন্দার সঙ্গে মামলাও হয়েছে
কয়েক দফা। এত সবে জুতার তলা বারবার হাফসুল করাতে হয়েছে। সালাম আর সালাম
অফিসকে। বেদনা বিজড়িত অনেক স্মৃতি মনে জাগে। অনেকে ঠাট্টা করেছে-এই নাকি
ক্লাস ওয়ান অফিসার! এত নতি স্বীকার কেন? কেনর উত্তর ছিল আমার অন্তরে।
শিক্ষাসেবা, জনসেবা, সমাজসেবা-ঐ তো অন্তর বাণী।
সমাজসেবার উদগ্র
আকাক্সক্ষায় নিজেকে ছোট করে নিয়েছি। অনেক ভ্রুকুটি, অনেক তাচ্ছিল্য উপেক্ষা
করেছি। যারা একুইজেশন নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন তারাই এ সত্য বুঝতে পারবেন। ঘুষ
দেয়া আর নেয়া যে সমভাবে হারাম, অন্যায়, আদর্শের বিসর্জন। সেখানেই আমার বিপদ
ছিল বেশি। নতি স্বীকার করিনি, দেইনি একটি পয়সাও। তবে করেছি মিনতি,
দুর্নীতির সাথে জীবনে আপোস নেই। ভেঙেছি, মচকাইনি ।
তিন দফায় ২.৪৯,
(দু'একর ঊনপঞ্চাশ) শতক জায়গা নেয়া হয়। স্থানটির দাম দিতে হয় ৬৪,০০০
(চৌষট্টি হাজার) টাকা। নজরুল এভিনিউ-এর পাশে। রাস্তার নামটা আমারই অনুরোধে
মিউনিসিপ্যাল কর্তা জনাব এ. জেড. ওয়ায়েদ উল্লা খান মঞ্জুর করেছেন। রাস্তার
দক্ষিণ পার্শ্বে দু'একর। তন্মধ্যে রয়েছে আট কক্ষবিশিষ্ট একটি পুরানো দালান ও
পূর্বাংশে সাঁতারের পুকুর।
১০০০-১৫০০ ছেলেমেয়ের উপযোগীএকটা মিলায়তনের
জায়গা, ছেলেদের উপযোগী দুটা খেলার মাঠ, দক্ষিণাংশে শিক্ষকদের বাসস্থানের বা
স্কুলের আর একটা ব্লক নির্মাণের স্থান। পুরানো দালানটার উপরে দ্বিতল একটা
মিউজিয়াম বা জাদুঘরের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব। রাস্তার উত্তর পাশে নেয়া
হয়েছে ছেলেদের ছাত্রাবাসের জন্য আট কক্ষ বিশিষ্ট একটা দ্বিতল দালান আর
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আর একটা ছোট দালানসমেত ৪৯ শতক জায়গা। এটা ছিল কেন্দ্রীয়
আবগারী বিভাগের রিকুইজিশন বাড়ি। তা ছেড়ে আনতেও কম হয়রানি হতে হয়নি। তারপর
স্থানীয় রিকুইজিশনে দখলি দু'কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটি পেতে গেছে ৫/৬ বছর। কে তার
খবর রাখে? আমার শুকরিয়া, আমার আনন্দ, আমার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। স্কুলের
একটা মনোরম স্থান হয়েছে। অনেক শহরে কলেজের জন্যও এমন স্থান হয় না, পাওয়াও
সম্ভব নয়। করাও শক্ত ব্যাপার। শুকুর হাজারো। যারা স্কুল স্থাপন সম্পর্কে
কল্পিত দাবি করে তাদের একজনও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আগে অর্থাৎ ১৯৬২-এর
আগে কোনো অবদান রাখে নাই। এমনকি কমিটিতেও ছিল না। দলিলপত্র সে সাক্ষ্য বহন
করছে।
চার.
স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর
১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি আর একটা
শুভদিন। এমন আনন্দময় দিন স্কুল জীবনে আর হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের
গভর্নর লে. জেনারেল মুহম্মদ আজম খান ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ‘চিল্ডরেনস
হোম’-এর। ভাষণে উৎসাহ বাণী দিলেন উন্নতি কামনা করলেন। পরে এ শিশু নিকেতনের
বৃহত্তর প্রকল্পের জন্য সেক্রেটারিয়েটে একটা ফাইলও খোলা হয়েছিল। গভর্নর
আজম খান চলে যাওয়ায় সরকারি সাহায্যের আশাও ত্যাগ করতে হয়েছিল।
আর একটা
আনন্দমুখর দিন এলো। যেদিন তদানীন্তন ভিপিআই পাকিস্তানের প্রাক্তন
শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমান বাংলা সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জনাব মুহম্মদ
শামসুল হক সাহেব নিজ হাতে স্কুল দালানের ভিত জনাব কাজী মোশারফ হোসেন
সাহেবের হাতে হাত মিলিয়ে কোদাল দিয়ে প্রথম দাগ কেটে দিলেন। তিনিই প্রথম
বললেন-দ্বিতল নয়, ত্রিতল চারতল বাড়ির ভিত দাও। প্রয়োজনের তাগিদে আকাশের
দিকেই স্কুল ঘর নির্মাণ করতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার জনাব ওয়াহিদুর রহমান ও জনাব
ফজলুল হক সাহেব প্ল্যানটি আবার পালটে দিলেন। চারতালা দালানের। এদের সবার
পুণস্মৃতি জড়িয়ে আছে স্কুল দালানটির সাথে।
দ্বিতল দালান হলো সাত-আট
বছরে। দ্বিতল পর্যন্ত দালানটি তৈরি করতে, সামনের দেয়ালসমেত যা খরচ হয়েছে,
তা এত অল্প যে অবাক বিস্ময়ে সবাই বলেন-এ অসম্ভব। অথচ তাই সম্ভব হয়েছে।
প্রতি বর্গফুটের খরচ মাত্র দশ টাকা বা একটু বেশি (১৯৭০ মে পর্যন্ত)।
নির্মাণ বিভাগের খরচপত্রের খতিয়ান দেখলে তা বিশ্বাস হবে। যে কেউ তা নিজে
দেখতে পারেন। কঠোর মিতব্যয়িতায় তা সম্ভব হয়েছে। তা মানুষ স্বীকার করুক আর
নাই করুক; জানুক আর নাই জানুক তা জ্বলন্ত সত্য। তার কারণও আছে-অনেক ইট,
সিমেন্ট, গাছ, কাঠ পাওয়া গেছে ভিক্ষা করে। সে আর এক দুরন্ত অভিজ্ঞতা।
স্কুল-কলেজ
প্রতিষ্ঠা, তার জন্য স্থান সংগ্রহ, দালান-কোঠা তৈরি শক্ত কাজ তা
নিঃসন্দেহে সত্য। ততোধিক শক্ত কাজ মানুষ তৈরি। সর্বাধিক শক্ত কাজ মানুষ
গড়ার কারিগর তৈরি। অভাব সুশিক্ষকের, সঠিক নেতৃত্বের, আদর্শ পথপ্রদর্শকের।