বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর ২০২৪
২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২:৫৫ এএম |

 গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ

কমিউনিস্ট দুনিয়া আজ একটা বড়ো রকমের ওলটপালটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। বিপর্যয়ের চেহারা একেক রকম। ১৯৮৯ সালের মে-জুন মাসের চিত্রটা মনে করা যাক। পোল্যান্ডের নির্বাচনের ফলাফলে কমিউনিস্ট দলের শঙ্কিত বোধ করার যথেষ্ট কারণ দেখা দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ওদেশের পার্লামেন্টে এখনও অধিকাংশ আসন কমিউনিস্ট দলের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু যে কয়টি আসনে কমিউনিস্ট প্রার্থীর সঙ্গে বিরোধী ‘সলিডারিটি’র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ ছিল তার ভিতর শতকরা নব্বইভাগেরও বেশি আসনে ‘সলিডারিটি’ জয়ী হয়েছে। চীনের ছাত্রআন্দোলন কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জনতার ভিতর অভূতপূর্ব সমর্থন লাভ করেছে। অন্য কোনোভাবে আন্দোলনকে দমাতে না পেরে চীন সরকার সৈন্য ডেকে রক্তাক্ত ছাত্রনিধনযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে। সোভিয়েত দেশে গর্বাচভের নেতৃত্বের গুণে ঐরকম কোনো অমানুষিক কাণ্ড কোখনও ঘটেনি। ওখানে বাক্স্বধীনতা প্রসারিত হয়েছে। বহুবছর পর এই প্রথম ওদেশের পার্লামেন্টে বেসরকারি কণ্ঠস্বর শোনা গেল। দক্ষিণ ও বামপন্থিদের মাঝামাঝি পথে গর্বাচভকে সাবধানে চলতে হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। 
ঘটনার এই বৈচিত্র্যের ভিতরও একটা জায়গায় মিল চোখে পড়ে। সব দেশেই গণতন্ত্রের সপক্ষে মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ওই একটি দাবি কমিউনিস্ট দুনিয়ার রক্ষণশীল নেতা ও শাসকদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছে। গণতন্ত্রের দাবির ভিতর রক্ষণশীল শাসকদল পশ্চিমী সংস্কৃতির প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন। বিষয়টা আরও একটু গভীরভাবে ভেবে দেখনোর নিশ্চয়ই সময় এসেছে। 
পশ্চিমী প্রভাব কমিউনিস্ট দেশগুলোতে ক্রমেই বেশি করে এসে পৌঁছাচ্ছে এ কথাটা অস্বীকার করা যাবে না। তৃতীয় বিশ্বেও একই ব্যাপারে ঘটছে। তবে আপাতত আমাদের আলোচনার বিষয় কমিউনিস্ট দুনিয়া। পশ্চিমের সঙ্গে কম্যূনিস্ট দেশের যোগাযোগ বেড়ে চলেছে। ব্যাপারটা অনিচ্ছ্য়া ঘটছে এমনও নয়। কমিউনিস্ট দেশগুলো স্বেচ্ছায় যোগাযোগ বাড়িয়েছে। পশ্চিমী প্রযুক্তি তারা আগ্রহ করে চাইছে। মানুষ ও মালপত্রের যাতায়াত বাড়ছে। কয়েক বছরের ভিতর সংবাদবহনের আশ্চর্য উন্নতি ঘটেছে। টেলিভিশনের গুণে এক দেশের ঘটনা ও জীবনযাত্রা অবিলম্বে ছুবি হয়ে অন্য দেশের দর্শকদের সামনে পৌঁছে যাচ্ছে। এসব আজ ঠেকানো মুশকিল।
চীনের ১৯৮৯ সালের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে যাঁরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা এর পিছনে পশ্চিমী প্রভাব দেখছেন। এখন প্রশ্নটা এই। তবে কি এইরকমের ‘অশান্তি’ ঠেকানোর জন্য পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হবে? সেটা কি আজ সম্ভব? প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এমন একটা অবস্থায় কি আমরা পৌঁছে যাইনি যে নতুন করে দেওয়াল তুলে পৃথিবীটাকে আর স্থায়ীভাবে খণ্ড খণ্ড করা যাবে না? আরও একটা প্রশ্ন আছে। চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগে। সোভিয়েত দেশে তো সত্তর বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এই সময়ে সমগ্র জনতাকে ও বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে মার্কসবাদে, সরকারি মতবাদে, দীক্ষিত করার চেষ্টা চলেছে অবিরত, সর্বউপায়ে। তবু কেন ছাত্রছাত্রীদের ভিতর ‘পশ্চিমী’ প্রভাব এত দ্রুত, এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে? কমিউনিস্ট মতবাদে দীক্ষাদানের প্রয়াস কেন ব্যর্থ হয়? পশ্চিমী প্রভাবের দোষ-ত্রুটি অস্বীকার না করেও প্রশ্ন থেকে যায়, আন্দোলন, বন্দুক দিয়ে দমন করেই কি শেষ পর্যন্ত ওই প্রভাব আটাকনো যাবে? এতে কি অনিবার্য পরিবর্তনকে অযথা আরও হিংসাত্মক করে তোলা হবে না?
প্রতিটি দেশের সমস্যা ও ঘটনাবলির পিছনে থাকে কিছুটা সেই দেশের বিশেষ পরিস্থিতির ঘাতপ্রতিঘাত আর কিছুটা যুগের সামান্য ধর্ম বা সাধারণ গতির প্রভাব। যেমন ধরা যাক চীনের সাম্প্রতিক ঘটনাচক্র। এর পিছনে উজিঝুঁকি মারে একটা ক্ষমতার লড়াই, যার একদিকে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী লি পেং আর অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক চাও জিয়াং। চাও ভরসা রেখেছিলেন ছাত্র-আন্দোলনের ওপর; লি পেং নির্ভর করলেন সেনাবাহিনীর ওপর। প্রবীণ নেতা তেং শিয়াওপিং এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াং শাংকুন ছাত্র-আন্দোলনের বিরুদ্ধে  দাঁড়ালেন, ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে চাও জিয়াং পরাজিত হলেন। সেনাবাহিনীর ভিতরও বিভেদ ছিল। তবে তেং শিয়াও পিং কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান, তাঁর কর্তৃত্ব কার্যকর হলো। এইসব চীনের বিশেষ পরিস্থিতির কথা, চীন বিশেষজ্ঞদের কাজে এইরকম নানা তথ্য পাওয়া যাবে।
সোভিয়েত দেশে কমিউনিস্ট দল শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির নামে ক্ষমতা দখল করেছিল। উৎপাদনের প্রধান প্রধান উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজের কর্তৃত্ব, এইরকম ছিল লক্ষ্য। সাম্যবাদের এই আদর্শ বহু মানুষকে সেদিন অনুপ্রাণিত করেছিল।
অচিরেই সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হলো রাষ্ট্রের মালিকানা, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সুরক্ষিত কমিউনিস্ট দলের কর্র্তৃত্ব। দ্রুত গড়ে উঠল এক অতিকেন্দ্রিত অর্থনীতি। মূলত সেটা এক জঙ্গি অর্থনীতি, যার প্রধান লক্ষ্য দেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করে তোলা। স্টালিনের নেতৃত্বের প্রধান কৃতিত্ব এই : ইউরোপ এশিয়া জুড়ে বিশাল পশ্চাৎপদ দেশে সাম্যবাদী এক সামরিক অর্থনীতি মাথা তুলে দাঁড়াল। তাঁর অন্যান্য সুকৃতি ও অপকীর্তি নিয়ে বিতর্ক চলবে, কিন্তু স্টালিনের মহামান্যতার প্রধান স্তম্ভ ওই জঙ্গি অর্থনীতি।
স্টালিন ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, স্টালিনের নেতৃত্বে ও নীতির গুণেই রুশ দেশকে হিটলারী সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করা গেছে। এই যুক্তি দাঁড়ায় না। যেমন পরাক্রান্ত মার্কিন সেনাবাহিনী ভিয়েতনাম জয় করে নিতে পারেনি, যেমন সোভিয়েত সেনাবাহিনী বিপুল রণসম্ভার সত্ত্বেও আফগানিস্তান থেকে হটে আসতে বাধ্য হয়েছে, তেমনি জার্মান সেনাবাহিনীর পক্ষেও কোনোক্রমেই রুশদেশ অধিকার করে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সোভিয়েত দেশের বিশাল আয়তন আর সোভিয়েত জনগণের দেশপ্রেমিক প্রতিরোধের জন্যই সেটা অসম্ভব ছিল। এজন্য স্টাালিন মহত্ত্বের দ্বারস্থ হওয়া ভুল। এরকম ব্যক্তিপূজার সঙ্গে মার্কসবাদেরও সামঞ্জস্য নেই।
এইসব বিতর্কের বাইরে থেকেই স্টালিনি জঙ্গি অর্থনীতির কিছু পরিণাম স্পষ্টভাবে লক্ষ করা সম্ভব। এ যাবৎ পরিকল্পিত অর্থনীতিতে কেন্দ্রের প্রাধান্য দেখা গেছে। সামরিক পরিবেশে যখন পরিকল্পনা রূপলাভ করে তখন এই অতিকেন্দ্রীয় ঝোঁক আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এই ব্যাপরটা অনেকদিন ধরে চললে আমলাতন্ত্রের শক্তি অত্যধিক বেড়ে যায়। সোভিয়েত ব্যবস্থায় তাই ঘটেছে। উৎপাদনের যন্ত্রের ওপর সামাজিক কর্তৃত্বের নামে আসলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একদলীয় শাসকগোষ্ঠী ও আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা। জঙ্গি অর্থনীতির অন্য এক পরিণাম এই যে, ভারি শিল্প ক্রমাগত অগ্রাধিকার পেয়ে গেছে, ভোগ্যবস্তুর উৎপাদন অবহেলিত থেকেছে। গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রেও যুদ্ধের প্রয়োজন বিপুলভাবে সমর্থন পেয়েছে। যুদ্ধের অস্ত্রে তাই সোভিয়েত দেশ পশ্চিমী অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে নেই। কিন্তু ভোগ্যবস্তুর মান অনুন্নত থেকে গেছে।
একদলীয় অতিকেন্দ্রিত আমলাতান্ত্রিক এই সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে মার্কসীয় মতাদর্শ। মার্কস কখনো বলেছিলেন, সবকিছুকে সংশয়ের চোখে দেখা চাই। কিন্তু রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট মাকর্সবাদ ভিন্ন জিনিস। ইসলামি রাষ্ট্রে যেমন ইসলামের সমালোচনা অবৈধ, মার্কসবাদী দেশগুলোতে তেমনি মার্কসবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে। শুধু তাই নয়, শাসকদল ও দলের নেতাও এতকাল ঐরকমই একটা স্থান অধিকার করেছিলেন। স্টালিনের যুগে তাঁকে সমালোচনা করাটা ছিল মহা অপরাধ। এখনও লেনিনের স্থান সমালোচনার ঊর্ধ্বে। “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখিসত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” এ এক শ্বাসরোধকারী অবস্থা যেখানে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্বন্ধে সমস্ত সংশয়ের উচ্চারণই কার্যত নিষিদ্ধ। 
অল্পস্বল্প অদলবদলসহ অন্যান্য সাম্যবাদী দেশগুলোতেও একই অবস্থা। শিল্পায়নের পথে সোভিয়েত দেশের তুলনায় চীন পিছিয়ে আছে। তেং শিয়াও পিং চান আধুনিকীরণ, শিল্প ও প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ এবং সেই উদ্দেশ্যে পশ্চিমী জগতের সঙ্গে সহযোগিতা। কিন্তু দলীয় একাধিপত্যের প্রশ্নে তিনি কঠোরভাবে রক্ষণশীল। দলীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছাত্র-আন্দোন তাঁরা কাছে অসহ্য। তাঁর বিচারে পেরেস্ত্রইকার প্রয়োজন আছে, কিন্তু গ্লাসনস্ত সম্বন্ধে তিনি সাবধান। আসলে গর্বাচভ এ দুয়ের সম্পর্ক যেভাবে বুঝেছেন চীনের বৃদ্ধ নেতার কাছে সেটা অগ্রাহ্য। মার্কসবাদকে তেং ব্যবহার করছেন পশ্চিমী প্রযুক্তির সপক্ষে, পশ্চিমী সংস্কৃতির বিপক্ষে। ইতোমধ্যে চীন দেশে বেকারি, মূল্যস্ফীতি আর প্রশাসনে দুর্নীতি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্যবাদী দুনিয়ায় এই অবস্থার ভিতর থেকেই উঠে আসছে আজকের প্রতিবাদী আন্দোলন ও পরিবর্তনের জন্য ক্রমবর্ধমান দাবি। এইসব দাবি অনেকটাই সরল ও সহজবোধ্য। মানুষ আর চাইছে না যুদ্ধের পরিমণ্ডলে ও বাধ্যতার ভিতর বাস করতে, চাইছে শান্তির পরিবেশ। চাইছে আরও স্বচ্ছন্দ জীবন, পরিমাণে বেশি ও গুণগত মানে আরও উৎকৃষ্ট ভোগ্যবস্তু। চাইছে বাক্স্বাধীনতা, নির্ভয়ে সমালোচনা করার অধিকার। চাইছে না আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব, দুর্নীতি, দলের কর্তাদের স্বজনপোষণ। এইসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এদের গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন।
মার্কসবাদীর প্রশ্ন, এরা কারা? অর্থাৎ কোন শ্রেণিভুক্ত? মার্কসবাদীর প্রত্যয়, সব ঐতিহাসিক দাবি ও আন্দোলনের পিছনেই থাকে শ্রেণিদ্বন্দ্ব; অতএব প্রশ্ন, সাম্যবাদী সমাজে আজ নতুন দাবি নিয়ে এগিয়ে আসছে কারা? উত্তরে এইটুকুই বলা যায়, এইসব দাবির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার যোগ আছে, সাধারণ মানুষেরই দাবি এইসব। আন্দোলনের চেহারা এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন রকমের মানুষ। পোল্যান্ডে বিরোধী শ্রমিকসংগঠন, ‘সলিডারিটি’, প্রতিবাদ আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায়; চীনে ছাত্রসংগঠন। ‘সলিডারিটি’, সাধারণ মানুষের দাবিকেই ভাষা দিয়েছে, সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাদের বিপুল জয়লাভের ভিতর দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে। চীনে ছাত্র-আন্দোলনের প্রতি শহরে শহরে অগণিত মানুষের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। সোভিয়েত দেশে পরিবর্তনের দাবি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং গর্বাচভ, তাঁর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করছে যে এইসব দাবির সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের যোগ আছে। প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক সংগ্রামকেই সুনির্দিষ্ট শ্রেণিসংগ্রামের রূপ নিতে হবে এই প্রত্যাশা মান্য নয়। এরপরও অনিবার্যভাবে প্রশ্ন ওঠে, দাবি যদি সাধারণ মানুষেরই তবে বাধা দিচ্ছে কারা? এর একটা সহজ উত্তর আছে। বাধা দিচ্ছে তারাই যারা পুরানো ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী। একদলীয় ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকদলের, আমলাতন্ত্রের ও সেনাবাহিনীর অনেকেই সুবিধাভোগী। তাছাড়া যারা একটা বিশেষ সমাজব্যবস্থা ও মতবাদে বহুকাল অবধি অভ্যস্ত তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যবস্থাকে মনের ভিতর গ্রহণ করা কঠিন হয়। যেমন স্বার্থের বশে তেমনি মনের গঠনেও কিছু লোক রক্ষণশীল। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার নিশ্চয়তাকে ত্যাগ করে অনিশ্চিত অবস্থার দিকে পা বাড়াতে সবাই চায় না।
সাম্যবাদী ব্যবস্থার ভিতর সংকট জমে উঠেছে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত একদলীয় শাসনের কাঠামোর ভিতর আবদ্ধ থাকবে এমন বলা যায় না। সেই পরিবর্তন কোনো বিশেষ মতাদর্শের সীমারেখাকে মান্য করে চলবে এমনও মনে হয় না। কেউ হয়তো বলবেন, মার্কসবাদ তো যুক্তি ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তবে তাকে অতিক্রম করার কথা ওঠে কেন? প্রশ্নটা ঐভাবে তোলা ঠিক নয়। মানুষের ধ্যানারণার সীমা যেকোনো বিশেষ মতবাদের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই অধিক প্রশস্ত। যেমন ধরা যাক আবারও পোল্যান্ডের কথা। সেখানে কিছু লোক মার্কসীয় তত্ত্বে বিশ্বাসী, নিরীশ্বরবাদী। আবার অনেক মানুষ খ্রিষ্টান, অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাসী। একই সমাজে এই দুরকমের বিশ্বসীরই স্থান হওয়া প্রয়োজন, যদিও একটি মতাদর্শের পরিধির ভিতর ঈশ্বরে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের একই সঙ্গে স্থান হওয়া কঠিন। কার্যত সাম্যবাদী সমাজ এই অবস্থাটাকে মনে নিচ্ছে। তবে মার্কসবাদই সেখানে রাষ্ট্রের নিজস্ব মতাদর্শ বলে স্বীকৃত। নতুন প্রজন্ম কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষপাতপুষ্ট ওই মতাদর্শে ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাচ্ছে। পুরানো মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে এটা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি, যেমন পুরানো ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে নতুন প্রজন্মের সংশয়বাদী মনোভাব বিপজ্জনক। জুনের ছাত্রহত্যার পর চীনের নেতারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, মার্কসবাদী শিক্ষাকে আরও জোরালো করা দরকার। এর ফলে কিন্তু ছাত্রদের মনে মার্কসবাদী প্রচার সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ছাত্রদের আন্দোলন ছিল মূলত অহিংস। তার বিরুদ্ধে  রাষ্ট্রনিযুক্ত হিংসার এই প্রয়োগ কি মার্কসবাদের নামেই সমর্থনযোগ্য?
মার্কস বলেছিলেন, উৎপাদনের জন্য বিশেষ যুগের বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত যেসব সম্পর্ক স্থাপিত হয়, প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে নতুন উৎপাদিকা শক্তির যখন বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে তখনই বুঝতে হবে যে, সংকট সমাগত আর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। এইরকমই একটা বিরোধ সাম্যবাদী সমাজের ভিতর আজ আকার গ্রহণ করেছে। পুরানো আর্থিক কাঠামোর ভিতর বিবর্তিত হয়ে উঠেছে নতুন বাস্তব পরিস্থিতি এবং নতুন চেতনা। শুধু উচ্চতর প্রযুক্তি নয়, চেতনার গতিকেও নতুন উৎপাদিকা শক্তি বলে চিনে নিতে হবে। এর সঙ্গে পুরানো রাষ্ট্রতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সামঞ্জস্য আজ ভেঙে পড়েছে। বন্দুকের নল দিয়ে এই ভাঙ্গন আর জোড়া দেওয়া যাবে না।
অতএব বাকি পৃথিবীর মতোই সাম্যবাদী দুনিয়াও এসে দাঁড়িয়েছে এক যুগান্তকারী সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের মুখে। মনে হয় তার গতি হবে কেন্দ্রীয়তা থেকে বিকেন্দ্রীকরণের অভিমুখে, বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ও দলীয় শাসন থেকে ছোট ছোট মানবগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দিকে, সমাজসংগঠনে একান্ত মতাদর্শের প্রচণ্ডতা থেকে অক্লান্ত দৃষ্টিভঙ্গির মান্যতায়, হিংসা থেকে অহিংসায়। এইসব পরিবর্তনের সঠিক রূপরেখা আমরা জানি না। কিন্তু মানুষের প্রতি যাঁদের সদিচ্ছা অটুট তাঁরা চাইবেন যে, পরিবর্তনের পথ নির্ধারিত হোক গণতান্ত্রিক উপায়ে, সভ্যতার কিছু মৌল মূল্যবোধের প্রতি আস্থা রক্ষা করে। অনেকে বলছেন, সমাজতান্ত্রিক জগৎ আজ ফিরে যাচ্ছে ধনতন্ত্রের পথে। এভাবে বললে পুরানো বিবাদটাকেই দীর্ঘায়ু করা হয়। আসলে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বলতে আমরা এতদিন যা বুঝেছি বা দেখে অভ্যস্ত হয়েছি, মানুষের সভ্যতা আজ সেই দুই ব্যবস্থাকেই অতিক্রম করে যেতে চলেছে।












সর্বশেষ সংবাদ
গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ
১৯ বছর পর কুমিল্লায় জামায়াতের কর্মী সম্মেলন
কুমিল্লায় মাদক নিয়ে দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন
কুমিল্লা সদরে জামায়াতের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী দ্বীন মোহাম্মদ
চান্দিনায় অবৈধ ৬ ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল বন্ধ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ভারতের পেয়াজ-রসুনের দিকে আমরা তাকিয়ে নেই: হাজী ইয়াছিন
দেবিদ্বারে আ.লীগ নেতার অবৈধ স্থাপনাসহ শতাধিক দোকান উচ্ছেদ
কুমিল্লায় আমীরে জামায়াতকে স্বাগত জানিয়ে মহানগরী জামায়াতের মিছিল
এক বিজয় অর্জন করেছো, আরেক বিজয় আসবে
কুমিল্লা সদরে জামায়াতের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী দ্বীন মোহাম্মদ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২