রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিশেষ করে সেবা
খাতের এমন কোনো শাখা-প্রশাখা নেই, যেখানে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম জেঁকে বসেনি।
জরুরি সেবা পাওয়ার জন্যও নাগরিকদের হয়রানি হতে হয়, অবশেষে ঘুষ দিয়ে সেবা
নিতে হয়। বছরের পর বছর এ নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হয়ে দিন
দিন আরো অবনতি হচ্ছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০০৯
থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশের সেবা খাতে এক লাখ ৪৬ হাজার
২৫২ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল
বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী,
জরিপের অধীন ১৭টি সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হচ্ছে
পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ গড়
ঘুষ গ্রহণকারী হচ্ছে বিচারিক সেবা, ভূমি ও ব্যাংকিং খাত।
গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের বহুবিধ দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
সেবা
খাতের তো কথাই নেই। কারাগারে আটক স্বজনকে দেখতে গেলেও ঘুষ দিতে হয়। মামলায়
শত শত আসামি করে চলে ঘুষ বাণিজ্য। গরিব মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে কিছু জরুরি
পণ্য দিতে এক কোটি মানুষকে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ আছে,
সেখানেও কার্ড পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতে হয়েছে। ঘুষের বিনিময়ে সচ্ছল ব্যক্তিদের
কার্ড দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক
সংবাদ সম্মেলনে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক
প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দেশের আট বিভাগের ১৫ হাজার ৫১৫টি পরিবারের তথ্য
এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৩ মে থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত এই
জরিপ চালানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির
শিকার ৮৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা এবং ঘুষ দিতে হয়েছে ৭৪.৮ শতাংশের। বিআরটিএতে
সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৮৬ শতাংশ আর প্রতিষ্ঠানটিতে ঘুষ দিতে হয়েছে
৭১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে সেবা নিতে গিয়ে
দুর্নীতির শিকার ৭৪.৫ শতাংশ, ঘুষ দিতে হয়েছে ৫৮.৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে।
বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৬২.৩ শতাংশ, ঘুষের শিকার ৩৪.১
শতাংশ। ভূমিসেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৫১ শতাংশ, ঘুষ দিতে হয়েছে ৩২.৩
শতাংশকে।
দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তৈরি করা হয়েছিল ঘুষ-দুর্নীতি
কমানোর জন্য। সেই দুদক আজ একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আয়ের
সঙ্গে সংগতিহীন সম্পদ অর্জন নিয়ে প্রায় কোনো পদক্ষেপই নেই। ফলে যে যেভাবে
পারছে দুর্নীতি করছে এবং সম্পদ অর্জন করছে। এ ক্ষেত্রে অতীতের সরকারগুলোর
ব্যর্থতা সীমাহীন। টিআইবির পাশাপাশি আমরাও আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এ
ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
পাঁচ.
একটা নিবিড় সংলাপ
হেড
মাস্টার রশিদ সাহেবের বাসায় দু'পাশের ঘরে বসে স্কুল। সকাল-বিকাল অনেক সময়
কাটে ওখানে। তার সাথে অনেক আলাপ হয়। স্কুল, জীবন দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ে।
নিবিড়, অন্তরঙ্গ।
একদিন রশিদ সাহেবের কতকগুলো প্রশ্ন বিব্রত করল। ভীষণ
পরীক্ষার সম্মুখীন হলাম। আমার মনের কথাটি, জীবন আদর্শটি বুঝতে চাইলেন।
কারণও ছিল। এত ঘোরাঘুরি, দৌড়াদৌড়ি। তাকে নিয়ে চলতে হয়েছে রিকশায়, সব পয়সা
আমিই দেই, আর তাকে টেনে নেই। রাশভারী ভালো মানুষ। মন উদার। আমার উত্তর সহজ-
স্কুলের
কাজে ছোটাছুটিতে যা খরচ হচ্ছে তা আমার ছদ্কায়ে জারিয়া। স্কুলের আদায়ী
চাঁদা বা স্কুল তহবিলের একটি পয়সা কোনোদিন স্পর্শ করব না। ওটা মানুষের দান।
আমার জন্য হারাম। পূর্বেও অন্যান্য জায়গায় কয়েকটি জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান
করেছি একই আদর্শে। আর স্কুলের কোনো কিছুতে আমার নাম সংযুক্ত করব না। নাম নয়
কামই আমার লক্ষ্য, আমার কাম্য আমার কাজের সাক্ষী নজরুলের ভাষায়-
সাক্ষী থাকবে আকাশ পৃথিবী রবীশশী গ্রহতারা,
কাহারা সত্য পথের পথিক, পথ ভ্রষ্ট করো ॥
শারীরিক,
মানসিক যত শ্রমই হোক না-তাও রাহে লিল্লাহ স্কুলের পাঠক্রম, শিক্ষক তৈরি,
স্কুলের যাবতীয় কাজই আমার ইবাদত। শিশুসেবার এবাদত আমার চিরপ্রিয়।
‘তা আমরা যারা তোমাকে জানি তারা বুঝলাম! কিন্তু সমাজের লোকেরা কীভাবে নিবে তোমাকে। তোমার সমাজসেবাকে।’
বললাম,
‘সমাজ মানস সম্পর্কে একটা গল্প শোনো। এক সকালে এবাদত শেষে মসজিদ থেকে
ফিরছেন একদল মুসল্লি। রাস্তার পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে এক লোক কাপড় মুড়ি দিয়ে।
একজন মুসল্লি বললেন, লোকটি নিশ্চয় সারারাত এবাদত করেছে। খানিক পর ওপথ দিয়ে
চলছে এক দল চোর। একজন বলছে, ‘শালা সারারাত চুরি করে এখন ভালো মানুষের মতো
ঘুমাচ্ছে।’ এই তো লোকচরিত্র। আমি বিশ্বাস করি কোরাণের বাণীতে। ‘লাহা মা
কাছাবাত, ওয়া আলয়হা মাকতাছাবাত’ অর্থাৎ (সংক্ষেপে) ভালোর ফল ভালো, মন্দের
ফল মন্দ। ‘কিন্তু আমার একটা সংশয় আছে। লোকচরিত্র সত্যি অদ্ভুত। এখনই তো
তোমার জনপ্রিয়তা অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়েছে। এ তোমার স্কুল-এটা তারা সহ্য
করতে পারছে না।’ তুমি ঠিকই বলেছ। আমিও টের পেয়েছি। সময়ে সত্যে প্রতিষ্ঠিত
জীবনে এরা কালিমার কালি ছুড়বে, কিন্তু কালি লাগবে না। শিক্ষা বিভাগ আমায়
জানে। আখতার হামিদ খানও আমার কনফিডেনসিয়ালে
লিখেছেন-‘ইনকরাপটিবেল’-দুর্নীতির ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। চাঁদে কলঙ্ক দেখার লোকই
তো বেশি। সত্যসেবীরা সত্যের মর্যাদা জানে, বুঝে, দানও করে।’ আর একটা
প্রশ্নও তিনি করেছিলেন, ‘সবাই চায় পাবলিক স্কুল, হাই স্কুল। এসব কথায় তুমি
মারমুখী হয়ে উঠো কেন?’ উত্তর ছিল, ‘শিশুদের আমি ভালোবাসি, ওদের চেহারায়
দেখি বেহেশতি ছবি। ওরা আশার আলো। আমার লক্ষ্য শিশুর যত্ন, শিশু-মনে ভালো
বীজ বপন, ভালো ফুল-ফল। তার বেশি নয়। শিশুরা পবিত্র। তাদের ছোঁয়ায়, তাদের
সান্নিধ্যে যেন মনপ্রাণ চিরদিন পবিত্র, চিরসুন্দর থাকে, তাই দোয়া করো। আমার
নামও যে পবিত্রতার দাস।’
সত্য পথের তীর্থ পথিক! ভয় নাই, নাহি ভয়,
শান্তি যাদের লক্ষ্য, তাদের নাই, নাই পরাজয়। অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায়
মাঝে মাঝে অবশেষে চিরলাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে।
ছয়
একটি বিপর্যয়
জুলাই
১৯৬২ মার্চ পর্যন্ত সময়টা দ্বন্দ্বের, সংঘাতের, বিতর্কের। ১৯৬২ সালের
জুনের শেষাংশে কুমিল্লা কনভেন্টের মিশনারিদের অপ্রিয় অশোভন ব্যবহারে হঠাৎ
সিভিল ও মিলিটারি কর্তারা সম্মিলিতভাবে ফাতেমা কনভেন্টের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়ায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজির মাধ্যমে একটা উচ্চ বিদ্যালয় ও চিলড্রেন্স
হোমের সাথে আর একটা বাংলা শাখা সংযোজিত করে মডার্ন স্কুল নামে চলবে। আমি,
সহকর্মী রশিদ সাহেব ও ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ জনাব শফিকুর রহমান সাহেব
চিলড্রেন্স হোমের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ
হই। আমার বহু আকাক্সিক্ষত আদর্শের পথে এ বিপর্যয়ে মুষড়ে না পড়ে আমি ধৈর্য
ধারণ করি এ জগা-খিচুড়ির সংমিশ্রণ দু'দিন পরই ধসে পড়বে দূরদৃষ্টিতে তাই
দেখেছিলাম। কারণ যার পেছনে কোনো আদর্শ নেই, দ্বন্দ্বে আর বিদ্বেষে যার জন্ম
তার জীবনকাল সম্পর্কে আমি ছিলাম সন্দিহান। হলোও তাই। তিন জায়গায় তিনটি
শাখা, জেলা স্কুল গৃহে সকালে বসে ইংরেজি শাখা, বাংলা একটি ভাগ জেলা স্কুলের
কমনরুমে আর তৃতীয় শাখা বর্তমান স্কুল অভ্যন্তরস্থ পুরানো দালানে। বছর না
ঘুরতেই মিলিটারিরা তাদের সমস্ত ছাত্র নিয়ে স্থাপন করল ইস্পাহানি পাবলিক
স্কুল ময়নামতিতে। ইংরেজি বিভাগের মাত্র ১৩টি ছেলে থাকে মডার্ন স্কুলে, তা
শেষ হয়ে যায় ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে। ফিরে এলো চিলড্রেন্স হোমের পূর্বরূপ।
কিন্তু মডার্ন স্কুল নামে। এ এলোমেলো অবস্থায় আমি অনেকটা আলাদা রাখি নিজকে
এবং লেখাপড়ার কাজ ছাড়া অন্যদিকে থাকি নিশ্চুপ। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের পর
থেকে পূর্ণোদ্যম নিজ মতবাদ অনুযায়ী পরীক্ষণ কাজে পুনঃআত্মনিয়োগ করি।
তারপর
অব্যাহত গতিতে স্কুলের কাজ চলতে থাকে, স্কুল ঘর নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলে।
শ্রেণিবিভাগ সম্প্রসারণ করা হয়। ক্রম-গতির শেষ পর্যায় ১৯৭০ সালের মে
পর্যন্ত। প্রতি শ্রেণি ঘ শাখাতে অর্থাৎ চারটি শাখায় প্রসারিত করা হয়। কেজি ও
পঞ্চম শ্রেণি থাকে তিন শাখা বিশিষ্ট। ছাত্র সংখ্যা তাতে দাঁড়ায় ৭০০ শতের
অধিক আর শিক্ষক সংখ্যা প্রথম বর্ষের ছয়জনের থেকে এসে দাঁড়ায় ২৩ জনে।
মানব
জীবনের মতো প্রতিষ্ঠানের উপরও ঝড়-ঝঞ্ঝা আসে। আবর্জনা, অসত্য অসুন্দর যা-তা
উড়ে যায়, সত্যের চিরন্তন রূপ চিরসত্যরূপেই উদ্ভাসিত থাকে।
সাত.
আদর্শ স্থাপনের পথে পরীক্ষণের বিষয়
প্রাইমারি
শিক্ষায় কতকগুলো পরীক্ষণের প্রয়োজন, যা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়,
সমাজব্যবস্থায়, আর্থিক ও জাতীয় আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন। পরীক্ষণ
সার্থক হলে এর বিস্তৃতি হতে পারে দেশের সর্বত্র।
প্রথমত, প্রতিটি শহর ও গ্রামে পরীক্ষণের প্রধান বিভাগ তিনটি, শ্রেণি গঠন ও শিক্ষাব্যবস্থা-
০ শ্রেণিতে ছাত্র সংখ্যা থাকবে ৩০ থেকে ৪০।
০ কে. জি. থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা।
০ একই শিক্ষক সংবৎসরব্যাপী কে.জি. থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কাজ করবে।
০ এই তিন শ্রেণিতে বৎসরান্তে কোনো ছেলেমেয়েকে আটকে রাখা হবে না। সবাই তৃতীয় শ্রেণিতে ক্রমগতিতে প্রমোশন পাবে।
০ এই তিন শ্রেণিতে কাজ করবে শিক্ষিকারা-শিক্ষক নয়।
০
পঞ্চম শ্রেণি হতে সবাইকে প্রমোশন দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। প্রথম বর্ষ থেকে এ
ব্যবস্থা মডার্ন স্কুলে বাস্তবায়িত হয়েছে। সংবৎসরব্যাপী একই শ্রেণিতে কাজ
করতে প্রথমত, শিক্ষিকারা ইতস্তত করেছেন। পরে কার্যকারিতা ও সফলতা দেখে
খুশিই হয়েছেন, গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন, ফলাফল শুভ হয়েছে।