দেশে পটপরিবর্তন হয়েছে। তার পরও দেখা যাচ্ছে, নানা সময়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শুধু নয়, দেশের বাইরে থেকেও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি বাইরের কিছু গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। তার ঢেউ এসে লাগছে বাংলাদেশে, অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
এ অবস্থায় একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্যের প্রয়োজন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। দেশটিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে চায় বর্তমান সরকার। কিন্তু গত কয়েক দিনে সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা কিছুটা হলেও উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।
এই উদ্বেগ দূর করা দরকার। সে প্রয়োজনীয়তা সরকারও অনুভব করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। গত বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে উপস্থিত দলগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এক কাতারে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছে।
দেশের ক্রান্তিকালে সব বিভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে একমত হয়েছে। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে ষড়যন্ত্র ঠেকাতে একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মুক্ত স্বাধীন নতুন বাংলাদেশকে মুছে দিতে কল্পকাহিনি প্রচার করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না।
বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে, সেটিকে ধামাচাপা দিয়ে আরেক বাংলাদেশের কাহিনি রচনার অপচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এটা যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে, তা-ও নয়।
বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে এটা ছড়িয়ে গেছে। আমাদের বিরাট অভ্যুত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটা মুছে দিতে চায়, আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়, যেন আমাদের এখানে ভয়ংকর কাণ্ড হয়ে গেছে, সেখান থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।’
সংলাপ শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এই সভার মূল সুর ছিল, আমাদের মধ্যে মত-পথ-আদর্শের ভিন্নতা থাকবে, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিন্নতা থাকবে, অবস্থার ভিন্নতা থাকবে; কিন্তু দেশ, সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বের প্রশ্নে আমরা সবাই এক।’ তিনি বলেন, ‘সবার ওপরে দেশ-এটা থেকে আমরা কখনো বিচ্যুত হব না। বাংলাদেশকে দুর্বল, নতজানু ও শক্তিহীন ভাবার কোনো অবকাশ নেই।’ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার বিষয়টি তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, ‘ভারতে বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা, বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ-এসবের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।’ ভারতের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের আত্মমর্যাদাশীল ও সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সেই ঐক্যের সুরই প্রতিধ্বনিত হয়েছে গত বুধবারের বৈঠকে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই ঐক্য অটুট থাকবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দ্বিতীয়: শিক্ষাদান ব্যবস্থা
০ ভাষা শিক্ষাদানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ। ভাষা শিক্ষার ঘণ্টা ৬০ মিনিটের। প্রয়োজনবোধে আরো বেশি। উচ্চারণ, লেখা ও প্রকাশ ক্ষমতার উপর গুরুত্ব আরোপ।
০ পরীক্ষা আবশ্যিক। মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক পরীক্ষা গ্রহণ।
০ জুলাই-আগস্ট থেকে পিছনে পড়া ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সবাইকে পরবর্তী শ্রেণির উপযুক্ত করার জন্য বিষয় শিক্ষকের উপর দায়িত্ব অর্পণ। এতে সব ছেলেমেয়েদের মনোন্নতির গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে।
০ সামাজিক শিক্ষার আওতায় সামাজিক অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে আবৃত্তি, বিতর্ক, গান, নাচ, হাস্যকৌতুক, জারিগান, সমবেত সংগীত ও শরীরচর্চা ইত্যাদির ব্যবস্থা। এতে একদিকে আনন্দ বিধান অন্যদিকে সৃজনীর বিকাশ।
০ শ্রেণি কক্ষ, স্কুল-বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখার প্রাত্যহিক ব্যবস্থা, হাতে-কলমে কাজ।
০ প্রতিভাবান ছেলেমেয়েদের প্রতি দৃষ্টি। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকেই তাদের আবিষ্কার ও যত্নের মহড়া চলেছে। তাদের উপযোগী প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পাঠ ব্যবস্থা, অংক শিক্ষা প্রভৃতি নির্দেশিত নিয়মে চলছে। বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের সেরা শিক্ষকদের হাতে তৈরির ভার দেয়া হয়েছে।
০ স্কুল সময়ের এক-পঞ্চমাংশ খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও বহুমুখী সুপ্ত প্রতিভার স্বাভাবিক স্ফুরণের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি। এতে শ্রেণি বিভাগে খেলাধুলা, সৃজনীমূলক কাজ, সাধারণ জ্ঞান, স্বাধীনভাবে কথ্য ও লেখ্য ভাষায় প্রকাশের প্রতিযোগিতা চলে। আনন্দময় পরিবেশে প্রগতির পথ সুগম হয়।
০ প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন স্কুল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাতে থাকছে সৃজনীমূলক কাজের প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, এ ছাত্র- শিক্ষকদের সমবেত অবদান। শিক্ষার একটা নতুন ক্ষেত্র।
তৃতীয়: শিক্ষক প্রস্তুতি
০ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, শিক্ষক তৈরি করা হয় না। এ দেশে এই রীতি। নিযুক্তির পর গতানুগতিকতায় ভেসে যায় তারা। তাই প্রথম বর্ষ থেকেই ব্যবস্থা করা হয় ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে শিক্ষকদের চিন্তাধারা, কর্মজ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অবিরাম শিক্ষাব্যবস্থা।
০ সাপ্তাহিক সভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকে। অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেই শিক্ষকগণ শিখতে বাধ্য হন। না শিখার ভাব দূর করতে অনেক সময় নিয়েছে। অথচ পরিণামে তারাই উপকৃত হয়েছে।
০ প্রত্যেক শিক্ষককে শিক্ষার নতুন গতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করানো এবং উৎকর্ষ অর্জনে ব্যক্তিগত সাহায্য দান চলে। যাকে দিয়ে যে কাজ ভালো চলতে পারে, সেভাবে তাকে তৈরি করানো হয়েছে। স্বভাব ও অভ্যাস বদলানো কষ্টকর হলেও সব সময় পিছনে লেগে থাকায় তা অনেকটা সম্ভব হয়েছে।
০ বিষয়-বিভাগে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের জন্য উপকরণ নির্ধারণ, তৈরি বা সংগ্রহ এবং প্রত্যক্ষভাবে তা ব্যবহার করার প্রতি নজর রাখা হয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও অনেকেই কষ্ট স্বীকার করেছেন। এতে খাটুনি একটু বেশি।
০ শিক্ষকতায় যোগ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট বই পাঠ, অভিজ্ঞতা অর্জন ও উচ্চতর পরীক্ষা পাসের জন্য উৎসাহিত করার ফলে অনেকে যোগ্যতর হয়েছেন। অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ছিল প্রথম কাজ। পথের দিশা দেখানোর মতো প্রধান শিক্ষকের অভাব প্রকট।
এ পরিকল্পনা মাফিক প্রধান শিক্ষকসমেত সব শিক্ষকদেরই মাঝে মাঝে শিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সাহায্য দেয়া হয়েছে বেশি। কোন শিক্ষকের কী প্রয়োজন, কোথায় দুর্বলতা, কোথায় যোগ্যতা তা আবিষ্কার করে বন্ধুর ভূমিকায় সাহায্যদান ছিল প্রতিনিয়ত একটা কর্তব্য। নিরলসভাবেই তা করেছি এবং আশ্চর্য রকমের ফলও পেয়েছি, অবশ্য নতুনকে গ্রহণের জন্য শিক্ষকের মন তৈরি করা ছিল কঠিন কাজ। তারপর সক্রিয়তা সৃষ্টি করা ছিল কঠিনতর। তবে এ সত্য বলে প্রমাণিত আমাদের মাঝেও যথেষ্ট প্রতিভাবান শিক্ষক আছেন। পরিচর্যার অভাবে, পথের দিশা দেখানোর মতো যোগ্য শিক্ষক-প্রধানের অভাবে গতানুগতিকতার মধ্যেই তারা আটকে থাকে। এটা দুর্ভাগ্যের কথা হলেও সত্য কথা।
পরীক্ষণ যোগ্যতা
অনেকের মনে সন্দেহ জাগবে, অজ্ঞতার জন্য প্রশ্ন আসবে পরীক্ষণে আমার যোগ্যতা কী? শিক্ষা ও শিক্ষণের দেশি-বিদেশি চারটি ডিগ্রি ব্যতীত কর্মজীবনে পরীক্ষণ চালিয়েছি প্রাইমারি শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে। শিক্ষক তৈরির কারিগর হিসেবে। বিদেশে অনেকগুলি পরীক্ষণ দেখারও সুযোগ হয়েছে। জীবনের বেশিরভাগ সময় শিক্ষক তৈরির কাজেই কাটিয়েছি। আর পরীক্ষণটা আমার জীবন-নেশা। পরীক্ষণের কয়েকটি ফলাফল বিদ্বজ্জন কর্তৃক সমাদৃত, শিক্ষা বিভাগে অনুসৃতও হয়েছে।
বিভাগ-পূর্ব বাংলায়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বাংলার শিক্ষক’ পত্রিকায় একমাত্র প্রাইমারি শিক্ষার উপর প্রকাশিত হয়েছে বিশটি প্রবন্ধ। বিভিন্ন দিকের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে। নিজে কুমিল্লা থেকে প্রকাশ করেছি ‘আলো’ নামে প্রাইমারি শিক্ষাবিষয়ক পাক্ষিক তিন বহর। চিন্তার, ভাবধারার প্রকাশ রয়েছে তাতে। ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা সংস্কারের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার যে কয়টি শিক্ষা কমিশন, কমিটি নিয়োগ করেছে তার প্রত্যেকটিতেই সদস্য হিসেবে এবং একটিতে (১৯৫৭-৫৮) সহ-সম্পাদক হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ হয়েছে। মুজিব সরকারের শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে প্রাইমারি ও বয়স্ক শিক্ষার অধ্যায় দুটির খসড়া করা ও শেষ দেখারও সুযোগ আমার হয়েছে।
পরীক্ষণ ক্ষেত্রে ভাষা শিক্ষা, শ্রেণি পাঠ, হাতের লেখা সৃজনী শক্তির বিকাশ ব্যবস্থা ব্যতীত কুমিল্লা কোতয়ালী থানায় শিশু সংস্থা সবুজ সংঘ, প্রাইমারি স্কুলে কৃষি শিক্ষা, সমবায় দোকান, জাদুঘর ও পাঠাগার স্থাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরীক্ষণ চালিয়ে সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। তা-ই আমার সম্বল, আমার মূলধন। সুখের বিষয়, সরকার তার অনেকগুলোই সমর্থন করেছে, গ্রহণ করেছে।
‘শিক্ষানীতির কয়েকটি কথা’, ‘ডিউইর শিক্ষা মতবাদ’, ‘পাঠশালার প্রথম শ্রেণি’ প্রাইমারি শিক্ষা সম্পর্কিত আমার লেখা বই। প্রথম বইখানা পি.টি.আই.-এর জন্য সরকার অনুমোদিত পাঠ্য এবং শিক্ষক-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের রেফারেন্স বই। তাছাড়া ইংরেজি বাংলায় বিভিন্ন পত্রিকায় একমাত্র প্রাইমারি শিক্ষার উপর লিখিত প্রবন্ধ সংখ্যা ৪০-এর ঊর্ধ্বে। এগুলো ক্রমগতিশীল চিন্তাধারা, কার্যক্রম ও পরীক্ষণের মূলমন্ত্র ও সূত্র বহন করছে।
দুনিয়ার পরিবর্তন নিত্যকার। পরিবর্তন হয়েছে, হবে। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষার গতি ও প্রকৃতি সভ্যতার ক্রমবিকাশে বদলাচ্ছে, বদলাবে। তারই জন্য প্রয়োজন নতুন পথ ও পন্থা উদ্ভাবন। পরীক্ষণের মাধ্যমেই তা সম্ভব। তারই জন্য আমার গবেষণা, পরীক্ষণ। মডার্ন স্কুলটি পরীক্ষণ কেন্দ্র। শিক্ষার নীতি, পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষকের কর্মধারা, পাঠ্য পুস্তক, শিশুর বিকাশ ধারা-এই তো ছিল পরীক্ষণের বিষয়।