অগ্রজ কে?
অগ্রজ হলেন যিনি অগ্রে বা আগে জন্মগ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ প্রবীণ বা জ্যেষ্ঠ
বা পূর্বজ। আর অনুজ কে? অনুজ হলেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা বা অনুজন্মা বা পরে জাত বা
ছোট ভাই। এই অগ্রজ ও অনুজ অর্থাৎ বড়-ছোট দুই সহোদর একই মায়ের বাবা জাত বা
একই মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ। তারা আগে ও পরে জন্ম নেওয়া একই মায়ের কোলে
লালিত-পালিত হয়ে জীবন গ্রহণ করেন। জীবনের এই শুরুতেই একই বাবার ঔরসজাত দুই
সন্তান ছবক পান- ভবিষ্যতের পথে তাদের যাপন ক্ষেত্রে কেমন সম্পর্ক নিয়ে পথ
হাঁটবে। মা তখনই বলে দেন- দুই ভাই মিলেমিশে থাকবে, কেউ কাউকে অসম্মান করবে
না অর্থাৎ বড় ভাইকে সম্মান করবে এবং ছোট ভাইকে স্নেহ করবে। এই সম্মান ও
স্নেহই হলো মূলত অগ্রজ ও অনুজের সম্পর্ক।
আমার জন্মের পর থেকেই এ কথা
জেনে আসছি, দেখে আসছি, শুনে আসছি, যা এখন কমে যাচ্ছে। শুধু ভাইয়ে ভাইয়ে
সম্পর্ক কেন- সম্পর্ক সব জায়গাতেই কমে গেছে বা যাচ্ছে। আমি কেন আজ এই
সম্পর্ক নিয়ে কথা বলছি? বলছি এ কারণে যে, এখন ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো
অগ্রজ ও অনুজের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরছে। একান্নবর্তী আগেকার বাঙালি
পরিবার ভেঙে গেছে, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে, এককেন্দ্রিক পরিবার প্রথা
চালু হয়েছে। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে। সেটি ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে বড়
স্বার্থ, সেটি জমিজমা থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে, এমনকি এখনকার স্ত্রীরাও
(নিশ্চয়ই নারীদের খাটো করে বলছি না) আর আগের মতো যৌথ পরিবারে থাকতে চাচ্ছে
না। এখন সবার চাহিদা বেড়েছে। প্রচলিত জীবন থেকে আমরা সরে যাচ্ছি আধুনিক
তথাকথিত সভ্য ও প্রযুক্তিগত জীবনব্যবস্থার নামে। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি
হচ্ছে। মানুষের মানসিক অবস্থান বদলে যাচ্ছে, মানুষ বেশি বেশি
আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তন ঘটছে বা পাল্টে যাচ্ছে ভূ-রাজনীতি,
অর্থনীতি, সমাজনীতি, পরিবারনীতি। দিন দিন ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেক বেড়ে
যাচ্ছে। বড়রা ছোটদের শোষণ করছে, যেন কুমির খেয়ে ফেলছে নদীর সব মাছ?
জানেন
তো, অগ্রজ ও অনুজের প্রথম দ্বন্দ্ব বা শত্রুতা তৈরি হয় পরিবারেই (সব
পরিবারেই নয়)? কেমন করে? দেখবেন একই মায়ের পেট থেকে প্রসব হওয়া এক
ছেলেসন্তান একটু ফর্সা, একটু সুদর্শন হলো আর অন্যজন একটু শ্যামলা এবং কম
সুদর্শন হলো। এই যে পরেরজন, শুরু থেকেই তার মধ্যে ক্রিয়া তৈরি হয়, মা-বাবা
হয়তো বলেন না কিন্তু অন্যরা যখন বলেন, ‘তোমাদের এই পোলাটা একটু মলিন হইছে?’
তখনই বাবা-মাসহ ওই সন্তানের মন কেমন করে যেন নড়ে ওঠে, ছন্দপতন হয়।
আবার
দেখবেন, মা হয়তো অবচেতনভাবেই এক ছেলের প্লেটে মাছ বা মাংসের ছোট টুকরাটা
দিলেন, তৎক্ষণাৎ অন্যজন প্রতিবাদের সুরে বলল, মা ভাইয়াকে বড়টা দিলে আর
আমাকে ছোটটা দিলে কেন? এর উত্তর দিতে না দিতেই অভিমানে, রাগে না খেয়ে সে
হয়তো উঠে যাবে? মনে মনে ভাববে, সে দেখতে শ্যামলা বলে মা তাকে কম আদর করেন?
আসলে মা কি তা করেন? করে না, মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান কিন্তু প্রকৃতির
নিয়মে কীভাবে যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়? এটা এক ধরনের উদাহরণ- সব জায়গাতেই
নয়, তবে এই যদি শুরু হয়, তা সংশোধন হওয়া খুবই কঠিন। হয়তো অনেকে
রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথা বলবেন- ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’।
আসলে সত্য সব সময়ই কঠিন কিন্তু আমাদের এই সময়ে সত্যের পৃথিবী ধীরে ধীরে
হারিয়ে যাচ্ছে, ভরে যাচ্ছে মিথ্যায়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও বড় অর্থে
রাষ্ট্র মিথ্যার বেসাতিতে আচ্ছন্ন হচ্ছে। কেন? আসুন এই কেন-এর উত্তর
খোঁজার চেষ্টা করি?
২.
‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের- মানুষের সাথে তার
হয় নাকো দেখা’... কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই বিখ্যাত চরণের মতোই হয়ে
যাচ্ছে যেন আমাদের বর্তমান সময়ের জীবন। আমরা ভাই থেকে ভাই দূরে সরে যাচ্ছি,
বাব-মায়ের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, সন্তান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি বা সন্তান
মা-বাবা থেকে দূরে সুরে যাচ্ছে, আত্মীয়স্বজন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি,
পড়শির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে, সমাজের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে অর্থাৎ
আগেকার মতো একতাবদ্ধ সমাজকাঠামো ভেঙে পড়ছে, রাষ্ট্রের অবস্থা তথৈবচ। যে
সম্পর্কে কথা বলছি- অগ্রজ ও অনুজের, সেই যে শুধু সেখানে নষ্ট হয়ে গেছে
তাই-ই নয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে ওপরের যে বিষয়গুলোর কথা বললাম- সব ক্ষেত্রেই।
এখন দেখতে পান কী যে, ঘরের মধ্যে দুই ভাই বা ভাইবোনের মধ্যে কোনো বিষয়ে
কথা-কাটাকাটি হলেই বড়রা এসে মাঝখানে দাঁড়ালে দুই পক্ষ থেমে যেত বা বাবা-মা
এসে থামিয়ে দিতেন। এখন দেখুন এই দৃশ্য আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে। আগে
দেখতাম, আত্মীয়ের আসা-যাওয়া ছিল, খাওয়া-দাওয়া ছিল, কেউ কোনো বিপদে পড়লে
অন্যজন দৌড়ে এসে সাহায্য করতেন- এখন? আগে দেখতাম, রাস্তায় দুজন বা দুই পক্ষ
মারামারি করলে সাধারণ মানুষ এগিয়ে তা মিটিয়ে দিতেন- এখন? এখন এসব
মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি বা কোনো দুর্ঘটনা দেখলে কেউ এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা,
যত তাড়াতাড়ি তা এড়িয়ে যাওয়া যায় বা কেটে পড়া যায়, তাই করেন। বলছি, এগুলো
সবই সম্পর্কের অধঃপতনের কারণ। এই সম্পর্কের অধঃপতনের কারণেই এখন দেখবেন,
ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে, এক আত্মীয় আরেক আত্মীয়কে, এক পরিচিত আরেক
পরিচিতকে টাকা-পয়সা ধার দিচ্ছেন না। এখন বিশ্বাসের অভাব ঘটেছে, অর্থাৎ একজন
আরেকজনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
সম্পর্কের অবনতি ঘটছে আরেকটি
বিরাট ক্ষেত্রে, সে ক্ষেত্রটির নাম ‘প্রেম’ বা ‘ভালোবাসা’। ইদানীং
প্রেমিক-প্রেমিকা বলেন কিংবা স্বামী-স্ত্রীর কথা বলেন, সম্পর্ক গড়ে ওঠার
আগেই বা জমে ওঠার আগেই বা স্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিচ্ছেদ বা সম্পর্কের
ছেদ ঘটছে। কেন? এই কেন-এর এখন অনেক উত্তর। দেখুন, পারিবারিক বন্ধন বা
কাঠোমোর মধ্য থেকে, মুরব্বিদের উপদেশ মেনেই এবং সমাজের চোখকে খাতির করেই
ছেলেমেয়ে বা তরুণ-তরুণীরা বা যুবক-যুবতীরা প্রেম করতেন বা সম্পর্ক করতেন।
বিয়ের
ক্ষেত্রে অসাধারণ নিয়ম ও শালীনতা মেনে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে সম্পর্কের
রশি তৈরি করতেন। এতে এক পরিবার আরেক পরিবারের খোঁজখবর নিত, ছেলেমেয়েদের
স্বভাব-চরিত্র দেখত, তারপর পছন্দসই বিয়ে দিত। এখন তা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে।
এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী অধিকাংশ বিয়ে
হচ্ছে বা প্রেম হচ্ছে। ফলে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, টাকা-পয়সা বা অনেক সময়
আবেগের কারণে এসব সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। আগে পিতা-মাতার কথা অনুযায়ী
সন্তানরা চলত, পিতা-মাতা না থাকলে পরিবারের বড় ভাই বা বড় বোনের আদেশ বা
পরামর্শে ছোটরা সব কাজই করত, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা পালন করছে না অধিকাংশ
ক্ষেত্রে। নানান কারণে এখনকার প্রজন্ম আদর্শিক বিষয়ে মানতে চাচ্ছে না?
মানলাম সময়ের কারণে বদল ঘটতেই পারে কিন্তু এক কবির কথায়- ‘বদলে দিন, বদলে
যান’- আসলে সবকিছু বদলানো যায় না, আপনি কি আপনার বাবা-মাকে বদলে দিতে
পারেন? না, সম্পর্ককে তো বদলে দেওয়া যায় না।
৩.
সম্পর্কের এই বদলে
যাওয়ার কারণে কি সমাজকাঠামো ভেঙে যাচ্ছে? তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
দেখুন, কীর্তিমানরা সম্পর্ক নিয়ে কী বলেছেন, নিচে তাদের কিছু উক্তি তুলে
ধরছি:
১. ‘ভালোবাসার সম্পর্ক হলো একই আত্মায় বসবাস করা দুটি ভিন্ন দেহের গল্প’ -এরিস্টটল।
২. ‘সম্পর্কটা হলো এমন একটা খেলা, যেখানে দুজনেই খেলতে পারে এবং জিততে পারে’ -ইভা গাবর।
৩. ‘সত্যিকারের সম্পর্কে কোনো লুকোচুরি খেলা নয় বরং এখানে দুজনেই দুজনকে খুঁজতে থাকে’ -মাইকেল ব্যাসি জনসন।
৪. ‘বিশ্বাস ছাড়া তুমি কখনোই একটি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না’ -পিকচার কোটস।
৫. ‘ভালোবাসার সম্পর্ক হলো বাতাসের মতো, তুমি একে দেখতে পারবে না তবে অনুভব করতে পারবে’ -নিকোলাস স্পার্কস
৬. ‘যার সঙ্গে মানুষের লোভের সম্বন্ধ তার কাছ থেকে মানুষ প্রয়োজন উদ্ধার করে কিন্তু কখনো তাকে সম্মান করে না’ -রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের
প্রবাদপ্রতিম উল্লিখিত বাক্যে স্পষ্ট যে, লোভ ও স্বার্থের প্রয়োজনে যখন
আপনি কারও সঙ্গে মিশবেন- তিনি আপনার সহোদর হোন, নিকটাত্মীয়ই হোন, যখনই
পরস্পর স্বার্থ উদ্ধারের পরিকল্পনা করবেন, ঠিক তখনই ভেঙে যাবে উভয়ের
মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্ক।
আপনিও স্বীকার করবেন যে, এই মুহূর্তে
বাংলাদেশে একজনের সঙ্গে একজনের সম্পর্ক তলানির দিকে যাচ্ছে। আপনিও নানাভাবে
দেখছেন, জানছেন যে স্বার্থ, লোভ, লালসা, ঈর্ষা, শত্রুতার কারণে ভাই ভাইকে
অপমান করছে, এমনকি খুন পর্যন্তও করছে, খুন করছে বাবা সন্তানকে, সন্তান
বাবাকেও। সামান্য বিষয় নিয়ে পরিবার, পড়শির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। ফলে
কবি হুমায়ুন আজাদের ভাষায়- ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। এই কথা তিনি
বলেছিলেন আরও কয়েক বছর আগে, সময় গড়িয়ে এখন ইতোমধ্যে যাবে থেকে যাচ্ছে। এটি
কি যেতে দেওয়া ঠিক? ঠিক নয়।
৪.
আমরা কি সম্পর্ক নষ্ট হতে দিতে পারি?
তাহলে তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবনের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখতে হবে,
বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবনে বিফল হলে সমাজ, দেশ এবং জাতির যে মূল
প্রতিবাদ্য সংস্কৃতি ও সদাচার-শিষ্টাচার তা নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষ করে
বর্তমান তরুণ-তরুণীদের যে শিষ্টাচার, আচার-আচরণ, অভ্যাস, বড়দের প্রতি
সম্মানহীনতা, ছোটদের প্রতি স্নেহসুলভ আচরণের অভাব এমনকি পরিবারের ভেতর যে
বন্ধন থাকার কথা, তার উন্নতি করতে হবে। বিগত এই জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে
তারুণ্যের উচ্ছ্বাস থাকলেও এই সময়টাতে আদর্শগত এবং সদাচার ও সম্পর্কের দরজা
থেকে অনেক দূরে সরে গেছে তারা- এই চিত্রই আমরা দেখলাম। একদিকে একটা অর্জন
করেছে বটে, অন্যদিকে নষ্ট করে ফেলেছে ভেতরের আবেগ, অনুভূতি এবং নানাজনের
সঙ্গে সম্পর্কে ফুল। ফুল বললাম এ জন্য যে, সম্পর্কটাও ফুলের মতো পবিত্র। আর
প্রকৃতির অপূর্ব সুন্দরের নাম ফুল। আসুন ফুলের সুগন্ধি নিই, সম্পর্কের
সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলি। সুন্দর সম্পর্ক মানেই সুন্দর জীবন। বিশেষ করে অগ্রজ ও
অনুজের সম্পর্কটি।
আসলে সম্পর্ক হলো বাবার কনিষ্ঠ আঙুল, যে আঙুলটি
ছোট্ট মুঠো দিয়ে ধরে হেঁটে যাওয়া যায় গ্রামের হাটের দিকে, নদীর দিকে, ট্রেন
দাঁড়ানো স্টেশনের দিকে- যে ট্রেনে উঠে পাড়ি দেওয়া যায় বহু বহু দূরের পথ...
লেখক: কবি