বড় বড় গাছের ছায়া
ঘেরা সবুজ ঘাসের মাঠ। এক পাশে সাদা দেয়ালের সারি সারি ঘর। বারান্দায় ধুলোর
আস্তরণ, দরজাগুলোর কমলা রঙা কপাট দেখে অযত্নের অনুভূতি হয়। জানালার ফাঁক
দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলে যে অন্ধকার দেখা যায়, কপাট খোলা থাকলে সে অন্ধকার
কিছুটা প্রশমিত হলেও- স্পষ্ট বুঝা যায়, টুল টেবিল চেয়ার আর
ব্ল্যাকবোর্ডগুলো প্রায় তলিয়ে থাকে অন্ধকারেই। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত
নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়; বিশ্বনন্দিত কুমিল্লার মহেশাঙ্গণের যে
প্রতিষ্ঠান থেকে শতবর্ষ আগেও শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে এই কুমিল্লা শহর তথা পুরো
সমতটে- সেই প্রিয় স্কুল ডুবে আছে অন্ধকারে। নানান সঙ্কট আর অযত্নে শিক্ষা
সাহিত্যের সংস্কৃতির পাদপীঠ খ্যাত কুমিল্লার শিশু শিক্ষাঙ্গণটির প্রাণ
প্রদীপ যেন নিভতে চলেছে। এক সময় এই স্কুল শত শত শিক্ষার্থীর কলরবে মুখর
থাকলেও এখন মাত্র হাতে গোণা কয়েকজন কমলারঙা শার্ট- কামিজ পরে টুল-টেবিলে
বসে। বড় ফটকের সদর দরজাটি এখন আর কাজে লাগে না, টিচার্স রুমের ভেতর দিয়ে
-নিবেদিতা ছাত্রী নিবাসের অলিগলি দিয়ে শিক্ষার্থীদের আসা যাওয়া।
কুমিল্লার
বিশিষ্টজনেরা জানান, মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এই উপমহাদেশে বিশিষ্ট
সমাজকর্মী সিস্টার নিবেদিতার নামে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সিস্টার
নিবেদিতা ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা
রাখেন। রামমালা গ্রন্থাগার, ঈশ্বরপাঠশালা, নিবেদিতা ছাত্রী নিবাসসহ পূর্ব
বাংলার শান্তিনিকেতন খ্যাত মহেশাঙ্গণের উজ্জ্বলতার কাছে- তারই অঙ্গ
প্রতিষ্ঠান নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয় যেন বাতির নিচে অন্ধকার।
আধুনিকায়নের
অভাবে আশেপাশের কিন্ডারগার্টেন বা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সাথে পাল্লা
দিতে না পেরে দিন দিন শিক্ষার্থী কমে আসাকে নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
স্তিমিত হয়ে যাবার কারণ বলে মনে করছেন বিদ্যালয়টির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান
শিক্ষক দিপালী দাশগুপ্ত। তিনি জানান, এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা এতটাই কমে
এসেছে- বলতেও কান্না আসে। নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এখানে এখনো
পড়ানো হয়। ২০১১ সাল থেকে এই স্কুলটিতে নার্সারি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে ৫
জন নারী শিক্ষক দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্ববরেণ্য দানবীর মহেশ চন্দ্র
ভট্টাচার্যের প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা মহেশাঙ্গণের বর্তমান ট্রাস্টি বিশিষ্ট
আইনজীবী সৌরভ কুমার দেব জানান, মহেশাঙ্গণ ট্রাস্ট থেকেই এখনো এই
প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। বিদ্যালয়টির পুরোনো ঐতিহ্য যেন ফিরিয়ে আনা সে
জন্য নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
জানা গেছে, কুমিল্লার মহেশাঙ্গণে (ঈশ্বর
পাঠশালা) ভগিনী নিবেদিতার নামে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিবেদিতা প্রাথমিক
বিদ্যালয়। আশেপাশের শিশু শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত
করতে এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন নারীদের চাকরি দিতেই এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা
করা হয়। শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষায় শিশু সন্তানদের শিক্ষিত করা নয়,
পাশাপাশি ধর্মীয় আচার-আচরণ ও নীতি নৈতিকতা শিক্ষায় এই স্কুলের সুনাম ছিল
পুরো কুমিল্লা অঞ্চলে। কুমিল্লা ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও নোয়াখালী
থেকেও এখানে এসে পড়েছেন অনেকে।
১৯৬৪ সালের দিকে নিবেদিতা প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সুনন্দা কবির। স্মৃতিচারণ করতে
গিয়ে তিনি জানান, কুমিল্লা শহরের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা ও প্রাথমিক
শিক্ষার নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছিলো অনন্য ভূমিকা। বনেদি পরিবারের
পাশাপাশি সাধারণ পরিবারের সন্তানরাও আসতো এখানে পড়তে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী
পরিবারের পাশাপাশি মুসলিম পরিবারের সন্তানেরাও পড়েছে এখানে। এখানে যারা
পড়াতেন তারা শিশু শিক্ষার্থীদের নৈতিক আচার-আচরণ শিক্ষা দীক্ষায় দীক্ষিত
করে তুলতেন।
৬০ এর দশকে নিবেদিতা স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন কুমিল্লার
বাদুরতলার বাসিন্দা শেফালী পাল। পরবর্তীতে তিনি এই স্কুলের শিক্ষকতা করেন।
তিনি জানান, এই স্কুলে পড়াশোনা করেই দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল
জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। ৭০ এর দশকে প্রথম থেকে ষষ্ঠ
শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবছরই অন্তত আড়াইশো জন শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করত।
ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট চিকিৎসক কাবেরী
গুহ ও শিবপ্রসাদ নন্দীর মত মানুষ এখানে পড়াশোনা করেছেন। এখানে যারা পড়াতেন
এবং পড়তেন সকলেই নিজেদের শিক্ষা জীবনের শুরুতে নীতি নৈতিকতার শিক্ষা পেয়ে
গেছে না এখান থেকে।
বর্তমানে স্কুলের অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
স্কুলটি তার পুরোনো গৌরব হারিয়েছে। তবে মহেশাঙ্গন কর্তৃপক্ষ চাইলে আবারও
সুনাম ফিরে আনার সম্ভব।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শান্তিরঞ্জন
ভৌমিক জানান, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী
রাজনৈতিক গুরু ছিলেন প্রফুল্ল রানী ব্রহ্ম। যিনি নিবেদিতা প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
এদিকে কুমিল্লা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা
কর্মকর্তা মোঃ শফিউল আলম জানান, মহেশাঙ্গণ ট্রাস্ট চাইলে আমাদের সাথে কথা
বলতে পারেন। তাদের কি কি সহযোগিতা প্রয়োজন তা যদি আমাদের জানানো হয় তাহলে
আমরা নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ে আশা করি ভালো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ
করতে পারবো।
সমাজকর্মী দৈনিক কুমিল্লার কাগজের সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়
দাবি জানিয়ে বলেন, অযত্ন এবং অবহেলায় নি:শেষ হতে চলা নিবেদিতা প্রাথমিক
বিদ্যালয়টি বাঁচিয়ে তুলতে মহেশাঙ্গন ট্রাস্ট ও জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে
হবে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই দৈন্যদশা মেনে
নেওয়া যায় না। এখানে সকলের দায় আছে। বিদ্যালয়টি পুনরায় শিক্ষার্থীদের
পদচারনায় মুখর হবে এটিই প্রত্যাশা করি। মহেশাঙ্গন ট্রাস্টের সদস্যরাও এর
দায় নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এই আশা করছি।